বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হুমকিতে বঙ্গোপসাগরের মাছ

যাযাদি ডেস্ক
  ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে এবং ইলিশ রক্ষায় সফলতা থাকলেও বঙ্গোপসাগরে মাছের পরিমাণ কমছে এবং কিছু কিছু সামুদ্রিক মাছের প্রজাতি অনেকটা নিঃশেষ হতে চলেছে বলে সতর্ক করছেন বিজ্ঞানীরা।

নির্বিচারে সামুদ্রিক মাছ শিকার এবং অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈধ মাছ ধরা বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে বঙ্গোপসাগর মৎস্যশূন্য হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। সামুদ্রিক মৎস্য গবেষণা ও জরিপের মাধ্যমে এ মূল্যায়ন করছেন গবেষকরা।

বাংলাদেশের সাগরে মাছের মজুদের কোনো সঠিক হিসেব নেই আর কী পরিমাণ মাছ ধরা যাবে তারও সীমা পরিসীমা নির্ধারিত নেই। কারণ সাগরে মৎস্য সম্পদের জরিপ গবেষণা বন্ধ ছিল প্রায় দুই দশক।

২০১৬ সালে নতুন জাহাজ আর. ভি মীন সন্ধানী কেনার পর জরিপ শুরু হয়েছে।

সাগরে ১০-২০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত মহীসোপান এলাকায় এই জরিপ কার্যক্রম চালানো হয়।

গত তিন বছরের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সামুদ্রিক মাছ নিয়ে একটি প্রতিবেদন সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের মেরিন ফিশারিজ সার্ভে ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শরিফ উদ্দীন বলেন, '২০০০ সালের পর থেকে আমাদের ভেসেল বেইজড যে গবেষণা সেটা পুরোপুরি বন্ধ ছিল। বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রকল্পের মাধ্যমে এটা আবার শুরু করা হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'মূলত ২০১৬ সাল থেকে এটা আমরা শুরু করেছি। তিন বছরের প্রাথমিক তথ্যে আমরা দেখছি যে আমাদের সমুদ্রের সার্বিক মজুদ ঠিক থাকলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু মাছের মনে হচ্ছে অতিরিক্ত আহরণ হয়েছে।'

সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের পরিমাণ নিয়ে গবেষণায় যুক্ত সমুদ্র বিজ্ঞানী সাইদুর রহমান চৌধুরী- যিনি মৎস্য সম্পদ জরিপ জাহাজ আর ভি মীন সন্ধানীর তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের সঙ্গেও যুক্ত আছেন। তিনি বলেন, এটা আমাদের সায়েন্টিফিক কমিউনিটির জন্য খুবই উদ্বেগের। মাছের বংশ বিস্তারের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ যেটা রেখে দেয়া দরকার সেটা যদি আমরা না রাখি তাহলে পরবর্তী সিজনে বংশবৃদ্ধি হবে না। পৃথিবীর অন্যান্য সমুদ্রের যেমন গালফ অফ থাইল্যান্ড অনেকটা মৎস্যশূন্য হয়ে গেছে। আমরা চাই না আমাদের বে অফ বেঙ্গল সে রকম মৎসশূন্য হয়ে যাক।'

মাছের যেসব প্রজাতি হুমকিতে

সামুদ্রিক মাছের মধ্যে লাক্ষা, সার্ডিন, পোয়া, লটিয়া, ফলি, চান্দা, হরিণা চিংড়ি ও কাটা প্রজাতির মাছের মজুদ এবং পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমেছে।

গবেষকরা বলছেন এসব সামুদ্রিক মাছ অতিরিক্ত আহরণ করা হচ্ছে।

বিজ্ঞানীদের মতে অতিরিক্ত আহরণের কারণে যে কোনো মাছ বাণিজ্যিকভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার প্রবল ঝুঁকি থাকে এবং সুরক্ষার ব্যবস্থা করা না হলে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবার আশঙ্কা থেকে যায়।

সমুদ্র বিজ্ঞানী সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, 'লাক্ষ্যা, তাইল্যা, রুপচান্দা টাইপের বেশকিছু মাছ বস্তাপোয়া টাইপের বিশেষ করে দামি এবং বড় আকৃতির মাছ এখন খুবই কম পাওয়া যাচ্ছে। বাজার পর্যবেক্ষণ থেকেই আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই যে বেশকিছু মাছের ধারাবাহিক আমরা বছরের পর বছর ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। এটা নির্দেশ করে যে সমুদ্রে তাদের পরিমাণ কমে গিয়েছে বলেই বাজারে তাদের জোগান কমে গিয়েছে।'

জেলেদের অভিজ্ঞতা

সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে বাংলাদেশে কাঠের তৈরি ট্রলার, মাঝারি ট্রলার এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার ব্যবহৃত হয়।

নৌ-বাণিজ্য দপ্তরের হিসেবে নিবন্ধিত কাঠের নৌযানের সংখ্যা ১১,৭১৫টি। তবে ধারণা করা হয় অগভীর সাগরে মাছ ধরায় যুক্ত আছে ৬০-৬৫ হাজার নৌযান।

এছাড়া রয়েছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার যেগুলো সাগরে ৪০ মিটার গভীরতার পরে মাছ শিকার করে।

নৌ-বাণিজ্য দপ্তরের হিসেবে ২৫১টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল নৌযান সমুদ্রে মাছ আহরণ করছে।

চট্টগ্রামের ফিশারিঘাটে মাছ নিয়ে আসা বেশ কয়েকজন জেলে এবং মাঝির বক্তব্যেও সামুদ্রিক মাছের সংকটের কথা শোনা গেল।

৩৫ বছর ধরে সমুদ্রে মাছ ধরার সঙ্গে যুক্ত জসিম মাঝির পরিষ্কার জবাব, এখন আর আগের মতো মাছ নেই। আগে যেখানে দুই তিন ঘণ্টা নৌকা চালিয়ে গিয়ে মাছ ধরতে পারতেন এখন সেই মাছ ধরতে ১৮-২০ ঘণ্টা চালিয়ে সাগরের গভীরে যেতে হয়।

তিনি বলেন, 'মাছের যত জাত আছে, আইল্যা মাছ টাছ সব মাছ কইম্যা গেছে। আগে পাইতাম এহন পাওয়া যায় না। এখন ইলিশ ছাড়া আর কোনো মাছ সেরকম পাওয়া যায় না।'

ছোট ট্রলারের জেলেদের অভিযোগ বড় ট্রলার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাছের পরিমাণও কমে গেছে।

এক্ষেত্রে মাছ ধরার পদ্ধতি নিয়েও উদ্বেগ জানান তারা।

জেলেদের অভিযোগ, বড় নৌযানগুলোর জালে ছোট বড় নির্বিশেষে সব মাছই আটকা পড়ে অনেক মাছের অকাল মৃতু্য ঘটে।

আরেকজন মাঝি বলেছেন, যেসব মাছ বাজারে বেচা যাইবো না বা আনা সম্ভব হইবো না সেগুলা আনে না। বড়গুলা আনে আর সব সাগরে ফালায় দেয়।

মাঝারি আকারের ইন্ডাস্ট্রিয়াল নৌযানে মৎস্য শিকারের সঙ্গে যুক্তরা আবার অত্যাধুনিক মাছধরা জাহাজের শিকারিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন।

ছোনার প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছের সুনির্দিষ্ট অবস্থান জেনে নির্বিচারে মাছ শিকার করা হয় বলেই তাদের অভিযোগ।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল নৌযানে মাছ শিকারের যে জাল সেটিরও নির্ধারিত মাপ আছে কিন্তু সেটি কতটা মানা হচ্ছে সে প্রশ্নও তোলেন অনেকে।

সামুদ্রিক সাদা বা বড় মাছ এবং চিংড়ি মাছ ধরার জন্য জালের ম্যাশ সাইজ যথাক্রমে ৬০ মিলিমিটার ও ৪৫ মিলিমিটার নির্ধারিত থাকলেও অনেকেই এটি মেনে চলেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল মাছ ধরা নৌযানের নিবন্ধিত সংখ্যা ২৫১টি। গত ৫ বছরে ৩৯টি নতুন মাছ ধরা আধুনিক নৌযান মাছ শিকারে যুক্ত হয়েছে।

নৌ-বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন মো. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বলেন, সাগরে মাছের মজুদ সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নৌযানের সংখ্যা বাড়ানো বিপক্ষে তারা।

তিনি আরও বলেন, যতদিন পর্যন্ত মাছের মজুদ এবং পরিমাণ সম্পর্কে রিপোর্ট না পাচ্ছি আমাদেরকে নৌযানের এ সংখ্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। তা নাহলে আমাদের এই ফিশিং সেক্টর এবং আমাদের যে চারটা ফিশিং গ্রাউন্ড আছে সেগুলো মাছশূন্য হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।

প্রতিবেশী দেশের নৌযানের অনুপ্রবেশ

বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানায় মৎস্য আহরণে প্রতিবেশী দুটি দেশের নৌযানের অবৈধ অনুপ্রবেশ একটা নিয়মিত সমস্যা বলে জানান স্থানীয় জেলেরা।

বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড এবং নৌ বাহিনীর প্রতিবেশী দেশের মাছধরা নৌযান আটকের বহু নজির রয়েছে।

গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা বলেন, বাংলাদেশি সমুদ্রসীমায় প্রায়ই ভারত ও মিয়ানমারের মাছ ধরা ট্রলার ঢুকে পড়ছে। এমনকি বাংলাদেশের সীমানায় মাছধরা নিষিদ্ধ থাকাকালীন সময়েও তাদের উপস্থিতি বেড়ে যায় বলেই অনেকে বলেছেন।

বাংলাদেশি নৌযানের মৎসজীবীদের অভিযোগ, যে হারে বিদেশি নৌযান বাংলাদেশের সীমানায় অবৈধ মাছ শিকার করে সে তুলনায় বিদেশি জাহাজ আটক হয় খুবই কম।

সাগরে ৩০ বছর মাছ ধরার সঙ্গে যুক্ত হুমায়ুন কবীর বলেন, দক্ষিণ দিকে সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ অংশে মিয়ানমার এবং পশ্চিমে চালনার দিকে ভারতীয় জাহাজ প্রায়ই অবৈধ মাছ শিকার করে।

অনেক সময় একাধিক জাহাজ নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতীয় জাহাজ সাগরে মাছ ধরতে আসে বলেও তাদের নজরে পড়ে।

তিনি আরও বলেন, লাক্ষা মাছ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ও মূল্যবান মাছ এবং এই মাছটি মারাত্মকভাবে আহরিত হয়ে প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। এছাড়া চিংড়ি মাছের বহু প্রজাতিও হুমকির মুখে। আমরা গবেষণা করছি কিন্তু আরও বিস্তারিত গবেষণা ছাড়া চূড়ান্ত মূল্যায়ন সম্ভব নয়। তাই পূর্ণাঙ্গ গবেষণা এবং মজুদ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদকে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই করার জন্য মাছ ধরা ট্রলার ও নৌযান সীমিত করা এবং ক্যাচ কন্ট্রোল পদ্ধতি প্রয়োগ করা জরুরি।

দেশের মৎস্য বিভাগ দীর্ঘমেয়াদে সাগরে মাছের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সংরক্ষণ কার্যক্রম নিয়েছে। সাগরে মাছ ধরা বন্ধ মৌসুম, মেরিন রিজার্ভ এলাকা ও সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে।

গবেষকরা বলেন, ইলিশকে টার্গেট করে যেভাবে সাফল্য এসেছে সামুদ্রিক অন্যান্য মূল্যবান অর্থকরী মাছের ক্ষেত্রেও আলাদা করে সুনির্দিষ্ট কৌশল পরিকল্পনা করা দরকার। বিবিসি বাংলা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<88784 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1