শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আস্থা-অনাস্থার দোলাচলে ইভিএম

ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন
যাযাদি রিপোর্ট
  ২৫ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
ইভিএম মেশিনে ভোট দিচ্ছেন এক ভোটার -ফাইল ছবি

সপ্তাহ পার হলেই ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। তবুও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে। ইতিমধ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ইভিএমে আস্থা আছে, বিএনপির নেই। বিএনপির আশঙ্কা, ইভিএমে ডিজিটাল কারচুপি হবে।

ইসি বলছে, ত্রম্নটিমুক্ত নির্বাচন করতেই ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে অনিয়ম ও কারচুপি কমবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইভিএমে কারচুপির সুযোগ একেবারেই যে নেই তা নয়। তবে এটি 'হ্যাক' করার সুযোগ নেই। প্রচলিত অনিয়ম, কারচুপির সুযোগও কম। ইভিএম নিয়ে বিভিন্ন মহলে যে সংশয় তা ইসিকেই দূর করতে হবে।

বিএনপি মনে করে, দুটি জায়গায় ইভিএমে ভোট কারচুপি সম্ভব। প্রথমত, ভোটারের আঙুলের ছাপ না মিললে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিজের আঙুলের ছাপে ভোটারকে ভোট দেওয়ার সুযোগ দিতে পারেন। এভাবে ২৫ শতাংশ ভোটারকে কর্মকর্তা সুযোগ দিতে পারেন। এখানে কারচুপি হতে পারে। তবে ইসি বলছে, এবার সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার এই ক্ষমতা কমিয়ে ৫ শতাংশের মধ্যে আনা হবে।

বিএনপির দ্বিতীয় শঙ্কার বিষয় হলো, ইভিএমে বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করে ফল পরিবর্তন সম্ভব। কারণ ইভিএমে ভোটার ভ্যারিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি নেই। অর্থাৎ যন্ত্রে ভোট দেওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে তার প্রিন্ট কপি ব্যালট জমা হওয়ার সুযোগ নেই। তাই কারচুপি হলে তা প্রমাণ করা যাবে না। তবে ইসি বলছে, এ ধরনের সন্দেহ থাকলে যে কেউ বিশেষজ্ঞ এনে ইভিএম পরীক্ষা করতে পারেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দীন খান বলেন, ইভিএম নিয়ে কারও কারও আপত্তি আছে। সবার সঙ্গে আলোচনা করে ইভিএমে ভোট করলে ভালো হতো। দুই সিটিতে পুরোপুরি না করে আংশিক ইভিএমে ভোট করা যেত। রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের আস্থায় আনার চেষ্টা করেনি ইসি। তাই ইভিএম ভোট নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে।

ইভিএমের প্রচলন শুরু করেছিল শামসুল হুদা কমিশন। ২০১২ সালে প্রথম কুমিলস্না সিটি করপোরেশনের ভোট পুরোপুরি ইভিএমে হয়েছিল। বর্তমান কমিশনের অধীনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকার দুটিসহ মোট ছয়টি সংসদীয় আসনে ইভিএমে ভোট হয়েছিল। সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৮০ শতাংশ। তবে ইভিএমের ছয়টি আসনে ভোটের হার ছিল গড়ে ৫১ দশমিক ৪১ শতাংশ।

এর আগে-পরে সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে আংশিকভাবে ইভিএম ব্যবহৃত হয়। পৌরসভা নির্বাচনে বেশির ভাগ সদর পৌরসভায় ভোট নেওয়া হয় ইভিএমে। রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচন হয়েছিল ইভিএমে। তারপরও ইভিএম নিয়ে আস্থার সংকট কাটেনি। বিএনপি দুই সিটি নির্বাচনে অংশ নিলেও ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ইভিএমের বিরোধিতা করছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ইসি এবং ইভিএম নিয়ন্ত্রণ করবে যারা, তাদের ওপরই মানুষের আস্থা নেই। ইভিএমে কারসাজি করা সহজ। ইভিএমে এমন সফটওয়্যার ঢোকানো সম্ভব, যাতে এক মার্কায় ভোট দিলে তা অন্যদিকে যাবে। এছাড়া আঙুলের ছাপ না মিললেও ২৫ শতাংশ ভোটারকে ভোট দেওয়ার সুযোগ দিতে পারেন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা। ইভিএম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ভারতেও এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন ইভিএম নিয়ে মতৈক্য হয়নি, তেমনি ভোটারদের বেশির ভাগ এখন পর্যন্ত ইভিএমের সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত নন। বিএনপির মতো সিপিবিও ইভিএম নিয়ে শঙ্কায় আছে। ঢাকা উত্তরে দলটির মেয়র পদপ্রার্থী সাজেদুল হক রুবেল বলেন, ইভিএমে ডিজিটাল কারচুপি বা প্রোগ্রামিং করে জালিয়াতি করার আশঙ্কা আছে।

ইসি বলছে, ইভিএমে ইন্টারনেটের কোনো সংযোগ নেই। ফলে হ্যাকিংয়ের সুযোগ নেই। আঙুলের ছাপ বা স্মার্ট কার্ড বা ভোটার নম্বর বা জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দিয়ে ভোটার শনাক্ত করা হবে। ভোটারের ছবি পোলিং এজেন্টরা দেখতে পাবেন। তাই জাল ভোট, ভোটকেন্দ্র দখল করে ভোট দেওয়া, একজনের ভোট অন্যজন দেওয়া বা একাধিকবার ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। অনুমোদিত কর্মকর্তা ছাড়া অন্য কারও পক্ষে ইভিএম চালু করা সম্ভব নয়। এক ভোট কক্ষের জন্য নির্দিষ্ট করা ইভিএম অন্য কোথাও ব্যবহার করার সুযোগ নেই।

নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, ইভিএমে ভোট হলে প্রচলিত অনিয়ম ও কারসাজি অনেক কমে যাবে। যন্ত্রে কোনো সমস্যা থাকলে বা কারসাজি হওয়ার আশঙ্কা থাকলে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে যেকোনো দল ইভিএম যাচাই করতে পারবে। সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার হাতে এবার ৫ শতাংশের বেশি ভোটারকে 'অথরাইজ' করার সুযোগ দেওয়া হবে না। ভোট শুরু হওয়ার আগে সব প্রার্থীর এজেন্টদের মেশিন ঠিক আছে কি না দেখানো হবে। পোলিং এজেন্ট থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আস্থা রাখতে হবে।

ইভিএম নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক থাকলেও ইসি এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অবশ্য ইসির সংলাপে ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশ নিয়েছিল। তখন বিএনপিসহ ১২টি দল ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দেয়। আওয়ামী লীগসহ সাতটি দল ইভিএমের পক্ষে ছিল।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, বিএনপি নিজেরাই বলছে, তারা এ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। সুতরাং তারা ইভিএম নিয়ে নানা কথা বলবে। সন্দেহ থাকলে তারা ইসিতে গিয়ে ইভিএম পরীক্ষা করে দেখতে পারে। কোনো ত্রম্নটি পেলে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করতে পারে। কিন্তু তা না করে ঢালাওভাবে অভিযোগ করে যাচ্ছে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। কারণ তারা জানে, তাদের জয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই।

নতুন ইভিএম পর্যালোচনার জন্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে উপদেষ্টা করে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করেছিল ইসি। ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর এই কমিটি ইভিএমে ভিভিপিএটি যুক্ত করার সুপারিশ করলেও তা রাখা হয়নি। এই সুবিধা থাকলে ভোটারদের আস্থা বাড়ত।

এ ব্যাপারে জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ইভিএমে কারচুপির সম্ভাবনা কম। ইভিএম তৈরির সময় প্রোগ্রামিং বদলানো সম্ভব। কিন্তু বুথে পৌঁছানোর পর ইভিএমে কারসাজি করার সুযোগ নেই। তার মতে, ভিভিপিএটি থাকলে ভালো হতো। কারণ পুনর্গণনার প্রশ্ন এলে ভিভিপিএটি ছাড়া পুনর্গণনা অর্থহীন।

ইসি সূত্র জানায়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি মিলিয়ে প্রায় ২ হাজার ৬০০ কেন্দ্রে ১৪ হাজার ৬০০ বা তার বেশি ভোটকক্ষ থাকবে। দুই সিটির নির্বাচনে ৩৫ হাজারের মতো ইভিএম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কারিগরি সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রতিটি কেন্দ্রে সশস্ত্র বাহিনীর দুজন করে সদস্য মোতায়েন থাকবেন। কারিগরি ব্যবস্থাপনায় সশস্ত্র বাহিনীর ৫ হাজার ২৮০ সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। ভোটের আগে ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি প্রতিটি কেন্দ্র ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ইভিএমে ভোট নিয়ে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হবে। ২৮ জানুয়ারি চূড়ান্ত 'মক ভোটিং' অনুষ্ঠিত হবে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন ইভিএমের পক্ষে মত দেন। তিনি বলেন, এতে প্রকৃত ভোটার ছাড়া অন্য কারও ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। রাতেও ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। ভোটের হার কম-বেশি করার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য ডাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সন্দেহ দূর করা ইসির কাজ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<85804 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1