'কাকি আমারে মুরগির জন্য পুড়ায় দেছে। মুরগি বারান্দায় ছিল। বারান্দা থেকে মুরগি হারায় গেছে আর দোষ পড়ছে আমার ওপর। সবাইরে কইছে, আমি মুরগি মাইরা ফালায় দিছি। এরপর কাকি আমারে মারছে। হাত বাইন্দা, মুখে টেপ মাইরা তারপর খুন্তি গরম কইরা গায়ে ছ্যাক দেছে। পরে মরিচ লাগাই দেছে। যহন রক্ত বাইর হইছে তহন সবাইরে কইতে কইছে, ফোড়া হইছে। তা না অইলে আবার ছ্যাক দেবে।' গণমাধ্যমকে এভাবেই নিজের ওপর চলা নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছিল শিশু গৃহকর্মী মালা (১০)। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে এখন তার চিকিৎসা চলছে। বার্ন ইউনিটের এক নার্সের বিরুদ্ধে এ নির্যাতনের অভিযোগ। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, নির্যাতনে শিশুটির শরীরের ৫ শতাংশ পুড়ে গেছে।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী কুতুবখালীর একটি বাসায় শিশুটির ওপর এ নির্যাতন চালানো হয়। ওই বাসার গৃহকর্ত্রী দিলারা ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের নার্স। তার স্বামীর নাম রাজিব।
মালার স্বজনরা জানায়, পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার হাজিরা গ্রামের জেলে রমিজ মিয়া ও গৃহিণী কল্পনা আক্তারের মেয়ে মালা। ২ হাজার টাকা বেতনে ২ বছর আগে ওই বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজে যোগ দেয় মালা। নির্যাতনের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার দুই নম্বর আসামি গৃহকর্তা রাজিবকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের তৃতীয় তলার শিশু বিভাগে ভর্তি মালা জানায়, দিলারার ছোট ছোট ২টি ছেলে রয়েছে। তাদেরই দেখাশোনা করত সে। গৃহকর্তা রাজিব মাছের আড়তে ব্যবসা করেন। এর আগেও কোনো ছোটখাটো ভুল হলেই বিভিন্ন সময় নার্স দিলারা তাকে মারধর করত। চড় থাপ্পড় এমনকি লাঠি দিয়েও পেটাত। ১০-১২ দিন আগে দিলারার বাবা ২টি দেশি মুরগি এনে দিয়ে যায় তাদের বাসায়। এরপর একটি মুরগি তারা রান্না করে। আর একটি বাসার বারান্দায় ঝাঁপির ভেতরে আটকে রাখে। এরপর কোনো এক সময় মুরগিটি হারিয়ে যায়। পরে বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেও মুরগিটি পাওয়া যায়নি।
মালা জানায়, কেউ একজন নার্স দিলারাকে বলে সে মুরগিটি ছেড়ে দিয়েছে। এই কথার ভিত্তিতে গত ১০ জানুয়ারি রাতে যখন রাজিব বাসার বাইরে, বাচ্চারা রুমে টিভি দেখছে তখন পাশের আরেকটি রুমে নিয়ে যায় মালাকে। এরপর রশি দিয়ে তার দুই হাত পেছনে নিয়ে শক্ত করে বাঁধে, আর হাসপাতালে রোগীদের জন্য ব্যবহূত মাইক্রোপোন (স্কস্টেপ) দিয়ে তার মুখ আটকে দেয়, যাতে সে চিৎকার করতে না পারে। এরপর রান্না ঘর থেকে রুটি ভাজার খুন্তি গরম করে এনে তার পশ্চাদাংশে ও পায়ের সামনের রানে ছ্যাকা দেয়। এতেও ক্ষান্ত হননি দিলারা। দগ্ধ ঘায়ে ঘঁষে দেয় মরিচ।
শিশুর খালা সোমা আক্তার জানান, নির্যাতনের ঘটনার কথা দিলারা কাউকে জানাতে নিষেধ করেন। এমনকি গৃহকর্তা রাজিবকেও বলতে নিষেধ করেন। কাউকে বললে তাকে আরও নির্যাতন করা হবে বলে হুমকি দেয়। তাকে কোনো ধরনের চিকিৎসা না দিয়ে কাজ করানো অব্যাহত রাখেন দিলারা। শুক্রবার সকালে বাসা থেকে পালায় মালা।
এ বিষয়ে মালা বলে, 'শুক্রবার সকালবেলা কাকি আমারে অনেক লাইত্থাইছিল, জুতা দিয়ে পিডাইছিল। তারপর আমারে পান আনতে পাঠাইছিল। পান আনতে যাইয়া আমি বাইর হইয়া আইসা পড়ছি।' সে জানায়, সুযোগে সে পালিয়ে দনিয়া ক্লাব এলাকায় এক কাকার বাসায় গিয়ে উঠে। তারাও পায়জামা খুলতে পারছিল না, ঘায়ের সাথে পায়জামা একেবারে আটকে গিয়েছিল। পরে তারাই যাত্রাবাড়ী থানায় জানালে বিকালে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে প্রথমে থানায় নিয়ে যায়। পরে রাত ৩টার দিকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহীনুর রহমান বলেন, শিশুটির খালা সুমা বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করার পর গৃহকর্তা রাজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পলাতক থাকায় দিলারাকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। তিনি জানান, গ্রেপ্তারকৃত আসামিকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।