বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
গোয়েন্দা প্রতিবেদন-২

কোটিপতি ৪২ মাদক ব্যবসায়ী

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে পর্যাপ্ত জনবল ও আনুষঙ্গিক সাপোর্ট না থাকায় তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে না তবে অভিযান অব্যাহত রয়েছে
তানভীর হাসান
  ১৮ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
আপডেট  : ১৮ জানুয়ারি ২০২০, ০০:১১
ইয়াবা

মো. ইসতিয়াক ওরফে কামরুল হাসান। ৫ বছর আগেও মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের খুচরা মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। এখন অবস্থান পালটে তিনি ইয়াবার পাইকারি ব্যবসায়ী। মাদক বিক্রির টাকায় তিনি মালয়েশিয়াতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়েছেন। আশুলিয়া ও সাভারে বানিয়েছেন তিনটি বাড়ি। বংশালের নাছির উদ্দিন। চট্টগ্রাম সাতকাউনিয়ার এই বাসিন্দা এক সময় খালি হাতে রাজধানীতে এলেও তিনি পাইকারি ইয়াবা ব্যবসা করে এখন একটি ডেভেলপার কোম্পানির অংশীদার বনে গেছেন। রয়েছে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কানেকশনও। বিপদে পড়লে তারাই ঢাল হয়ে পাশে দাঁড়ান। শুধু ইসতিয়াক ও নাছির উদ্দিন নয়। এ ধরনের ৪৪ জন কোটিপতি মাদক ব্যবসায়ীর সন্ধান পেয়েছে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা। এদের মধ্যে দুইজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। বাকি ৪২ জনকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। গোয়েন্দাদের ধারণা এই কয়জনকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হলে, রাজধানীতে অনেকটাই মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি করা প্রতিবেদনের একটি কপি যায়যায়দিনের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমরা প্রতি ৩ মাস পরপর তালিকা তৈরি করি। এরপর ওই তালিকা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা থেকেও তালিকা তৈরি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই তালিকা ধরেও সমন্বয় করে কাজ করা হয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত কয়েকজনের নাম থাকতেই পারে।' জানা গেছে, রাজধানীতে মাদকের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার করা হয়। এর আগে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা করে সরকারের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা। ওই তালিকা অনুযায়ী অভিযান শুরু করা হয়। এতে অনেকেই গা-ঢাকা দেন। ধারণা করা হচ্ছে অভিযানের জোরদারের খবর আগেই ফাঁস হয়ে যাওয়ায় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। গোয়েন্দা সংস্থার ওই তালিকার এক নম্বরে দেখা গেছে মো. ইসতিয়াক ওরফে কামরুল হাসানের নাম। গত ৫ বছর আগেও মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের খুচরা মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। এখন তিনি ইয়াবার পাইকারি ব্যবসায়ী। মাদক বিক্রির টাকা তিনি মালয়েশিয়াতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দিয়েছেন। আশুলিয়ার ব্যারন বাসস্ট্যান্ড ও গাজীরচট মধ্যপাড়ার পুকুর রোডে ২টি ও সাভারের মাদ্রাসা রোডে একটি বাড়ি বানিয়েছেন। এ ছাড়া মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের বি বস্নকের ১৬২নং বাড়িটিও তার দখলে রয়েছে। মূলত জেনেভা ক্যাম্পের এই বাড়িটি তিনি মাদক বিক্রিতে ব্যবহার করেন। আর মজুত রাখার কাজে আশুলিয়া ও সাভারের বাড়ি দুইটি ব্যবহার করা হয়। তালিকার দ্বিতীয় নম্বরে থাকা একই ক্যাম্পের মাদক ব্যবসায়ী মো. নাদিম বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলেও ইসতিয়াক রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তালিকার তৃতীয় নম্বরে রয়েছে উত্তরার ফজলুল করিম। তার মূল ব্যবসা ইয়াবা ও লুপিজেসিক ইনজেকশন। উত্তরা-পশ্চিমসহ বিভিন্ন থানায় তার নামে একাধিক মামলা রয়েছে। মাদক ব্যবসা করে তিনি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা রেখেছেন। এ ছাড়া বাড্ডা এলাকার রিয়াদউদ্দিন রয়েছে ইয়াবা ডিলারের তালিকায়। বংশালের নাছিরউদ্দিন ইয়াবা বিক্রি করে পুষ্পধারা নামে একটি ডেভেলপার কোম্পানির পার্টনার বনে গেছেন। ইয়াবা ডিলারের তালিকায় মো. ছাব্বির হোসেন ওরফে সোনা মিয়া। টেকনাফের এই বাসিন্দার নামে ভাটারা থানায় মামলা রয়েছে। মূলত তিনি ভাসমান ইয়াবার ডিলার। ইয়াবার ব্যবসা করে হাতিরপুলে রেইন বার্ড নামে একটি স্যানিটারি দোকান ও এলিফ্যান্ট রোডে একটি ফ্ল্যাটের মালিক বনে গেছেন আসমা আহম্মেদ ডালিয়া ও রবিউল ইসলাম দম্পতি। মাদক মামলার আসামি রবিউল ইসলাম বর্তমানে জেলে অবস্থান করলেও কয়েক দিন আগে ডালিয়া মুক্তি পেয়েছেন। সানারপাড়া সিদ্ধিরগঞ্জের ভাড়াটিয়া কামাল হোসেন গাঁজার পাইকারি ব্যবসায়ী। তার নামে ওয়ারি থানায় মাদক মামলা রয়েছে। চলমান অভিযানের পর বি.বাড়িয়ার বিজয়নগরের এই বাসিন্দা গা-ঢাকা দিয়েছেন। তালিকায় দেখা গেছে, নোয়াখালী জেলার নেয়াজপুর ইউনিয়নের করিমপুরের বাসিন্দা মোবারক হোসেন বাবু। তার মূল ব্যবসা ইয়াবার ডিলার। মাদকের টাকায় তিনি যাত্রাবাড়ীর দনিয়ায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। ইয়াবা ডিলারে তালিকায় রয়েছে টাঙ্গাইলের আনোয়ারা ওরফে আনু। তিনি ভাটারা এলাকায় ব্যবসা করেন। এই এলাকার নারগিস ওরফে সকার বউও ইয়াবা ডিলারের তালিকায়। তাদের নামে ভাটারা থানায় মামলা রয়েছে। বেনাপোলের কাগজপুকুর এলাকার শামীম আহম্মেদ পাখানী তার বাবা শাসসুর রহমান পাখানি ও তার স্ত্রী ফারজানা ইসলাম স্বপ্না রয়েছেন ইয়াবা ও হেরোইন ব্যবসায়ীর শীর্ষ তালিকায়। তারা বর্তমান উত্তর ধানমন্ডির কলাবাগানের একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বসবাস করেন। গেন্ডারিয়ার রহিমা বেগমের মূল ব্যবসা হেরোইন, ইয়াবা ও লুপিজেসিন ইনজেকশন। মুগদার পারভীন, উত্তর মান্ডার শফিকুল ইসলাম, দক্ষিণ মান্ডার আলম, ডেমরার রাজু আহমেদ, মতিঝিলের লিটন, চকবাজারের দুই ভাই ওমর ফারুক-সুমন, একই এলাকার লাল মিয়া, কলাবাগানের নাজমুস সাকিব, কামরাঙ্গীরচরের খুরসিদা ওরফে খুশী, রয়েছেন ইয়াবা ডিলার ও গাজার পাইকারি ব্যবসায়ীর তালিকায়। তারা দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা করে কোটিপতি বনে গেছেন। জোয়ারসাহারা এলাকায় ইয়াবা পাইকারি ব্যবসার তালিকায় রয়েছে, ইতি বেগম। সহযোগী হিসেবে কাজ করেন তার মা ফিরোজা, মেয়ে এ্যানি ও ছেলে প্রমি। উত্তর বাড্ডার শরিফ ভূইয়া, উত্তরা পশ্চিম এলাকার এনায়েতুল করিম, উত্তরা ৫নং সেক্টরের গোলাম সামদানি ও শাহাবাগের আনন্দবাজার এলাকার শামীম শিকদারও রয়েছে ইয়াবা পাইকারি ব্যবসায়ীর তালিকায়। মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের শহীদুজ্জামান ওরফে নাভিদ ফেনসিডিলের পাইকারি ব্যবসায়ী। আর নাজিমউদ্দিন রোডের পারভীন আক্তার, নীমতলির নার্গিস আক্তার ও বংশালের কাশেমের মূল ব্যবসা নেশা জাতীয় ইনজেকশন বিক্রি করা। ইয়াবার-হেরোইনের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীর তালিকায় রয়েছেন, বংশালের গোলকপাল লেনের মো. সেলিম, কারওয়ান বাজারের মিনা বেগম, কারওয়ান বাজার রেল লাইন বস্তির মাহমুদা খাতুন, একই বস্তির মরিয়ম, মহাখালী ওয়ারলেস এলাকার রিমন সরদার ও দক্ষিণ বাড্ডার আক্কাস আলী, জুরাইনের ওয়াসা রোডের বাপ্পা, হাজির মাজার বস্তির বাচ্চু মিয়া, নূরেরচালার ফতেহ, মিরপুর-২, স্টেডিয়াম কমার্স কলেজ ও চিড়িয়াখানা এলাকায় দুলাল ওরফে বাদল এবং পীরেরবাগ আমতলা এলাকার সজীব ওরফে কবিরাজের নাম। এ ছাড়া গুলশান, বনানী, ভাটারা ও বাড্ডা এলাকায় বিদেশি মদ বিয়ার ও ইয়াবার ব্যবসা করে হুমায়ন কবির ওরফে কবির গাজী। বসবাস করেন গুলশান ২নং এলাকার অভিজাত ফ্ল্যাটে। দামি গাড়িতে করে তিনি এই ব্যবসা করে আসছেন। চলমান অভিযানের পর তিনিও গা-ঢাকা দিয়েছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত বছরের শেষের দিতে ওই প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর সেখান থেকে অপর একটি গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে যাচাই-বাছাই শেষে আবারও তালিকাটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে পাঠানো হয়। পাশাপাশি ওই তালিকা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে সরকারের অন্য সংস্থাগুলোকেও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পর্যাপ্ত জনবল ও আনুষঙ্গিক সাপোর্ট না থাকার কারণে তাদের গ্রেপ্তার সম্ভব। তবে তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে