শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে ব্যাংকগুলোর অনীহা

আহমেদ তোফায়েল
  ১৬ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

শেয়ারবাজারে ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে নীতিমালা শিথিল করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বলা হয়েছিল, টাকার সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো তাদের হাতে থাকা ট্রেজারি বিল ও বন্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে (রেপো) অর্থের সংস্থান করতে পারবে। ওই অর্থ দিয়ে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব পোর্টফোলিওতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে। কিন্তু নীতিমালা শিথিলের সাড়ে তিন মাস পার হলেও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংকগুলোর কোনো সাড়া মিলছে না। এ সময়ে মাত্র একটি ব্যাংক ৫০ কোটি টাকার সুবিধা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে। তাই পড়ন্ত পুঁজিবাজার চাঙ্গা করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগ কোনো কাজে আসছে না।

এ বিষয়ে দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি গতকাল যায়যায়দিনকে জানিয়েছেন, পুঁজিবাজারের পতন ঠেকানোর দায়িত্ব ব্যাংকগুলোর নয়। ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধ রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে আর শেয়ারের দাম আরও কমে গেলে এর দায়-দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংক নেবে না। এটি ব্যাংকগুলোকেই বহন করতে হবে। আর সাধারণ আমানতকারীদের অর্থ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এ খাতে একজন সচেতন ব্যাংকার বিনিয়োগ করতে পারে না। পুঁজিবাজারের দরপতন ঠেকানো না গেলে ব্যাংকগুলোর লোকসান আরও বেড়ে যাবে। আর লোকসান বাড়লে ব্যাংকগুলোর মুনাফা দিয়ে তা প্রভিশন করতে হবে। এতে ব্যাংকের নিট আয় কমে যাবে। যার দায়ভার ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকেই বহন করতে হয়। এ কারণে জেনেশুনে ব্যাংকগুলো এখনই এ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত দেড় বছরে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অন্যতম উদ্যোগ ছিল ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থের সংস্থান করা। এর আগে ঋণ আমানতের অনুপাত সাড়ে ৮৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮৫ শতাংশ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব ৯২ হাজার কোটি টাকার ট্রেজারি বিল ও বন্ড রয়েছে। এ থেকে ব্যাংকগুলো প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ধার নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারত।

বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকগুলো তাদের মোট মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করতে পারবে না, এমন বিধান আগেই দেওয়া রয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত প্রায় ২৩টি ব্যাংকের পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ ২৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারের বিনিয়োগসীমা ২৫ শতাংশে আনতে গেলে আলোচ্য ব্যাংকগুলো প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারবে।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গত ২২ সেপ্টেম্বর এক সার্কুলার জারি করা হয়। ওই সার্কুলারে বিনিয়োগসীমা যাদের ২৫ শতাংশ নিচে রয়েছে তাদের রেপোর মাধ্যমে (ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে) বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে থেকে ধার নেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রথমে ২৮ দিনের জন্য, পরে তা বাড়িয়ে ছয় মাস পর্যন্ত এ ধার নিতে পারবে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগ ব্যাংকগুলো সাড়া দেয়নি। সার্কুলার জারির সাড়ে তিন মাস পার হলেও গতকাল পর্যন্ত মাত্র একটি ব্যাংক এ সুযোগ নিয়েছে। বেসরকারি খাতের দি সিটি ব্যাংক তারা নিজস্ব পোর্টফোলিওর মাধ্যমে ৩০ কোটি টাকা এবং তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপোর মাধ্যমে ধার নিয়েছে।

এ বিষয়ে এমটিবি ক্যাপিটালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খায়রুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদ বলেন, লাভের কোনো নিশ্চয়তা নেই, তাই ব্যাংকগুলো তাতে সাড়া দেয়নি।

বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের পস্নাটফর্ম, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারসের চেয়ারম্যান আলী রেজা ইফতেখার বলেন, সম্ভবত ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করবে না।

বর্তমানে দেশে ব্যাংকের সংখ্যা ৬২টি। কিন্তু কার্যক্রম চালু থাকা ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে সরকারি ব্যাংক ছয়টি, বিশেষায়িত ব্যাংক দুটি, বিদেশি ৯টি, বেসরকারি ৩২টি আর ইসলামী ব্যাংক আটটি। বাকি পাঁচটি ব্যাংক অনুমোদন পেলেও এখনো কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। সর্বশেষ ১৭ ফেব্রম্নয়ারি তিনটি ব্যাংককে অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্র জানায়, দেশে ব্যাংকের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়লেও পুঁজিবাজারে আসার প্রবণতা খুবই কম। যদিও পুঁজিবাজারে ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগকারীর আস্থা অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় বেশি। কারণ হিসেবে জানা যায়, বছর শেষে ব্যাংকগুলো নূ্যনতম ১০ শতাংশ বা কোনো কোনো ব্যাংক ১৫-২০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়ে থাকে। ব্যাংকে বর্তমানে সুদ হার কম হওয়ায় বছর শেষে আমানতকারী ৫-৬ শতাংশ মুনাফা পায়।

জানা যায়, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে পুঁজিবাজারে ৩০টি ব্যাংক তালিকাভুক্ত রয়েছে। এ ব্যাংকের মধ্যে মাত্র দুটি সরকারি ব্যাংক, এখনো সরকারি ও বিশেষায়িত মিলে ছয়টি ব্যাংক পুঁজিবাজারে আসেনি। সর্বশেষ ২০০৮ সালে একটি মাত্র ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়, অর্থাৎ এ সময়ের পর গত ১১ বছরে আর কোনো ব্যাংক পুঁজিবাজারে আসেনি। ২০০৭ সালে চারটি, ২০০৬ সালে একটি, ২০০৪ সালে তিনটি, ২০০১ সালে একটি, ২০০০ সালে পাঁচটি ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বাকি ১২টি ব্যাংক আশি ও নব্বইয়ের দশকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে।

এদিকে শেয়ারবাজারে আবার বড় দরপতন হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সপ্তাহের তৃতীয় কার্যদিবসে লেনদেন শেষে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৮৭ পয়েন্ট। নেমে এসেছে ৪ হাজার ৩৬ পয়েন্টে। ফলে ভিত্তি পয়েন্টের নিচে নেমে গেল সূচকটি। অন্যদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে সার্বিক সূচক সিএএসপিআই কমেছে ২৭৫ পয়েন্ট।

গত এক বছরের ব্যবধানে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন কমেছে এক লাখ কোটি টাকা। গত বছরের ১৪ জানুয়ারি ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ ১৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। আর গতকাল দিন শেষে তা নেমে এসেছে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকায়।

বাজার বিশ্লেষকরা বলেন, বাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতাই পতনের মূল কারণ। সরকারের নানা আশ্বাসে ভরসা পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। শেয়ারবাজার ভালো হবে, হচ্ছে এমন প্রতিশ্রম্নতি শুনে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী বাজারে বিনিয়োগ করে এখন প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<84556 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1