শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকার সিটি নির্বাচন

প্রার্থীরা সরব, নীরব ভোটাররা

সাখাওয়াত হোসেন
  ১৬ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

ঢাকার দুই সিটিতে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রচারণাযুদ্ধে ভোটের মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও ভোটারের তাতে সাড়া নেই। বিশেষ করে দল নিরপেক্ষ সাধারণ ভোটাররা এ ইসু্যতে অনেকটাই নীরব ভূমিকা পালন করছেন। এমনকি ভোটের দিন তারা ভোটকেন্দ্রে যাবেন কিনা তা নিয়েও অনেকে সংশয়ে রয়েছেন। এ অবস্থায় ভোটের দিন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি উদ্বেগজনক হারে কম হবে বলে আশঙ্কা করছেন অভিজ্ঞ রাজনীতিকরা।

ভোটের মাঠ পর্যবেক্ষণকারীরা জানান, তীব্র শীত উপেক্ষা করে কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত অবদি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মেয়র-কাউন্সিলর প্রার্থীরা ভোট প্রার্থনায় ভোটারের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন। দীর্ঘ দড়িতে পোস্টার ঝুলিয়ে রাজধানীর অলি-গলি রাজপথ সব জায়গা রাতারাতি ছেয়ে ফেলেছেন। দিনভর চলছে মাইকিং, মিছিল, শোভাযাত্রা, উঠান বৈঠক। প্রার্থীদের পক্ষ থেকে বাদ পড়েনি কোনো আয়োজনই। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে এসব কর্মকান্ডে যোগ দিয়েছে ভাড়াটে কর্মীরাও। সিটি ভোটকে ঘিরে রাজনীতির মাঠও এখন সরগরম। অথচ সবকিছুর পরও ভোটের মাঠে সাধারণ ভোটারের আগ্রহের কোনো প্রতিফলন নেই। লোক সমাগমের স্থানগুলোতে দৃশ্যমান হচ্ছে না ভোটের সরব আলোচনা। বরং ভোট নিয়ে জনমনে বিরাজ করছে নানামুখী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। নির্বাচনে যে প্রার্থীই জিতে জিতুক, ভালোয় ভালোয় যেন ভোট শেষ হয়, এমনটাই যেন এখন সাধারণ ভোটারদের চাওয়া- মনে করেন ভোটের মাঠের পর্যবেক্ষণকারীরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিপুল সংখ্যক ভোটারেরই গত জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে, ভোট দিতে না পারার তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। এর উপর চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে কেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দেওয়া, গোপন বুথে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীদের ভোটদান, ইভিএম মেশিনে একজনের ভোট আরেকজন দিয়ে দেওয়াসহ নানা অভিযোগের পাহাড় সাধারণ ভোটারদের আরও হতাশ করে তুলেছে। এ অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে যাওয়া-না যাওয়া সমান মনে করছেন অনেকেই।

এদিকে ভোটের আগে প্রচারণাযুদ্ধে বিএনপি দলীয় দুই মেয়র প্রার্থীর নানা অভিযোগ এবং তাতে নির্বাচন কমিশনের গা না দেওয়ায় ঘটনায় জনমনে নতুন করে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও তাদের সহযোগীরা প্রচারণার মাঠে নানা অনিয়ম করে পার পেয়ে গেলে, ভোটের দিন তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন অনেকেই।

প্রসঙ্গত, গত সোমবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিএনপি দলীয় মেয়রপ্রার্থী ইশরাক হোসেন নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে লেভেল পেস্নয়িং ফিল্ড তৈরিতে ব্যর্থতার অভিযোগ করে বলেন, 'লেভেল পেস্নয়িং ফিল্ড নয়, ভোট ডাকাতির ফিল্ড তৈরি করছে বর্তমান সরকার।' তিনি আরও বলেন, 'প্রতিপক্ষ কে তা নিয়ে উদ্বেগ নেই; উদ্বেগ নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে।'

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিএনপি মনোনীত মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়াল বলেন, 'আমাদের নির্বাচনী প্রচারে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। কাউন্সিলরদের নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর করা হয়েছে। ইসি এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।' তিনি আরও অভিযোগ করে বলেন, 'লেভেল পেস্নয়িং ফিল্ড নেই। তবুও নেতাকর্মীরা শান্ত আছে। তারা সব উসকানিই এড়িয়ে চলছে।'

এদিকে বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় বাধা দেওয়া, পোস্টার ছিড়ে ফেলা ও নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুরের অভিযোগ তুললেও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা উল্টো এ নিয়ে তির্যক মন্তব্য করছেন। উত্তরের আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী আতিকুল ইসলাম বলেছেন, 'আমরা যেমন প্রতিদিন সকালে নাস্তা-ব্যায়াম করি, তেমনি বিএনপির প্রার্থীও অভিযোগ না করে থাকতে পারেন না। তাদের একটাই অভিযোগ, লেভেল পেস্নয়িং ফিল্ড তৈরি হচ্ছে না।' এই মেয়র প্রার্থী দাবি করেন, তারা কাউকে নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা দিচ্ছেন না। যদিও তার এ দাবি সঠিক নয় বলে অভিযোগ করেছেন খোদ আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মতিঝিল এলাকার একটি ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জানান, দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে রাতদিন একাকার করে তিনি নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালালেও এতে ভোটারদের তেমন আগ্রহ দেখছেন না। বরং ভোটের প্রচারণা নিয়ে বিরক্ত অনেকেই। যদিও মুখ ফুটে কেউ তা বলতে সাহস না পাচ্ছে না। তবে তাদের আচার-আচরণে এর স্পষ্ট প্রমাণ মিলছে বলে জানান ওই বিদ্রোহীপ্রার্থী।

মাঠপর্যায়ের নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারীরা জানান, শুধু বিরোধীদলীয় কিংবা বিদ্রোহী প্রার্থীই নয়, খোদ ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরাও ভোটারদের কাছ থেকে আগের মতো তেমন সাড়া পাচ্ছেন না। বরং ভোটারদের কাছে ভোট চাইতে গেলে, ভোটাররা যে ধরনের নির্বিকার আচরণ করছেন, তাতে প্রার্থীরা অনেকে বিব্রত।

বিষয়টি স্বীকার করে আওয়ামী লীগের থানা পর্যায়ের একজন প্রবীণ নেতা জানান, প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর দল সমর্থিত একজন কাউন্সিলর প্রার্থীকে নিয়ে তিনি তার এলাকার কিছু আবাসিক অ্যাপার্টমেন্টে প্রচারণা চালাতে গিয়েছিলেন। সেখানে বেশিরভাগ ভোটারই তাদের কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। অনেকে তাদের অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে ঢুকতেও দেননি। দু'চারজন যাদের কাছে তারা পৌঁছাতে পেরেছেন, তারাও তাদেরকে ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। বরং তারা অধিকাংশই দায়সারা কথাবার্তা বলে তাদের বিদায় করেছেন।

প্রবীণ ওই নেতার ভাষ্য, 'নেহাৎ দলের স্বার্থে প্রচারণায় নেমেছিলাম। কিন্তু এতে সাধারণ মানুষের অনাগ্রহ এতটাই বেশি যে, প্রচারণাকারীদের সঙ্গে কেউ সামান্য ভদ্র ব্যবহার করছে না। তাই প্রচারণায় অংশ নেওয়া বাদ দিয়েছি।'

একই ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়ে বিএনপির ওয়ার্ড পর্যায়ের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, গত টার্মে ঢাকার দুই সিটিতে এবং জাতীয় নির্বাচনে প্রকাশ্য ভোট ডাকাতি হলেও, তাতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। এমনকি ভোটারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। দলীয় নেতারা ঘরে বসে থেকে সাধারণ ভোটারদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তাই এ ভোটে এখন ভোটারের কোনো আগ্রহ নেই। আর এ কারণেই কারো প্রচারণাতেই তারা কোনো সাড়া দিচ্ছে না।

ওই নেতাদের ভাষ্য, প্রচারণার মাঠে দৃশ্যমান উত্তাপ থাকলেও বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। প্রচারণাকারীদের বড় একটি অংশ ভাড়াটে। এছাড়া কর্মীরা নগদ কিছু টাকা পেয়ে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। আর নেতারা তাদের পদ-পদবি ধরে রাখতে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছেন। প্রার্থী ও তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছাড়া কারো কাছেই ভোটের ততটা গুরুত্ব নেই বলে মনে করেন তারা।

তাদের অনুমান যে একেবারে অমূলক নয়, তা বিভিন্ন দলীয় প্রার্থীর সঙ্গীয় প্রচারণাকারীদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের থানা পর্যায়ের একজন নেতা জানান, দলীয় মেয়রের পাশাপাশি কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাতে কেন্দ্র থেকে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জোরালোভাবে প্রচারণা না চালালে আগামীতে কমিটিতে পদ-পদবি দেওয়া হবে না বলেও হুশিয়ার করা হয়েছে। অথচ দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরুদ্ধে দখলবাজি, মাদকব্যবসা ও জুয়ার বোর্ড চালানোর বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তার পক্ষে ভোট চাইতে গেলে ভোটাররা নানা প্রশ্ন তুলে জনসম্মুখে বিব্রত করছেন। এমনকি নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। এ পরিস্থিতিতে তিনি কৌশলে শুধু মেয়রের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। সুযোগ পেলে এ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখছেন বলেও স্বীকার করেন ওই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের একজন ভোটার এ প্রতিবেদককে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের পর ভোটকে আর উৎসব বা আমেজ বলে মনে হয় না। কারণ ওই নির্বাচনের স্মৃতি কারো কাছেই ততটা সুখকর নয়। তাই এখন ভোট মানেই বাড়তি উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে গেলে হয়রানি-হামলার শঙ্কা। এ কারণে সাধারণ মানুষ ওই সব ঝক্কি ঝামেলাতে জড়াতে চায় না। এ নিয়ে তাদের বাড়তি কোনো আগ্রহ বা কৌতুহলও নেই। বরং নির্বাচনের দিনক্ষণ পেরোলেই যেন তারা হাফ ছেড়ে বাঁচেন।

এদিকে ভোট নিয়ে সাধারণ ভোটারের আগ্রহ অনেকটা শূন্যের কোটায় পৌঁছলেও এ নিয়ে কোনো উদ্বেগ নেই নির্বাচন কমিশনের। বরং ভোটকেন্দ্রে ভোটার আনা এবং ভোটে সাধারণ মানুষের আগ্রহ তৈরি দায়িত্ব রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর বলে এ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা দায় এড়িয়ে গেছেন। যা সাধারণ ভোটারদের আরও হতাশ করে তুলেছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<84552 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1