মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
জাতীয় শোক দিবস

রক্তঝরা অশ্রুভেজা ১৫ আগস্ট আজ

যাযাদি রিপোটর্
  ১৫ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০
আপডেট  : ১৫ আগস্ট ২০১৮, ০০:১২

কেঁদেছিল আকাশ, ফুঁপিয়ে ছিল বাতাস। বৃষ্টিতে নয়, ঝড়ে নয়- এ অনুভূতি ছিল পিতা হারানো শোকের। প্রকৃতি কেঁদেছিল; কারণ মানুষ কাঁদতে পারেনি। ঘাতকের উদ্ধত সঙ্গিন তাদের কঁাদতে দেয়নি। তবে ভয়াতর্ বাংলার প্রতিটি ঘর থেকে এসেছিল চাপা দীঘর্শ্বাস। কি নিষ্ঠুর, কি ভয়াল, কি ভয়ঙ্কর- সেই রাত। আজ রক্তঝরা অশ্রæভেজা ১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। বাঙালি জাতির শোকের দিন। ১৯৭৫ সালের এ দিন ভোরের আলো ফোটার আগেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে কিছু বিপথগামী সেনা। বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে জুড়ে দেয় কৃষ্ণদাগ। মানচিত্রের কঁাধে চাপিয়ে দেয় ইতিহাসের সবচেয়ে ভারী লাশের বোঝা। দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারী তথা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এদেশীয় দোসরদের চরম বিশ্বাসঘাতকতার কাছে জাতির জনকের বিশ্বাসের দৃঢ় প্রত্যয় ভেঙে পড়েছিল ১৫ আগস্টের সেই নৃশংস কালরাতে। বঙ্গবন্ধু ও তার স্বজনদের রক্তে সেদিন প্লাবিত হয় ধানমÐি ৩২ নম্বর সড়কের সেই ঐতিহাসিক বাড়ি। অস্তমিত হয়েছিল জাতীয় গৌরবের প্রতীক সূযের্র মতো অনন্য এক অধ্যায়। ১৫ আগস্ট সুবেহ সাদেকের সময় পবিত্র আজানের ধ্বনিকে বিদীণর্ করে ঘাতকের মেশিনগানের ঝাঁক ঝাঁক গুলি। ঝঁাঝরা হয়ে ওঠে স্বাধীন বাংলার বুক। শহীদ হন স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা, বাংলার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চক্রান্তকারী সেনা সদস্যরা সেদিন নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল তার সহধমির্ণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও ১০ বছরের শিশু শেখ রাসেল এবং বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে। তবে দেশের বাইরে থাকায় সেদিন বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে বতর্মান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। সেই কালরাতে আরও প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধুর কয়েকজন নিকটাত্মীয়। বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে গিয়ে ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিয়েছিলেন তার সামরিক সচিব জামিল উদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন নিরাপত্তা কমর্কতার্ ও কমর্চারী। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর গোটা বিশ্বে নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। হত্যাকারীদের প্রতি ছড়িয়ে পড়েছিল ঘৃণার বিষবাষ্প। পশ্চিম জামাির্নর নেতা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী উইলি ব্রানডিট বলেছিলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে নিমর্মভাবে হত্যা করার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুনবাির্সত হতে থাকে। তারা এ দেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে নানা উদ্যোগ নেয়। শাসকদের রোষানলে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণও যেন নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ঠেকাতে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করেছিল মোশতাক সরকার। দীঘর্ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হলে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করা হয়। বিচার শুরু হয় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ললাটে যে কলঙ্কতিলক পরিয়ে দেয়া হয়েছিল, ৩৫ বছরেরও বেশি সময় পর ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি সেই কলঙ্ক থেকে জাতির মুক্তি ঘটে। বঙ্গবন্ধু হত্যার চূড়ান্ত বিচারের রায় অনুযায়ী ওই দিন মধ্যরাতের পর বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি বরখাস্তকৃত লে. কনের্ল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কনের্ল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা, লে. কনের্ল (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) এবং লে. কনের্ল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদকে (আটির্লারি) ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ফঁাসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদÐের রায় কাযর্কর করা হয়। তবে বঙ্গবন্ধুর আরও ছয় খুনি এখনো রয়েছে ধরা-ছেঁায়ার বাইরে। এদের মধ্যে চারজনের অবস্থান এখনো শনাক্তই করা যায়নি। বাকি দুজনের অবস্থান বিদেশে শনাক্ত হলেও তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে দÐ কাযর্কর করার ক্ষেত্রে চলমান আলোচনায় এখনো কোনো সুফল আসেনি। মুজিব হত্যাকাÐে মৃত্যুদÐপ্রাপ্ত পলাতক আসামিরা হলেন- আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এম রাশেদ চৌধুরী, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী, আব্দুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেমউদ্দিন। তাদের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি করা আছে। এদের মধ্যে নূর চৌধুরী কানাডায় এবং এম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে বলে নিশ্চিত ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। বাকিরা কোথায় আছে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা নেই কারো। যথাযোগ্য মযার্দায় জাতীয় শোক দিবস পালন করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা কমর্সূচি হাতে নেয়া হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে আলাদা বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও নানা কমর্সূটি নেয়া হয়েছে। আজ সরকারি ছুটি। দিবসটি পালন করতে সূযোর্দয়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি ভবনসহ বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা অধর্নমিত রাখা হবে। আয়োজন করা হবে আলোচনা সভার। সকালে ধানমÐি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুুষ্পাঘ্যর্ অপর্ণ করবেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। সেই সময় সশস্ত্র বাহিনী গাডর্ অব অনার প্রদান করবে। এ ছাড়া ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বনানী কবরস্থানে গিয়ে ১৫ আগস্টে জাতির পিতার পরিবারের শাহাদাতবরণকারী সদস্য ও অন্য শহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অপর্ণ, ফাতেহা পাঠ এবং দোয়া করবেন। পরে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিতে পুষ্পাঘ্যর্ অপর্ণ করবেন তিনি। ওই সময় সশস্ত্র বাহিনী গাডর্ অব অনার প্রদান করবে। এ ছাড়া ফাতেহা পাঠসহ বিশেষ মোনাজাত ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন থাকছে সেখানে। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন শোক দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারসহ বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে বিভিন্ন সংবাদপত্র। আওয়ামী লীগের কমর্সূচি: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩তম শাহাদাতবাষির্কী যথাযোগ্য মযার্দা ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে দেশবাসীকে সাথে নিয়ে পালন করার জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সংস্থার সব স্তরের নেতাকমীর্, সমথর্কদের প্রতি উদাত্ত আহŸান জানানো হয়েছে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ব্যাপক কমর্সূচি গ্রহণ করেছে। কমর্সূচির মধ্যে রয়েছে, ১৫ আগস্ট মঙ্গলবার সূযোর্দয়ক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন এবং কেন্দ্রীয় কাযার্লয়সহ সংগঠনের সকল স্তরের কাযার্লয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অধর্নমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ধানমÐিস্থ বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পাঘ্যর্ অপর্ণ। এছাড়াও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন এবং ঢাকা নগরীর প্রতিটি শাখা থেকে শোক মিছিলসহ বঙ্গবন্ধু ভবনে শ্রদ্ধা নিবেদন। সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঘ্যর্ নিবেদন, মাজার জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিল। সকাল ১০টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধাঘ্যর্ নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল। বাদ জোহর দেশের সকল মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। মন্দির, প্যাগোডা, গিজার্, উপাসনালয়ে দেশব্যাপী বিশেষ প্রাথর্না কমর্সূচির অংশ হিসেবে সকাল ৯টায় ওয়াইএমসিএ চ্যাপেল, ১৯ সেনপাড়া, পবর্তা, মিরপুর-১০ এ খ্রিস্টান সম্প্রদায়, সকাল ১০টায় রাজধানীর মেরুল বাড্ডাস্থ আন্তজাির্তক বৌদ্ধ বিহারে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং সকাল সাড়ে ১১টায় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায় প্রাথর্না সভার আয়োজন করেছে। বাদ আসর বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল। ১৬ আগস্ট বুধবার বিকাল ৪টায় বঙ্গবন্ধু আন্তজাির্তক সম্মেলন কেন্দ্র আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আলোচনায় অংশ নেবেন জাতীয় নেতা ও বরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একইসাথে আওয়ামী লীগের সকল জেলা, মহানগর, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন, ওয়াডর্সহ সব শাখার নেতাদের কেন্দ্রীয় কমর্সূচির সাথে সামঞ্জস্যপূণর্ কমর্সূচি গ্রহণ করে দিবসটি স্মরণ ও পালন করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানিয়েছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে