শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
পস্নাস্টিক কারখানায় আগুন

ঢামেকে অগ্নিদগ্ধদের লাশের মিছিল

স্বজনদের বুকফাটা কান্না-আহাজারি মৃতের সংখ্যা বেড়ে এক লাফে ১৪ চেনা যাচ্ছে না প্রিয়জনের লাশ ১০ জনের লাশ হস্তান্তর
যাযাদি রিপোর্ট
  ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০
রাজধানীর কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকায় প্রাইম পেস্নট অ্যান্ড পস্নাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিহতের এক স্বজনের আহাজারি। ছবিটি বৃহস্পতিবার ঢামেক হাসপাতাল থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা

কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ার পস্নাস্টিক কারখানায় অগ্নিকান্ডে নিহতের সংখ্যা বৃহস্পতিবার ভোররাত থেকে দুপুর পর্যন্ত এক লাফে বেড়ে ১৪ জনে দাঁড়িয়েছে। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঢামেক বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও বেশ কয়েকজনের শরীর ৫০ থেকে ৮০ শতাংশের বেশি পোড়া রয়েছে। এদের বেশির ভাগেরই শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

এদিকে অগ্নিদুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবার এক লাখ টাকা এবং আহত প্রত্যেকের চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা ঘোষণা করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অগ্নিকান্ডের কারণ অনুসন্ধান এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সুপারিশ দিতে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

অন্যদিকে প্রাথমিক তদন্ত শেষে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, প্রাইম পেস্নট অ্যান্ড পস্নাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড আইন মেনে স্থাপন করা হয়নি। পস্নাস্টিকের মতো দাহ্য পদার্থের এই কারখানাটির যেসব নিয়ম মেনে স্থাপন করার কথা, তার বেশির ভাগই নেই। কারখানা পরিচালনায় মালিকের গাফিলতির বিষয়টি স্পষ্ট ধরা পড়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের একাধিক সূত্র জানায়, আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া বেশ কয়েকজনের মুখমন্ডল ভয়াবহভাবে পুড়ে যাওয়ায় তাদের স্ত্রী-সন্তানসহ ঘনিষ্ঠজনরাও লাশ দেখে সহজেই চিনতে পারেননি। পরে অনেকে পরনের জামা-প্যান্ট কিংবা তাদের ঘড়ি-আংটি ও ব্রেসলেট দেখে প্রিয়জনকে শনাক্ত করেছেন। আবার কেউবা দেহের গড়ন দেখে লাশের সারি থেকে বাবা-ভাই কিংবা স্বামীর মৃতদেহ খুঁজে নিয়েছেন। যেসব লাশ পুড়ে গেছে কিন্তু চেহারা দেখে শনাক্ত করা যায় তাদের ময়নাতদন্ত করে স্বজনদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারও লাশ শনাক্ত করা না গেলে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হবে। এ ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগতে পারে।

ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা জানান, বুধবার বিকেলে অগ্নিকান্ডের পর চুনকুটিয়ার পস্নাস্টিক কারখানা থেকে অজ্ঞাত অবস্থায় যে ব্যক্তির লাশ আনা হয়, তার মুখমন্ডলের বেশির ভাগ অংশ বিভীৎসভাবে পুড়ে যাওয়ায় নিকটাত্মীয়স্বজনরাও প্রথমে তাকে শনাক্ত করতে পারছিলেন না। পরে তার বাবা গুলজার হোসেন লাশের বাম হাতে থাকা ব্রেসলেট দেখে তার নাম 'মাহবুব' বলে জানান।

অগ্নিকান্ডে নিহতরা হলেন, নরসিংদী জেলার বেলাবো থানাধীন বিন্নাবাইদ গ্রামের বাসিন্দা তোফাজ্জল হোসেনের পুত্র বাবলু হোসেন (ইলেক্ট্রিশিয়ান), টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার মুসাজান গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সালামের পুত্র মো. সালাউদ্দিন (মেশিন মেইনটেইনার্স), কৃষ্ণকাঠি বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ থানার ইব্রাহিম খলিফার পুত্র আব্দুল খালেক খলিফা (মেশিন অপারেটর)। মাগুরা জেলার সালিখা উপজেলার ছয়ঘরিয়ার বাসিন্দা মোতালেব মোলস্নার পুত্র জিনারুল ইসলাম মোলস্না (সিনিয়র অপারেটর), পিরোজপুর সদরের শংকরপাশা গ্রামের নূরুল ইসলামের পুত্র মো. জাহাঙ্গীর হোসেন (ইলেক্ট্রিশিয়ান), পটুয়াখালীর কলাপাড়ার আনছার হাওলাদারের পুত্র ইমরান, খলিল হোসেনের পুত্র মো. সুজন, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হিজলতলা চুনকুটিয়ার বাসিন্দা আব্দুর রশিদের দুই পুত্র মো. আলম ও আব্দুর রাজ্জাক, জয়পুরহাটের আক্কেলপুরের সেলপাড়ার বাসিন্দা জসিম শাহ্‌র পুত্র ওমর ফারুক, নড়াইল সদরের মাইছপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ইউসুফ বিশ্বাসের পুত্র রায়হান বিশ্বাস, মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীর উত্তর রায়পুরের বাসিন্দা হানিফ দেওয়ানের পুত্র ফয়সাল, আলী হোসেনের পুত্র মেহেদী হোসেন এবং রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার আদম কুটিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা গুলজার হোসেনের পুত্র মাহাবুব হোসেন।

এদিকে ঢামেক হাসপাতালে এখনো অগ্নিদগ্ধ যে ২০ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন, এদের মধ্যে অন্তত ছয়জনকে দেখে সহজে চেনার কোনো উপায় নেই। তাদের দেহের অন্যান্য অংশের চেয়ে মুখমন্ডল বেশি দগ্ধ হয়েছে।

ঢামেক হাসপাতালে বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন বিক্রমপুরের বাসিন্দা অগ্নিদগ্ধ আবু সাঈদ সোহানের (২৯) ভাই জানান, তার মুখমন্ডলসহ শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে। পুরো শরীর ব্যান্ডেজে ঢাকা পড়েছে। তারা প্রথমে তাকে কোনোভাবেই চিনতে পারেননি। পরে তার শরীর থেকে খুলে রাখা পোড়া জামার একাংশ দেখে তিনি তাকে শনাক্ত করেন।

অগিদগ্ধ সিরাজুলের (১৯) শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় তার জন্মদাতা পিতাও তাকে প্রথমে চিনতে পারেননি বলে জানান বার্ন ইউনিটের এক চিকিৎসক। পরে তিনিও তাকে তার পরিধেয় গেঞ্জির পোড়া অংশ দেখে শনাক্ত করেন।

ঢামেক হাসপাতাল সূত্র জানায়, অগ্নিদগ্ধদের মধ্যে দশজনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড পস্নাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফসাপোর্টে রাখা হয়েছে। এছাড়া শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় বাকি দশজনও ঝুঁকিতে রয়েছেন। তাদের ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে সাতজন হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) রয়েছেন।

আইসিইউতে চিকিৎসাধীনরা হলেন- ৫০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া জামালপুরের সোহাগ (১৯), ৪০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া ঢাকার মফিজ (৪৫), ৫০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া বরিশালের সুমন (২২), ২০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া রাজশাহীর মুস্তাকিম, ৫০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া কেরানীগঞ্জের ফিরোজ, ৭০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া ঢাকার সিরাজুল, ৫০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া কেরানীগঞ্জের সোহাগ-২ (২৫), ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া বিক্রমপুরের আবু সাঈদ হোসেন, শতভাগ পুড়ে যাওয়া জয়পুরহাটের ফারুক (৩২) ও ৫০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া কেরানীগঞ্জের আসাদ (১৪)।

জাতীয় শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড পস্নাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, সকালে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন থেকে ১২ জনকে আইসিইউর লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে মেহেদী ও আব্দুর রাজ্জাক নামে দুজন মারা গেছেন। বাকি দশজন এখনো লাইফ সাপোর্টে আছেন। তাদের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

নিহতের পরিবারকে এক লাখ টাকা সহায়তা: অগ্নিদুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবার এক লাখ টাকা এবং আহত প্রত্যেকের চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা ঘোষণা করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে এই সহায়তা করা হবে বলে বৃহস্পতিবার শ্রম মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান এই ঘোষণা দিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার সকালে শ্রম সচিব কে এম আলী আজম ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে যান এবং সেখানে চিকিৎসাধীন শ্রমিকদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। পরে তিনি কেরানীগঞ্জে অগ্নি দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'এ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত। এ কারখানাটি কমপস্নাইন্স নয়। এর আগে মালিককে একাধিকবার নোটিশ দেয়া হয়েছে এবং শ্রম আইনে মামলাও করা হয়েছে। এ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে শ্রম আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

শ্রম মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি: কেরানীগঞ্জে প্রাইম পেস্নট অ্যান্ড পস্নাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে অগ্নিকান্ডের কারণ অনুসন্ধান এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সুপারিশ দিতে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শ্রম মন্ত্রণালয়।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোলস্না জালাল উদ্দিনকে প্রধান করে গঠিত কমিটির সদস্যরা হলেন- যুগ্ম সচিব (শ্রম) এ টি এম সাইফুল ইসলাম, শ্রম অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ঢাকার উপ-মহাপরিদর্শক আহমেদ বেলাল এবং একই অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিচালক (সেইফটি) মো. কামরুল হাসান। কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শকের মাধ্যমে ওই এলাকায় বিগত বছরে কতগুলো পস্নাস্টিক কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে, তার প্রতিবেদনও দিতে বলা হয়েছে কমিটিকে। পরিদর্শন প্রতিবেদনসমূহের সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়েছে কিনা, না হয়ে থাকলে তার কারণ এবং ওই এলাকার পস্নাস্টিক কারখানাগুলোর ঝুঁকি নির্ধারণ, ঝুঁকি নিরসনের সুপারিশও দিতে বলা হয়েছে।

মালিকের গাফিলতিতে অগ্নিকান্ড: প্রাইম পেস্নট অ্যান্ড পস্নাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড আইন মেনে স্থাপন করা হয়নি। পস্নাস্টিকের মতো দাহ্য পদার্থের এই কারখানাটির যেসব নিয়ম মেনে স্থাপন করার কথা, তার বেশির ভাগই নেই। প্রাথমিক তদন্তে বোঝা যাচ্ছে, কারখানা পরিচালনায় মালিকের গাফিলতি রয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর আবুল হোসেন এ তথ্য জানিয়েছেন। সকাল থেকে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল তদন্ত করছে।

এদিকে যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত না করে কারখানা পরিচালনার অভিযোগ এনে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর প্রাইম পেস্নট অ্যান্ড পস্নাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে গত ৫ নভেম্বর মামলা করেছে। অথচ এ মামলার ফয়সালা হওয়ার আগেই ঝরে গেল ১৪ জনের প্রাণ। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃতু্যর সঙ্গে লড়ছেন আরও ২০ জন।

অন্যদিকে বিদু্যৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এবং কেরানীগঞ্জের সাংসদ নসরুল হামিদ গতকাল সন্ধ্যায় দগ্ধ লোকজনকে দেখতে হাসপাতালে গিয়ে বলেছেন, কারখানাটির অনুমোদন ছিল না বলে জানা গেছে। নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে থাকা কারখানাগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে তিনি স্থানীয় সরকার ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে বলেছিলেন। কিন্তু কারখানাগুলো সরানো যায়নি।

বৃহস্পতিবার সকালে প্রাইম পেস্নট অ্যান্ড পস্নাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানায় গিয়ে মালিক ও শ্রমিকদের কাউকে পাওয়া যায়নি। কারখানার নিযুক্ত সাতজন নিরাপত্তাকর্মীকে সেখানে পাহারা দিতে দেখা গেছে। নিরাপত্তাকর্মীদের সুপারভাইজার সাকিল আহমেদ বলেন, কারখানার ভেতর বয়লারের পেছনে গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হতো। বিকেলে প্রথমে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। এরপর সেখানকার নিরাপত্তা কর্মীরা প্রথমে ফায়ার এক্সটিংগুইশার (অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র) দিয়ে চেষ্টা করা হয়। তবে আগুন নেভানো যায়নি।

ঘটনার পর থেকে কারখানার মালিক নজরুল ইসলাম পলাতক। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি। তবে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়েছে।

ব্রেসলেট দেখে লাশ শনাক্ত করলেন বাবা: কেরানীগঞ্জে কারখানায় লাগা আগুনে ঘটনাস্থলে নিহত একজনের মরদেহ বুধবার থেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে পড়া ছিল। অনেকেই মর্গে মরদেহের মুখ দেখলেও কেউ চিনতে পারছিলেন না। অবশেষে বৃহস্পতিবার তার বাবা গুলজার হোসেন তাকে চিনতে পেরেছেন। তবে মুখ দেখে নয়, ছেলের বাম হাতের ব্রেসলেটটি দেখে মরদেহ শনাক্ত করেছেন তিনি।

নিহতের নাম মাহবুব (২৫), বাড়ি রংপুরের পীরগাছায়। গত ৫ বছর ধরে তিনি কেরানীগঞ্জের প্রাইম পেস্নট অ্যান্ড পস্নাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে মেশিন অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

ছেলের মরদেহ শনাক্ত করে দিশেহারা বাবা গুলজার হোসেন বলছিলেন, 'গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে মাহবুবকে ফোন দিচ্ছি, রিং বাজে কিন্তু কেউ ধরে না। এরপর রাতে ফোন বন্ধ পেলাম। রাতেই আমার এক ভাতিজা ফোন দিয়ে বলল, ছেলে যে কারখানায় কাজ করত সেখানে আগুন লেগেছে। সেই সংবাদ শুনে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মেডিকেলে আসি। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি ৩১ জনের নামের তালিকা দেখে তাদের কাছে যাই। কিন্তু আমার ছেলে ছিল না।

'এরপর সকালে আমি জানতে পারি মর্গে একটি লাশ রয়েছে। মর্গে গিয়ে দেখতে পাই একটি পোড়া লাশ, পুরোটাই পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। এর বাম হাতে একটা ব্রেসলেট ছিল। ব্রেসলেটটি আমার ছেলে দীর্ঘদিন ধরে বাম হাতে পড়ত।'

মাহবুব গত বছরের আগস্টে কোরবানি ঈদের সময় সর্বশেষ বাড়িতে গিয়েছিলেন। গত ১৫ দিন আগে সর্বশেষ বাবার সঙ্গে দেখা করেছিলেন মাহবুব। তিন দিন আগে মাহবুব তার বাবাকে ফোন দিয়ে এক কেজি মধু কিনতে বলেন।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবা গুলজার বলেন, 'ছেলে ফোন দিয়ে বলল যে তার একটি ওষুধ বানাতে হবে। সেটার জন্য মধু দরকার। আমি মধু কিনে বাসায় রেখে দিয়েছিলাম। শুক্রবার আমার মিরপুরের বাসায় আসার কথা ছিল তার। এখন তো ছেলে আর কোনোদিন ফিরবে না।'

৬ ঘণ্টার ব্যবধানে মারা গেলেন দুই ভাই: পস্নাস্টিক কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন উইনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ ঘণ্টার ব্যবধানে মারা গেছেন দুই ভাই। তারা হলেন, রাজ্জাক ও আলম। বড়ভাই রাজ্জাক মারা যান সকাল সাড়ে ৬টায়। আর ছোটভাই আলম মারা যান দুপুর ১টায়।

নিহতদের আরেক ভাই জাহিদ জানান, কয়েক বছর আগে আলম বিয়ে করেছেন। তার দেড় বছর বয়সি তানহা নামের একটা মেয়ে রয়েছে। বুধবার দুর্ঘটনায় দগ্ধ হয়ে দৌড়ে বাসায় যান আলম।

স্ত্রী রুমাকে ডেকে বলেছিলেন, 'আমারে বাঁচাও রুমা, আমারে বাঁচাও।' অগ্নিদগ্ধ স্বামীকে চেহারায় না চিনলেও কণ্ঠ শুনে চিনতে পারেন রুমা। পাগলের মতো এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করেন। পানি এনে স্বামীর শরীরে ঢালতে থাকেন। তার কান্না শুনে প্রতিবেশীদের অনেকে ছুটে আসেন। গাড়ি ডেকে দ্রম্নত ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আলম মারা যান।

বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢামেক জরুরি বিভাগ-সংলগ্ন মর্গের সামনে রুমা আহাজারি করে বলছিলেন, 'বাঁচার জন্য কি আকুতি জানিয়েছিল কিন্তু তাকে বাঁচাতে পারলাম না।'

মাসিক বেতন ও ওভারটাইম মিলিয়ে ১১ হাজার টাকা বেতনে গেল ৫ বছর কেরানীগঞ্জের হিজলতলা বাজার-সংলগ্ন পস্নাস্টিক পণ্য তৈরির কারখানায় কাজ করছিলেন আলম। নিঃসন্তান রুমা মর্গে আহাজারি করে বলছিলেন, 'এখন আমি কী নিয়ে বাঁচব? আমারে কে দ্যাখব? আমি এখন কোথায় গিয়া দাঁড়ামু?'

অগ্নিকান্ডের সুষ্ঠু তদন্তের দাবি: কেরানীগঞ্জে পস্নাস্টিক কারখানায় আগুনে পুড়ে শ্রমিকদের নিহতের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে 'শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম' নামের একটি সংগঠন। পাশাপাশি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও জানানো হয়েছে।

বৃহস্পতিবার শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের আহ্‌বায়ক ড. হামিদা হোসেন স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<79697 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1