শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
শিগগির অ্যাকশন

ক্যাম্পাস ক্যাডারদের লাগাম টানার তোড়জোড় শুরু

বেপরোয়া ছাত্রলীগের সন্ত্রাসে সরকারের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হওয়ায় এদের লাগাম টেনে ধরতেই সরকার কঠোর 'অ্যাকশনে' নামার সিদ্ধান্ত এখন চূড়ান্ত
নতুনধারা
  ১৬ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন আবরার হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বুয়েটে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলেও সারাদেশের শিক্ষাঙ্গনে একই ধারা প্রবর্তনের ঘোর বিরোধী সরকার। বরং স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ফের বুয়েটে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি চালু হোক এমনটাই প্রত্যাশা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের। তবে ঢাকাসহ দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ পর্যায়েও ছাত্ররাজনীতির নামে যে ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চলছে তাতে ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক পরিস্থিতি ধরে রাখা দুষ্কর। এছাড়া শিক্ষাঙ্গন থেকে আগামী দিনের রাজনৈতিক নেতা তৈরি না হয়ে বরং 'দানব' তৈরি হচ্ছে। এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে আগামীতে ছাত্ররাজনীতিই দেশের জন্য 'কাল' হয়ে দাঁড়ানোর ঘোর আশঙ্কা রয়েছে। তাই এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে ক্যাম্পাসের বেপরোয়া ক্যাডারদের লাগাম টেনে ধরতে দ্রম্নত কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে এরই মধ্যে নতুন ছকও তৈরি করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, শিক্ষাঙ্গন থেকে রাজনীতি গুটিয়ে নেওয়া হলে সেখানে শিবির ও হিযবুত তাহরীরসহ বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠনের নতুন করে শক্তিশালী ভিত গড়ে ওঠার জোরালো আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি নিরীহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশি জঙ্গি গোষ্ঠীর টার্গেটেও পড়তে পারে। অথচ নিয়ন্ত্রণহীন ক্যাম্পাস রাজনীতির সুযোগে ছাত্রনেতারা নানা ধরনের অপরাজনীতিতে মেতে উঠেছে। কোথাও কোথাও তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে। এতে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার জন্য কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে উৎকণ্ঠায় সময় পার করছে। যা তাদের ক্রমেই ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। অথচ এরাও অনেকে তুখোড় রাজনীতিবিদ হিসেবে ছাত্রজীবন পার করেছে। এ অবস্থায় ক্যাম্পাসের বেপরোয়া ক্যাডারদের দ্রম্নত লাগাম টেনে ধরা ছাড়া সরকারের হাতে কোনো বিকল্প নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের প্রতিটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গোয়েন্দা নজরদারি আরও কয়েক ধাপ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে; ক্যাম্পাস নেতাদের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড কী এবং নেতারা কে কী ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তারা কেউ মাদকাসক্ত কি না কিংবা মাদক ব্যবসার সঙ্গে কারও সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া শিক্ষা পর্ব শেষে শিক্ষার্থীরা কেউ হলে থাকছে কিনা কিংবা বাইরে থেকে ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করছে কি না তা-ও খুঁজে দেখবে গোয়েন্দারা। দেশের প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসাসহ উচ্চমাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো অস্ত্রধারী নেতা কিংবা শিক্ষার্থী থাকলে তাদের নামসহ আনুষঙ্গিক তথ্য বিশেষ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ক্যাম্পাসভিত্তিক রাজনীতির ব্যানারে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলবাজিসহ চাঞ্চল্যকর নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত বহিরাগত অছাত্রদেরও এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সরকারের শীর্ষ প্রশাসন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ক্যাম্পাস ক্যাডারদের বেপরোয়া তান্ডবে কিছুদিন পর পর দেশের এক একটি শিক্ষাঙ্গন অস্থিতিশীল হয়ে ওঠায়, বিশেষ করে বেপরোয়া ছাত্রলীগের সন্ত্রাসে সরকারের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হওয়ায় এদের লাগাম টেনে ধরতেই সরকার কঠোর 'অ্যাকশনে' নামার সিদ্ধান্ত এখন চূড়ান্ত। সংশ্লিষ্টরা জানান, নিয়ন্ত্রণহীন ছাত্রলীগের ক্যাডারদের একটি বড় অংশ সাংগঠনিক কার্যক্রম ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিষ্ক্রিয় থেকে চাঁদাবাজিসহ নানা অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনেই বেশি তৎপর হয়ে ওঠায় বাস্তবিক অর্থে তারা এখন দলের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে- দলীয় হাইকমান্ডের এমন উপলব্ধির পর সরকারের 'অ্যাকশন পস্ন্যানে' তারাও নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়েছে। তবে অন্য একটি সূত্র জানায়, জামায়াত-শিবির পরিবার থেকে আসা বেশকিছু শিক্ষার্থী রাতারাতি ভোল পাল্টে ছাত্রলীগের সঙ্গে মিশেছে। আর্থিক কিংবা ভিন্ন কোনো সুবিধা পেয়ে খোদ ছাত্রলীগের নেতারাই তাদের সে জায়গা করে দিয়েছে। যারা নানা অপরাধ-অপকর্ম করে সরকারকে বিপাকে ফেলছে। যা বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পর গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে খুনিদের অন্তত তিনজনের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড জামায়াতের হওয়ার তথ্য ফাঁস হওয়ার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এছাড়া ছাত্রলীগের ৩০১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটিতে যে ১০৭ জন 'বিতর্কিত' স্থান পেয়েছে, তাদের মধ্যে ১৯ জনের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড বিএনপি-জামায়াত, ১১ জন মাদকাসক্ত ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, ৮ জন বিভিন্ন মামলার আসামি এবং ৬ জন ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা থাকার বিষয়টি গোয়েন্দা অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসায় সরকার ক্যাম্পাসের নেতাকর্মীদের গতিবিধি বিশেষ নজরদারিতে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ ধরনের 'অ্যাকশনে' যাওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন। সম্প্রতি বুয়েট ছাত্রলীগের নেতারা মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পর তিনি ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সমুন্নত রাখতে আগাছা নির্মূল করার আহবান জানিয়ে বলেছেন, 'যারাই করুক, অপরাধী সে যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। কোন দল করে সেটা না, খুনিকে খুনি হিসেবে দেখি। অন্যায়কারীকে অন্যায়কারী, অত্যাচারীকে অত্যাচারী হিসেবে দেখি। এ ধরনের অন্যায় করলে কখনো তা মেনে নেওয়া যায় না।' পাশাপাশি তিনি শিক্ষাঙ্গনে অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখার জন্য কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। \হ গোয়েন্দা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে জানান, ক্যাম্পাসের বেপরোয়া নেতাকর্মীদের প্রিভিয়াস ক্রিমিনাল রেকর্ড এবং তাদের বিরুদ্ধে বিগত সময়ে থানা-আদালতে কোনো মামলা আছে কি না তা খোঁজা হবে। তাদের বর্তমান গতিবিধির পূর্ণাঙ্গ চিত্রও ডাটা বেইজ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এ ছাড়া আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন কিংবা বহিরাগত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতাও গোয়েন্দারা খুঁজে দেখবে। যাতে এ তালিকা সহজ পর্যবেক্ষণেই এসব ক্যাডারের সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। কবে নাগাদ শিক্ষাঙ্গনে এ ধরনের অ্যাকশন শুরু হবে এ ব্যাপারে গোয়েন্দাদের কেউ কোনো সুস্পষ্ট ধারণা দিতে না পারলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দাবি, এরই মধ্যে 'হোমওয়ার্ক' শুরু হয়ে গেছে। ক্যাম্পাসের বেপরোয়া নেতাকর্মীদের ব্যাপারে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছে থাকা বিচ্ছিন্ন তথ্য সমন্বয়ের কাজ চলছে। এ কাজ আংশিকভাবে সম্পন্ন হলেই সংশ্লিষ্ট প্রশাসন 'অ্যাকশনে' নামবে। গোয়েন্দারা জানান, ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের বেপরোয়া হয়ে ওঠা এবং ছাত্রলীগে শিবির ক্যাডারদের অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত বিপুল সংখ্যক প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদনে উলেস্নখিত তথ্য যাচাই-বাছাই করলেও অনেক কিছুরই স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাবে। এছাড়া প্রতিটি এলাকা ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে প্রতিটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে গোয়েন্দারা তথ্য সংগ্রহ করবে। এ প্রক্রিয়ায় ক্যাম্পাসের বেপরোয়া ক্যাডারদের ব্যাপারে সামগ্রিক তথ্য সংগ্রহে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না বলে মনে করেন তারা। এদিকে সন্ত্রাসী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষাঙ্গন অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে জড়িত শিক্ষকদেরও চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের চিন্তাভাবনা করছে সরকার। প্রশাসনিক সূত্রগুলো জানায়, বিগত সময় বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিশ্লেষণে গোয়েন্দারা এ ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য বেশ কয়েকজন শিক্ষককেও দায়ী করেছেন। এদের একটি বড় অংশ জামায়াতপন্থি হলেও কেউ কেউ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের তকমা এঁটে ষড়যন্ত্রে অংশ নিচ্ছে বলেও গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছে। তাই বেপরোয়া শিক্ষার্থীদের লাগাম টানার পাশাপাশি ষড়যন্ত্রকারী শিক্ষকদেরও নিয়ন্ত্রণে না আনা গেলে শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে