মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকায় জুয়া খেলা: ক্লাব হাউস থেকে ক্যাসিনো

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের যৌথ অভিযানে দেখা গেছে স্পোর্টস বাদ দিয়ে ক্লাবগুলো মজে আছে জুয়ার এমন আয়োজনে, যার আধুনিক নাম ক্যাসিনো
যাযাদি ডেস্ক
  ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০
ইয়ংমেনস ক্যাসিনোতে অভিযানে উদ্ধারকৃত এই কষ্টি পাথরের মূর্তি স্পর্শ করেই নাকি প্রতিদিন জুয়ার আসর শুরু হতো বলে জানা গেছে -যাযাদি

একসময় ঢাকায় ফুটবল লিগের দাপুটে দল ছিল ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। পরে স্বাধীনতার পর আবাহনী-মোহামেডানের দ্বৈরথের মধ্যেও বহুদিন ধরে উজ্জ্বল ছিল আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, ফকিরাপুল ইয়াংমেন্স এবং ব্রাদার্স ইউনিয়নের মতো দলগুলো।

ফুটবলের পাশাপাশি অনেক দলেরই ক্রিকেট ও হকি দলও ছিল, যেখানে বিশ্বের নামিদামি অনেক খেলোয়াড়ও খেলে গেছেন। ফুটবলের সেই জৌলুস এখন আর নেই, এমনকি ক্রিকেট ভালো করলেও এসব দলের অনেকই আর তাতে নেই। নেই তারা হকিতেও।

এমনকি যেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে তৈরি হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র সেই প্রতিষ্ঠানের মূল কাজই হয়ে দাঁড়িয়েছে জুয়ার আয়োজন করা।

বুধবার রাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের যৌথ অভিযানে দেখা গেছে স্পোর্টস বাদ দিয়ে ক্লাবগুলো মজে আছে জুয়ার এমন আয়োজনে, যার আধুনিক নাম ক্যাসিনো।

ক্লাবগুলোর নিয়ন্ত্রণের ভূমিকাতেও আর খেলোয়াড় কিংবা সংগঠকরা নেই, আছেন সরকারদলীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা, যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অভিযোগ আসছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকেই।

ক্লাবের রঙ বদল: কবে-কীভাবে ঢাকার মতিঝিলের ক্লাবগুলো থেকে খেলাধুলা বিদায় নিয়ে নিষিদ্ধ ব্যবসা চালু হলো তা নিয়ে নানা ধরনের মত পাওয়া যায়।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, এসব ক্লাবে দীর্ঘকাল ধরেই জুয়ার চর্চা ছিল; কিন্তু

অনুমোদনহীন ক্যাসিনো কীভাবে হলো তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না তেমন একটা।

তবে ক্লাবগুলোর সঙ্গে জড়িত কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, আবাহনী-মোহামেডানসহ অন্য প্রায় সব ক্লাবেই জুয়ার প্রচলন ছিল আশির দশক থেকেই এবং সেটি করা হতো মূলত ক্লাবের পরিচালন ব্যয় নির্বাহের জন্য।

তখন ক্লাবের সংগঠকরা রাজনীতিতে খুব একটা সক্রিয় ছিলেন না, বরং ক্লাবগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা ছিল, ফলে খেলাধুলায়ও ক্লাবগুলো বেশ ভালো করেছিল।

'তখন মূলত ওয়ান-টেন নামে একটি জুয়া হতো। যেটি হাউজি নামেও পরিচিত ছিল। সপ্তাহে কয়েকদিন হতো। ক্লাবের বার্ষিক দাতাদের বাইরের বড় আয় আসত এই হাউজি থেকেই'- বলেন ঢাকার একটি ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক।

জানা গেছে, জুয়া হিসেবে তখন ক্লাবগুলোতে হাউজি, ওয়ান-টেন ও রামিসহ কিছু খেলা চালু ছিল আর বোর্ড বা জায়গা ভাড়া দিয়ে অর্থ আয় হতো ক্লাবের।

ঢাকার ক্যাসিনোগুলোর অনেকগুলোই ঘুরে দেখেন ব্যবসায়ী সুমন জাহিদ। তিনি বলেন, ঢাকায় ক্লাবে ক্যাসিনো সংস্কৃতির সূচনা হয়েছে কলাবাগান ক্লাবের হাত ধরে প্রায় ৭/৮ বছর আগে।

'এরপরই স্স্নট মেশিন, জুয়ার আন্তর্জাতিক মানের বিশেষ বোর্ড এগুলো আসতে শুরু করে ক্লাবগুলোতে। প্রথমে সব ক্লাবই বাকারা নামে একটি খেলা দিয়ে শুরু করে। পরে যোগ হয় রুলেট নামে আরেকটি খেলা।'

তবে এর ভিন্নমতও আছে। নিয়মিত ক্যাসিনোতে যান এমন একজন জানান, মতিঝিলের ক্যাসিনোগুলোতে যাওয়ার আগে তিনি মালিবাগের সৈনিক ক্লাবের ক্যাসিনোতে গিয়ে খেলেছেন।

নগদ টাকার মেলা

বিদেশের মতো বিশাল বড় ফ্লোরে হাজার রকমের জুয়া খেলার যন্ত্রপাতির সমাহার না হলেও স্স্নট মেশিন কমবেশি সব ক্লাবে পৌঁছে গেছে গত ৫/৬ বছরে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুকুল চাকমা বলেন, তিনি সেগুনবাগিচা এলাকায় অবৈধ মাদক সেবনের খবর পেয়ে একটি অভিযান চালান বছর দুয়েক আগে এবং অভিযানে সেখানেই ক্যাসিনোর অস্তিত্ব পান। পরে সেটি বন্ধও হয়ে যায় বলে জানান তিনি।

সেগুনবাগিচায় একটি বন্ধ হলেও পরে মতিঝিল, কলাবাগান, তেজগাঁও এবং এলিফ্যান্ট রোডে জমজমাট হয়ে ওঠে কয়েকটি ক্যাসিনো।

তবে এর আগেই নগরীতে ক্যাসিনোর ধারণা কলাবাগান থেকে শুরু হলেও এর নির্ভরযোগ্য আরেকটি জায়গা হয়ে দাঁড়ায় তেজগাঁওয়ের ফুওয়াং ক্লাব।

মূলত তাইওয়ানিজদের একটি দল ২০০০ সালের দিকে এখানে পানশালা-কাম-রেস্তোরাঁ চালু করে। পরে তাদের বিদায়ের পর বাংলাদেশি এক সাবেক সেনা কর্মকর্তার হাত ধরে চালু হয় ক্যাসিনো।

এর মধ্যে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মতিঝিলের ক্লাবগুলোর নিয়ন্ত্রণ যায় যুবলীগের কয়েকজন নেতার হাতে। তারাই মূলত ক্লাবগুলো থেকে খেলাধুলাকে গুরুত্বহীন করে দিয়ে সামনে নিয়ে আসেন ক্যাসিনোকে।

পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, ফকিরাপুল ইয়াংমেন্স ক্লাব-চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রিমিয়ার লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।

কিন্তু অর্থের অভাবে দল গঠন করতে না পারার জন্য আগের স্তরেই থেকে যায়, অথচ সেই ক্লাবেই র?্যাব অভিযান চালিয়ে সবচেয়ে বড় ক্যাসিনোর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে বুধবার রাতে।

আবার নেপাল থেকে প্রশিক্ষিত নারী ও নিরাপত্তা কর্মীও নিয়ে আসে কয়েকটি ক্যাসিনো। যদিও জুয়া খেলা বলতে স্স্নট মেশিন, বাকারা আর রুলেটই প্রধানত এখানে খেলা হয়। র?্যাব কর্মকর্তারা বলেন, ঢাকায় অন্তত ৬০টি ক্যাসিনো আছে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে।

মুকুল চাকমা বলেন, অনেকদিন ধরেই এসব বিষয়ে তথ্য আসছিল; কিন্তু এখন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা আসায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবার জন্য ব্যবস্থা নেয়াটা সহজ হয়েছে।

তিনি বলেন, এসব ক্যাসিনো হুট করে হয়নি তা সত্যি এবং হয়তো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও তথ্য ছিল। সে কারণেই এবার একটি সফল অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

তবে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ক্যাসিনোগুলোর ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে সমাজের সব স্তরের প্রভাবশালীরাই এসব ক্যাসিনো গড়ে তুলেছেন।

'যারা খেলতে গিয়েছে তাদের কেউ কেউ ধরা পড়েছে; কিন্তু এসব ক্যাসিনোর যন্ত্রপাতি আনার অনুমতি কে দিয়েছে। কারা বছরের পর বছর জেনেশুনেও এসব চলতে দিয়েছে। সুবিধা নিয়েছে নিয়মিত। সবাই মিলেই এসব তৈরি করেছে। ব্যবস্থা নিতে হলে এদের সবার বিরুদ্ধেই নিতে হবে আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে।'

মতিঝিলের ক্যাসিনোগুলোতে নিয়মিত যান এমন একজন জানান, সেখানে কোটি কোটি টাকার জুয়া খেলা হয় এবং ২৪ ঘণ্টাই এগুলোতে সচল থাকে জুয়ার বোর্ড।

তিনি বলেন, 'এক হাজার থেকে ১ লাখ টাকার কয়েন বা চিপস কিনে বসে। অনেকে সেখানেই অ্যালকোহল পান করেন। তবে এসব ক্যাসিনোতে কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। ভেতরে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখেন আয়োজকরা। আর এসব আয়োজনের মধ্যেই প্রতিদিন সর্বস্বান্ত হয় অসংখ্য মানুষ।'

সামনে রাখা হয় বড় নেতাদের

ক্লাবগুলোর প্রায় সবগুলোতেই চেয়ারম্যান হিসেবে সামনে রাখে স্থানীয় সংসদ সদস্য বা বড় কোনো রাজনৈতিক নেতাকে। কিন্তু এসব নেতা সেসব ক্লাবে যাওয়ারও সুযোগ পান না তেমন একটা।

একটি ক্লাবের সঙ্গে জড়িত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মূলত মতিঝিল এলাকার এক কাউন্সিলর ও র?্যাবের অভিযানে আটক হওয়া যুবলীগ নেতাই সব ক্লাবের নিয়ন্ত্রক।

এর মধ্যে কাউন্সিলর দুটি ক্লাব সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করেন। আর বাকিগুলো ছিল র?্যাবের হাতে আটক যুবলীগ নেতার হাতে।

আবার তাদের দু'জনকেই নিয়ন্ত্রণ করেন যুবলীগের এক নেতা, যাকে নিয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নিজেও বক্তব্য রেখেছেন বলে ঢাকার পত্রিকায় খবর এসেছে।

কিন্তু তারা ক্লাবগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে মূলত ক্যাসিনো গড়ে তুললেও ক্লাব কর্মকর্তারা রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই এসব নিয়ে মুখ খুলতে পারেননি।

আবার কোনো কোনো ক্লাবের কর্মকর্তারাও ব্যাপক অর্থের লোভে জড়িয়ে গেছেন এ অবৈধ ব্যবসায়। কারণ অবৈধ হলেও এসব ক্যাসিনো মালিকের কাছ থেকে সুবিধা নিত সব পেশার লোকজনই।

ওই কর্মকর্তা বলেন, থানাসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রায় সব বাহিনীর লোকজনই এসব জানত; কিন্তু কেন এতদিন কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সেটাই বিস্ময়ের বলে মন্তব্য করেন ওই কর্মকর্তা। বিবিসি বাংলা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<67596 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1