শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাবা এরশাদের আসনে জাপা প্রার্থী ছেলে সাদ

রওশন-কাদের সমঝোতা
যাযাদি রিপোর্ট
  ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

বাবা এইচ এম এরশাদের আসন রংপুর-৩ এ জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন ছেলে রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদ। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা রোববার এ ঘোষণা দেন।

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদ মারা যান গত ১৪ জুলাই। নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, এরশাদের মৃতু্যতে শূন্য এ আসনে ভোট হবে ৫ অক্টোবর।

এ আসনে ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। আওয়ামী লীগ শনিবার এ আসনে রেজাউল করিমকে মনোনয়ন দেয়। রেজাউল করিম রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। তবে এই আসনে নিজ দলের কোনো প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়নি দলটি। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিক পিপলস পার্টির রিটা রহমানকে সমর্থন দিচ্ছে তারা। রিটা বিএনপির প্রতীক 'ধানের শীষ' নিয়ে লড়বেন।

জাতীয় পার্টির দুর্গ হিসেবে পরিচিত রংপুর-৩ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী কে হবেন তা নিয়ে দলটির মধ্যে চাপা উত্তেজনা শুরু হয়। এরশাদপুত্র রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদসহ এ আসনে পাঁচজন দলীয় মনোনয়ন চান। বাকি মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ছিলেন এরশাদের ভাগনি (মেরিনা রহমানের মেয়ে) মেহেজেবুন নেছা টুম্পা, রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এসএম ফখর-উজ-জামান ও রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির, জেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ম সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক।

এর আগে রংপুর-৩ (সদর) আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে জাতীয় পার্টিতে গৃহদাহ শুরু হয়। এরশাদপুত্র সাদকে মনোনয়ন না দেয়ার দাবিতে এরশাদের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ারের নেতৃত্বে গত মঙ্গলবার মিছিল হয় নগরে। এর আগের রাতে দুটি এলাকায় সাদ এরশাদের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। আবার সাদ এরশাদকে মনোনয়ন দিলে তার পক্ষে কাজ না করার ঘোষণা দেন রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি মোস্তাফিজার রহমান।

রংপুর-৩ (সদর) আসনের উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে এমন পরিস্থিতির মধ্যে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান পদ ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পদ নিয়ে এরশাদের ছোট ভাই ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সঙ্গে সাদের মা রওশন এরশাদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এক পর্যায়ে রওশনপন্থিরা কাদেরকে বাদ দিয়ে রওশনকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করে। গত সপ্তাহজুড়ে দলের পাল্টাপাল্টি নানা কর্মসূচি চলে। তবে শেষতক শনিবার রাতে রওশন ও কাদেরপন্থি নেতারা একত্র হয়ে একটা সুরাহা করেন। সেই সমাধান সূত্র হলো, জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যান থাকবেন আর রওশন এরশাদ হবেন বিরোধীদলীয় নেতা। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা রোববার এ ঘোষণা দেন। এরপরই তিনি রংপুর-৩ আসনে দলের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেন।

জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাংসদ সৈয়দ আবু হোসেন বলেন, 'দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন দলীয় কমিটি সাদ এরশাদকে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে। সাদ এরশাদই রংপুর-৩ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী।'

\হ

নেতৃত্বের লড়াই

এরশাদের স্ত্রী রওশন বিরোধীদলীয় উপনেতার পাশাপাশি জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন। এরশাদের ভাই জিএম কাদের ছিলেন কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্বে।

পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদই সংসদীয় দলের নেতা ও বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্বে ছিলেন।

এরশাদের মৃতু্যর পর কাদের দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন, যদিও তাতে রওশনের আপত্তি ছিল। রংপুর-৩ আসনে উপনির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে তাদের বিরোধ চরম আকার ধারণ করে।

রওশনের ছেলে সাদ এরশাদ বাবার আসনে প্রার্থী হতে চাইলেও রংপুরের নেতারা তার বিরোধিতায় নামেন।

এর মধ্যে কাদের তাকে বিরোধীদলীয় নেতা ঘোষণা করতে গত সপ্তাহে স্পিকারকে চিঠি দিলে পাল্টা চিঠিতে তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন রওশন।

জিএম কাদের আবার নির্বাচন কমিশনে চিঠি পাঠিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দলের প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষমতা তার বলে দাবি করেন। প্রার্থী মনোনয়নে রওশন আবার পাল্টা সংসদীয় বোর্ড গঠন করেন।

এরপর রওশনের উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তার সমর্থকরা তাকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন।

দেবর-ভাবির পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপে দলের শীর্ষ নেতারা দুই ভাগ হয়ে যান, কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে বিভ্রান্তি। এ অবস্থায় শনিবার রাতে বারিধারার ক্লাবে সমঝোতা বৈঠকের উদ্যোগ নেয়া হয়।

রওশন এরশাদ সমর্থকদের মধ্যে দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ফখরুল ইমাম, মুজিবুল হক চুন্নু, সেলিম ওসমান ও এসএম ফয়সাল চিশতী রাতে বারিধারার কসমোপলিটন ক্লাবের ওই বৈঠকে অংশ নেন।

জিএম কাদেরের পক্ষের নেতাদের মধ্যে ছিলেন কাজী ফিরোজ রশীদ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ও সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা।

বৈঠকে শুরুতে 'অনানুষ্ঠানিক' বলে এড়িয়ে যেতে চাইলেও পরে কাজী ফিরোজ রশীদ দুই পক্ষের সমঝোতার ইঙ্গিত দেন। তিনি জানান, রওশন বিরোধীদলের নেতা হচ্ছেন, দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন জিএম কাদের।

এর আগে শনিবার এক সংবাদ সম্মেলন করে জিএম কাদের বলেছিলেন, আগামী ৩০ নভেম্বর ঢাকায় জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হবে। কাউন্সিলে দলের নেতাকর্মীরাই জাতীয় পার্টির আগামী দিনের নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন। নেতাকর্মীদের সিদ্ধান্ত তিনি মেনে নেবেন। তবে কাউন্সিলের তারিখ নিয়ে রওশন সমর্থকদের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

'জাতীয় পার্টি রক্ষা পেয়েছে'

পদ-পদবি নিয়ে দুই শীর্ষ নেতার বিরোধে গত কয়েক দিন ধরে জ্যেষ্ঠ নেতারা যখন পাল্টাপাল্টি বৈঠক আর সংবাদ সম্মেলন করে আসছিলেন, দলের মহাসচিব রাঙ্গা ছিলেন দৃশ্যের বাইরে।

কয়েক দিন আগেও জিএম কাদেরের পাশে থেকে রাঙ্গা বলেছিলেন, রংপুর-৩ আসনে উপনির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্বে তিনি তৃতীয় পক্ষের চক্রান্তের আভাস পাচ্ছেন।

কিন্তু রওশন সমর্থকরা দাবি করেন, মহাসচিব রাঙ্গা তাদের সঙ্গেই আছেন। রওশনের সঙ্গে তার ফোনে কথাও হয়েছে।

বৃহস্পতিবার রওশনকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে এক সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদও বলেন, রাঙ্গাই তাদের থাকছেন মহাসচিব।

কিন্তু রাঙ্গা ওই পক্ষে শুনে জিএম কাদেরও অবাক হয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আমি তো জানি তিনি বিআরটিএ'র মিটিংয়ে। তিনি কী বলেছেন, আমি শুনিনি। আগে জানতে হবে।

অস্পষ্ট এই অবস্থান নিয়ে রাঙ্গার বক্তব্য জানতে সাংবাদিকরা নানাভাবে চেষ্টা করেও তার নাগাল পাচ্ছিলেন না। শনিবার পর্যন্ত তিনি গণমাধ্যমের সামনে আসেননি, ফোনও ধরেননি।

এই পরিস্থিতিতে রাঙ্গার ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও অনেকে রসিকতা করে বিভিন্ন টিপ্পনি কাটেন।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব রাঙ্গা রোববারের সংবাদ সম্মেলনে রসিকতার সুরেই সে প্রসঙ্গ তোলেন।

তিনি বলেন, এমনও বলা হয়েছে যে মসিউর রহমান রাঙ্গা হারিয়ে গেছেন, 'উনার উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি না ৯ ইঞ্চি, উনার চুল খাড়া খাড়া, উনার শারীরিক গঠন এইরূপ, উনি এ রকম কাপড় পরেন, উনাকে কেউ খুঁজে পেলে বনানীর অফিসে প্রেরণ করবেন।'

আর নিজেকে আড়াল করে রাখার ব্যাখ্যায় রাঙ্গা বলেন, পরিবারের পিতামাতা যখন বিবাদে জড়ান, তখন সন্তানরা বিপদে পড়েন। দলে বড় ভাই হিসেবে আমি কিছুটা সরে পড়েছিলাম। তবে গত তিন দিনে আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করে শনিবারের বৈঠক আয়োজন করেছি। একটা বড় ধরনের ভাঙন থেকে জাতীয় পার্টি রক্ষা পেয়েছে।

জিএম কাদেরের অফিসে বিক্ষোভ

এদিকে জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতারা শীর্ষ দুই নেতার মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির রফায় এলেও তাতে আপত্তি তুলে বনানীর কার্যালয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সমর্থকরা।

তাদের ভাষায়, বারিধারার কসমোপলিটন ক্লাবে শনিবার রাতের সমঝোতা বৈঠকে যা হয়েছে তা 'নাটক'। দলে আর সংসদে তারা আলাদা নেতা চান না।

জিএম কাদেরপন্থি হিসেবে পরিচিত প্রেসিডিয়াম সদস্য আদেলুর রহমান আদেল বলেন, 'আমরা সংসদ অধিবেশনে যাব। তবে পার্লামেন্টারি কমিটির বৈঠক স্থগিত করা হয়েছে।'

ওই বৈঠকের পর বিরোধীদলীয় নেতা নির্ধারণের বিষয়ে স্পিকারকে চিঠি দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু জিএম কাদেরের সমর্থক এমপিরা সংসদ ভবনে না যাওয়ায় সেই বৈঠক আর শুরু করা যায়নি বলে রওশনপন্থি নেতা এসএম ফয়সাল চিশতী জানান।

রওশনপন্থিরা যখন সংসদ ভবনে, জিএম কাদের তখন তার অনুসারী ১৪ জন এমপিকে নিয়ে বনানীতে পার্টি চেয়ারম্যানের অফিসে বৈঠক করছিলেন।

জিএম কাদের ছাড়াও মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সালমা ইসলাম, শরীফুল ইসলাম জিন্নাহ, আদেলুর রহমান আদেল, মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ও নাজমা আক্তার ছিলেন সেখানে।

ওই বৈঠক চলার মধ্যেই চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের সিঁড়িতে এবং জিএম কাদেরের কক্ষের সামনে বিক্ষোভ শুরু করেছেন একদল কর্মী।

রওশন এরশাদকে বিরোধী দলের নেতা করার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে সমঝোতা বৈঠকে তাকে 'অগণতান্ত্রিক ও আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত' বলে স্স্নোগান দিতে শুরু করেন তারা।

তারা স্স্নোগান দিতে থাকে- 'অগণতান্ত্রিক সমঝোতা মানি না, মানব না'; 'আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত, মানি না, মানব না'; 'লড়াই না সংগ্রাম? সংগ্রাম, সংগ্রাম'; 'জি এম কাদেরের সৈনিকেরা ভয় নাই, ভয় নাই'।

ওই বিক্ষোভে থাকা তেজগাঁও থানা জাতীয় পার্টির সহ-সভাপতি আলী হোসেন বলেন, 'আগে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দলের চেয়ারম্যান ছিলেন, রওশন এরশাদ সংসদে দলের নেতা ছিলেন। কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু স্যারের মৃতু্যর পরে দলে নতুন চেয়ারম্যান, সংসদে নেতা নির্ধারণ নিয়ে এত নাটক কেন'?

তিনি বলেন, নেতা ঠিক করতে না পারলে আমাদের ভগ্নপ্রায় তৃণমূল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব নাটকের কারণে জনগণও আমাদের দেখে হাসে। এবার রওশন এরশাদকে নিয়ে যে নাটক হলো, আমরা এটা চাই না। যিনি চেয়ারম্যান, তিনিই সংসদে নেতা হবে, এটাই কথা। আলাদা আলাদা নেতা চাই না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<66091 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1