বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রশাসনিক কাজে বাধার পাহাড়

মূল অন্তরায় জনপ্রতিনিধিদের অযাচিত হস্তক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও তা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি রাজনীতিকরা দুষছেন প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্তাদের
সাখাওয়াত হোসেন
  ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত সংঘবদ্ধ চক্রের অপতৎপরতায় শিক্ষা-স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে প্রায় সব খাতের প্রশাসনিক কর্মকান্ডে প্রতিবন্ধকতার পাহাড় জমেছে। ফলে সরকারের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দেশের সার্বিক উন্নয়নের গতিশীল ধারায় বেশ কিছুটা ধীরগতি দেখা দিয়েছে। এ জন্য অনেকেই আমলাদের দায়ী করলেও তারা এ সংকটের জন্য প্রভাবশালী রাজনীতিক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও শক্তিশালী দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটকে দুষছেন। এ বিষয়টি তারা লিখিতভাবে অবহিত করায় খোদ প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় প্রশাসনে অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধে বেশকিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে নানা কারণে এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের পথ এখনো ততটা সুগম হয়নি।

প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অভিযোগ, মন্ত্রী, এমপি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ প্রভাব বিস্তারের কারণে অনেক রুটিন ওয়ার্কও তারা সময়মতো করতে পারছেন না। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রেও তারা অনেক সময় বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের অযাচিত 'আবদার' না মানায় দক্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের শাস্তিমূলক বদলিসহ নানা হয়রানির শিকার হওয়ার নজির রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রশাসনের অনেকে 'মানিয়ে' চলার চেষ্টা করছেন। যা প্রকারান্তরে প্রশাসনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এদিকে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইসু্যতে প্রশাসনের স্থবিরতায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সর্বোচ্চ আদালত নানা নির্দেশনা দিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হচ্ছে। পাশাপাশি হাইকোর্টের বিভিন্ন নির্দেশনা কৌশলে উপেক্ষা করারও বিস্তর নজির রয়েছে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ব্যাপকহারে দলীয়করণের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই রুটিন ওয়ার্কের বাইরে প্রায় সব কাজকর্মেই ধীর গতি বিরাজ করছে। এতে সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে দুর্বৃত্তায়ন ও স্বেচ্ছাচারিতা বেড়েছে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক মহলের প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসনের পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এসব ঘটনার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে তারা পরিবহন খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে বিআরটিএ, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশের প্রাণান্ত চেষ্টা এবং এর বিপরীতে বিশেষ মহলের নেতিবাচক দাপটের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছর রাজধানীর রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্টের দুই শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহতের ঘটনায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিরাপদ সড়কের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডেকে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮-এর অনুমোদন দেন। অথচ এরপর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দেয়া নির্দেশনা বাস্তবায়নের উলেস্নখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং তা উপেক্ষা করে গণপরিবহনের রেষারেষি আগের চেয়ে বেড়েছে। ঢাকা শহরে চলন্ত গণপরিবহনের দরজা বন্ধ রাখা নিশ্চিত করতে বিআরটিএ, ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রাণান্ত চেষ্টার পরও বাস স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠা-নামা বন্ধ হয়নি। সব সড়কে বিশেষত মহাসড়কে চলমান সব পরিবহনে (বিশেষত দূরপালস্নার বাসে) চালক এবং যাত্রীর সিটবেল্ট ব্যবহারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। বরং এ ব্যাপারে কয়েক দফা উদ্যোগ নিলেও গণপরিবহন শ্রমিকদের কঠোর আন্দোলনের হুমকির মুখে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বরাবরই পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রভাবশালী নেতা অনেকটা প্রকাশ্যেই গণপরিবহন শ্রমিকদের দিয়ে এর কলকাঠি নাড়ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও কেউ কেউ এ জন্য প্রশাসনের গাফিলতিকেও দায়ী করেছেন।

এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়েজ আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, 'প্রশাসনের জন্য রাষ্ট্রের কোনো কাজের প্রতিবন্ধতা হচ্ছে এটা বলার সুযোগ নেই। কারণ রাষ্ট্রের কোনো কাজের প্রতি প্রশাসনের কোনো গাফিলতি নেই। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হিসেবে আমরা কাজ করি, কোনো দল বা গোষ্ঠীর নয়। কাজ করতে গিয়ে নানা চাপ আসে, সেগুলোকে কাজের অংশ হিসেবে মনে করি এবং চাপ কাজের কোনো ব্যাঘাত ঘটায় বলে আমি মনে করি না। বরং রাজনৈতিক চাপকে কৌশলে কীভাবে জনগণের সেবায় কাজে লাগানো যায় সে চেষ্টাই করি।'

তিনি বলেন, কিছু কাজ আছে যেমন নিরাপদ সড়ক, ডেঙ্গু মোকাবিলার মতো কর্মসূচি, যা প্রশাসনের একার পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব না, সেখানে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা জরুরি।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রশাসনের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রশাসনিক কর্মকান্ডে ধীরগতির জন্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে বিশেষভাবে দায়ী করেছেন। তাদের ভাষ্য, বিভিন্নভাবে যাচাই-বাছাই করে যোগ্য কর্মকর্তাদের মাঠ প্রশাসনে পদায়ন করা হয়। আগের তুলনায় সরকারি কর্মকর্তারা এখন অনেক বেশি ভালো কাজ করছে। সমাজের বিদ্যমান অনিয়মগুলো বন্ধের জন্য বিভিন্নভাবে বলা হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে যেসব অনিয়ম হয়ে আসছে সেগুলো সহজেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। এজন্য সবার সহযোগিতা জরুরি। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সহযোগিতা মিলছে না। তাই স্বাভাবিকভাবেই ভালো উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে দেরি হচ্ছে বলে মনে করেন তারা।

এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষ্য, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক ব্যক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সততা-অসততা সমাজের প্রতিটি স্তরকে স্পর্শ করে। কিন্তু সেই রাজনৈতিক দল ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যখন দুর্বৃত্তায়নের আশ্রয় নেন, যখন তারা বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকান্ডে অযাচিত হস্তক্ষেপ করেন। তখন তার নেতিবাচক প্রভাব প্রতিটি স্তরের পড়ে। বর্তমান সময়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নগর ব্যবস্থাপনা ও কৃষিসহ সর্বস্তরে যে অনিয়ম তার পেছনে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের অনেক বড় প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।

এদিকে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপ এবং এ নিয়ে তাদের চাপা ক্ষোভের বিষয়ে সরকারকে অবহিত করেছেন। যার প্রেক্ষিতে সম্প্রতি মন্ত্রী, এমপি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের সরকারি কাজে হস্তক্ষেপ না করার জন্য সতর্ক করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি ও ইউএনওদের চিঠি দিয়ে এ ধরনের অপতৎপরতায় সমর্থন না দিতে বলা হয়েছে।

এরপর কোনো মন্ত্রী-এমপি কিংবা রাজনৈতিক নেতা সরকারি কাজে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করলে তা তাৎক্ষণিক টেলিফোনে বা লিখিত আকারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করতে বলা হয়েছে।

এ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে- সরকারি কাজের টেন্ডার, নিয়োগ বাণিজ্য, উন্নয়ন কর্মকান্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজে মন্ত্রী-এমপি ও স্থানীয় নেতারা হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, থানায় মামলার তদবির ও স্থানীয় প্রশাসনে রদবদল, মাদক ব্যবসায়ীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতার অর্থ বিলি-বণ্টনে প্রভাবও বিস্তার করতে পারবেন না। কারও বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকারি পদে নিয়োগের বিষয়ে বলা হয়- নিয়োগের ব্যাপারে এমপিদের পক্ষ থেকে কোনো ডিও লেটার দেয়া যাবে না। যদি কেউ দেন তাহলে সেই প্রার্থীকেই অযোগ্য বিবেচনা করা হবে। সরকারের এমন নির্দেশনা পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন একাধিক বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসি।

এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, এ ধরনের নির্দেশনা দেয়া হলে তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। তবেই জনগণ এর সুফল পাবে। প্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যাতে না হয় সে ধরনের অনেক কিছুই কাগজে-কলমে আছে। কিন্তু যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয় না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, এ ধরনের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনো তা যদি মনিটরিং না করা হয় তবে এর সফলতা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। তাছাড়া যাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যেও অনেকের রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। সুতরাং এর বাস্তবায়ন কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসার বিষয়টি অনেকেই স্বীকার করেছেন। একাধিক জেলা প্রশাসক এবং সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, সরকারি পদে নিয়োগের ব্যাপারে এমপিদের পক্ষ থেকে কোনো ডিও লেটার না দেয়ার নির্দেশনা থাকলেও এ বিষয়টি আগের মতোই রয়ে গেছে। একজন প্রার্থীর পক্ষে একাধিক এমপির ডিও লেটার দিচ্ছেন- এমন নজিরও রয়েছে। সরকারি হাসপাতালের জন্য গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা কেনার মতো সামান্য টেন্ডারে নিজের পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেয়ার জন্য এমপিরা চাপ দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ তোলেন তারা।

তবে একাধিক সংসদ সদস্য এ বিষয়ে পাল্টা অভিযোগ তুলে বলেন, প্রশাসনিক দুর্নীতিই উন্নয়নের অগ্রযাত্রার পথে প্রধান অন্তরায়। এটি দূর করা গেলে প্রশাসনিক কর্মকান্ড গতিশীল হবে। তাদের ভাষ্য, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা অনেকে নিজস্ব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে। তবে এ নিয়ে কোনো আপত্তি তুললেই তারা গোটা কার্যক্রম কৌশলে বন্ধ করে দিয়ে এর দায় জনপ্রতিনিধি কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন। জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পাওয়ার পর প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এ চর্চা আরও বেড়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<65945 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1