বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
সমাবেশে রোহিঙ্গাদের ঘোষণা

নাগরিকত্ব দিলে একসঙ্গে মিয়ানমারে ফিরব

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার দুই বছর পূর্ণ হলো রোববার। নিজ বাসভূমি রাখাইনে প্রত্যাবাসনসহ পাঁচ দফা দাবিতে উখিয়ায় সমাবেশ করেছে রোহিঙ্গারা
জাবেদ আবেদীন শাহীন
  ২৬ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০
রোববার সকালে কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে ক্যাম্প-৪-এ একসটেনশনে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর হিউম্যান রাইটসের আয়োজনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে উপস্থিত রোহিঙ্গাদের একাংশ -যাযাদি

মিয়ানমারমুখে বললেই তারা ফিরে যাবে না, তাদের নিজস্ব অধিকার দিয়ে ফিরিয়ে দিতে হবে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের আগে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে মিয়ানমারকে। এরপর বাংলাদেশে আশ্রিত ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা একসঙ্গেই ঘরে (রাখাইনে) ফিরে যাবে। এ জন্য মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে রোহিঙ্গা নেতারা সংলাপে বসতেও রাজি। রোববার কক্সবাজারের উখিয়ায় আয়োজিত রোহিঙ্গা সমাবেশ থেকে এ ঘোষণা দেয়া হয়।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থি মগদের নির্যাতন, অত্যাচার জুলুম, ধর্ষণ, হত্যাসহ নিপীড়নের কারণে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পাড়ি জমায়। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার দুই বছর পূর্ণ হলো রোববার। নিজ বাসভূমি রাখাইনে প্রত্যাবাসনসহ পাঁচ দফা দাবিতে কক্সবাজার জেলার উখিয়ায় সমাবেশ করেছে রোহিঙ্গারা। তাদের ৩০টি ক্যাম্পে দিবসটি পালন করতে রোহিঙ্গারা নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে। গত বছরও রোহিঙ্গারা ক্যাম্পগুলোতে প্রথম বার্ষিকী উদযাপন করেছিল।

রোববার সকালের দিকে উপজেলার কুতুপালংয়ে ক্যাম্প-৪ এর একসটেনশনে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর হিউম্যান রাইটসের নেতৃত্বে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো অমানবিক নির্যাতনের প্রতিবাদ জানানো হয়। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের 'নাটক' ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বক্তারা।

রোববারের সমাবেশ থেকে নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব ও ভিটেমাটি ফিরিয়ে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের সঙ্গে সংলাপ আয়োজনের দাবি নতুন করে তোলেন মিয়ানমার থেকে আসা এ শরণার্থীরা। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিব উলস্নাহ সমাবেশে বলেন, 'মিয়ানমার মুখে বলল, আর ফিরে গেলাম, তা কোনোভাবে সম্ভব নয়। আমাদের নিজস্ব অধিকার দিয়ে ফিরিয়ে দিতে হবে। 'এ জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকার এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে।'

তারা রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিচারসহ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত, ভিটেবাড়ি পুনরুদ্ধার, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা জোরদার ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনের দাবি জানান।

রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুলস্নাহ বক্তব্য বলেন, রোহিঙ্গারা শুরু থেকে যেসব দাবি-দাওয়া দিয়ে আসছিল, তৎমধ্যে নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা এবং বসতভিটা ফেরত দিতে হবে। নইলে রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যাবে না। নির্যাতিত রোহিঙ্গা জাতিকে আশ্রয় দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি রোহিঙ্গা জাতির মা। তার উদারতার কারণে এখানে আসা রোহিঙ্গারা হাজার হাজার মা-বোনের ইজ্জত রক্ষা হয়েছে। তা না হলে নাফ নদীতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও পুরুষের লাশ ভাসতে দেখা যেত। এতে উখিয়া-টেকনাফবাসীকে ভাইবোন হিসেবে ঘোষণা দেন এবং বাংলাদেশের প্রশাসনের প্রশংসা করেন। মিয়ানমারের সেনা, পুলিশ, নৌ-সদস্যরা রোহিঙ্গাদের যেভাবে হত্যা নির্যাতন করেছে আর বাংলাদেশের সেনাসহ সব ধরনের সদস্যরা মুখে ভাত ও আশ্রয় দিয়েছেন।

উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি মুসা আলী ও নুরুল আমিন বলেন, প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের সংলাপের ব্যবস্থা করতে হবে। মিয়ানমারে তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে এবং ভিটেমাটি ফিরিয়ে দিয়ে তাদের প্রত্যাবাসন করতে হবে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থি মগদের নির্যাতনে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছি। এর মধ্যে দুই বছর পার হয়ে গেলেও আন্তর্জাতিক মহল এ সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। যত দ্রম্নত সম্ভব আমরা আমাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে চাই ফিরে যেতে।

উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হেডমাঝি আবু তাহের বলেন, ১৯৮০ সালে আইন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার পর মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর দমন নিপীড়ন শুরু করে। এরপর নানা অজুহাতে রোহিঙ্গাদের ওপর নেমে আসে বর্বর নির্যাতন। গত ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সাল থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসা শুরু করে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর এবং ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ভয়াবহ নির্যাতন শুরু করে। ফলে নিপীড়নের মুখে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়। কিন্তু এবার প্রায় ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে। নতুন-পুরনো মিলিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংখ্যা এখন ১১ লাখ ১৬ হাজার ৪১৭ জন। এর বাইরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রায় তিন লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা।

রোহিঙ্গা সুলতার আহমদ, আয়েশাবেম, মনোয়ারা বেগম, ইলিয়াছ আলীসহ অনেকে বলেন, রোহিঙ্গা নিধন, ধর্ষণ ও হত্যাকারী মিয়ানমারের সরকারের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের পাশাপাশি নিরাপদ প্রত্যাবাসন করা হোক। নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গারা ফেলে আসা জমি, বাড়িঘর, ধন-সম্পদ, মৎস্য খামার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ফেরতের পাশাপাশি মিয়ানমারের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে এলে কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আর বসে থাকবে না। এ দিনে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতায় রোহিঙ্গাদের ওপর নেমে আসে অমানসিক নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ নিপীড়ন। এসব সয্য করতে না পেরে রোহিঙ্গারা বাধ্য হয়ে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসেন। আগেরসহ সব মিলিয়ে উখিয়া-টেকনাফের ৩০টি ক্যাম্পে প্রায় ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। এসব রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন না হওয়ায় স্থানীয়দের ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।

সমাবেশে বক্তারা ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইনে গণহত্যা, ধর্ষণসহ বর্বর নির্যাতনের নিন্দা এবং জড়িত সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থি মগদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের দাবি জানান। একই সঙ্গে স্বাধিকার নিয়ে স্বদেশে ফেরার আকুতিও জানান রোহিঙ্গারা। এজন্য বিশ্ববাসীকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক মর্যাদাসহ দাবিকৃত ৫টি শর্ত মেনে নিতে মিয়ানমার সরকারকে জোরালোভাবে চাপ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। পরে নির্যাতন ও নিপীড়নে নিহতদের মাগফিরাত কামনা ও নিজেদের শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল মনসুর জানান, সকাল থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো শান্তিপূর্ণভাবে এ সমাবেশ করে শরণার্থী রোহিঙ্গারা। সমাবেশে প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা উপস্থিত ছিলেন।

সমাবেশ উপস্থিত ছিলেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস নামক সংগঠনের চেয়ারম্যান মুহিব উলস্নাহ ও জেনারেল সেক্রেটারি সৈয়দ উলস্নাহ। অন্য রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দের মধ্যে নূর হাকিম, মো. কামাল, আব্দুর রহিম, নূর আলম, নারী নেত্রী হামিদা প্রমুখ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে সকাল থেকে দলে দলে বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুন ও নানা স্স্নোগান নিয়ে সমাবেশস্থলে আসতে থাকে বিভিন্ন ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা। তাদের নানা স্স্নোগানে মুখরিত ছিল পুরো রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকা। এখানে ছাড়াও উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, টেকনাফের উনচিপ্রাংসহ বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রাখাইনে সংগঠিত গণহত্যার বিচারের দাবিতে সমাবেশ হয়েছে। সমাবেশগুলোতেও নাগরিকত্ব এবং ভিটেমাটি ফিরিয়ে দিয়ে প্রত্যাবাসন দাবি করা হয়।

উলেস্নখ্য, রোববার রোহিঙ্গা সংকটের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। ২০১৭ সালের এ দিনে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে। এরপর থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গারা। বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় সোয়া ১১ লাখ। এসব রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে অবস্থান করছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<64047 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1