মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
সাতক্ষীরায় এক গৃহবধূর মৃতু্য

মশক নিধনে হাঁকডাক নিয়ন্ত্রণে আসেনি ডেঙ্গু

ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত গৃহবধূ শাহানারা খাতুনকে শুক্রবার রাত ৩টার দিকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল থেকে খুলনা মেডিকেলে নেয়ার পথে তিনি মারা যান
ফয়সাল খান
  ২৪ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০
রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই ভর্তি হচ্ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। ছবিটি শুক্রবার ন্যাশনাল হাসপাতাল থেকে তোলা -যাযাদি

রাজধানীসহ সারাদেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ায় মশক নিধন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে নানা তৎপরতা শুরু করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের দিক নির্দেশনার আলোকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সেল গঠন, মশার ওষুধ পরিবর্তন, নতুন মেশিন ক্রয়, লার্ভা নিধনে অভিযান-জরিমানা, ওয়ার্ডভিত্তিক অতিরিক্তকর্মী নিয়োগসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডেঙ্গু। নতুন রোগী ভর্তির সংখ্যা পূর্বের তুলনায় কিছুটা কমলেও প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজারের মতো ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বেশ কয়েকটি সংস্থা ডেঙ্গুর ব্যাপারে আগাম সতর্ক করলেও, তখন বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি নগর কর্তৃপক্ষ। শেষ মুহূর্তে ভয়াবহ আকারে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়লে মশক নিধনে তোড়জোড় শুরু করে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কিন্তু এতে তেমন সুফল মেলেনি। কমেনি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। থামছে না মৃতু্য।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, শুক্রবার পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬১ হাজার ৩৮ জন। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন মোট ১৪ হাজার ৪৪৬ জন। তাদের হিসাবে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৪৭ জন। যদিও বেসরকারি হিসাবে মৃতু্যর সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, আগামী এক সপ্তাহের আবহাওয়ার গতিবিধি পর্যালোচনা না করে ডেঙ্গু পরিস্থিতির উন্নতি বা অবনতির ব্যাপারে কিছু বলা যাচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতির উন্নতি হবে, না অবনতি হবে তা নির্ভর করছে আবহাওয়ার ওপর। আবহাওয়া পরিবর্তন না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে। আর আবহাওয়া পরিবর্তন হলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পস্ন্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান যায়যায়দিনকে বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি অনেক আগেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ভারী বর্ষণ হলেও মশার লার্ভা ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু এবার তেমন ভারী বর্ষণও হচ্ছে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ব গবেষক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গুর সাইকেলে আগস্টের বাকি সময় খুবই কঠিন হতে পারে। এজন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে। শুধু সড়কে নয়, মানুষের বাসাবাড়িতে ঢুকেও ফগিং করে বড় মশা নিধন করতে হবে। নগরবাসীকে ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে নিজেদেরও মশার কামড় থেকে বেঁচে থাকতে হবে উলেস্নখ করে তিনি আরও নিজেদের সুরক্ষার জন্য স্প্রে, ক্রিম, অ্যারোসল ব্যবহার করা যেতে পারে। সরকারি দপ্তরগুলোতে যাতে কোনোভাবে মশার প্রজনন না হতে পারে, এ ব্যাপারে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে। কেননা, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করাই প্রধান কাজ।

এ ব্যাপারে কীটতত্ত্ব গবেষক ড. এ কে আজাদ বলেন, ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। মশার কামড় থেকে বাঁচতেই হবে। এজন্য প্রটেকশন হিসেবে বাসা-বাড়িতে সব সময় কয়েল, ভ্যাবারাইজার, অ্যারোসল ব্যবহার করা যেতে পারে। তিনি বলেন, বাসা-বাড়ির পর্দা ও ওয়্যারড্রপ নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

এদিকে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, এরইমধ্যে এডিস মশা নিধন করতে অধিক কার্যকর ওষুধ আমদানি করা হয়েছে। এসব ওষুধ নিয়মিত ছিটানো হচ্ছে। মশার লার্ভা ধ্বংসে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশার লার্ভা খুঁজছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কোনো বাসায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে ওই বাড়ির মালিককে জেল জরিমানাও করছে সংস্থা দুটি।

নিজেদের এলাকাকে পরিচ্ছন্ন রাখতে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করছে ডিএনসিসি। প্রতিটি ওয়ার্ডকে ১০ ভাগে ভাগ করে এ অভিযান চালাচ্ছে তারা। এর জন্য প্রতি ওয়ার্ডে মাস্টাররোলে অতিরিক্ত ৩০ জন পরিচ্ছন্নকর্মী নিয়োগ দিয়েছে। আগামী এক মাস এই কর্মীরা দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে কাজ করবেন। তাদের মধ্যে ১০ জন কর্মী পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাবেন, ১০ জন বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশার লার্ভা ধ্বংস করবেন এবং বাকি ১০ জন কচুরিপানা পরিষ্কারের কাজ করবেন।

ডিএনসিসি নিয়মিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে মশক নিধন ও পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমকে আরও জোরালো করেছে। আর প্রতি ওয়ার্ডে গঠিত ১০ জনের পরিচ্ছন্ন দল দৈনিক ৫০টি করে বাসাবাড়িতে ঢুকে মশার উৎপাদন স্থান ধ্বংস করছে। এরপরও যারা সচেতন হচ্ছে না, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এ কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকে পাঁচজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়েছে ডিএনসিসি এবং ডিএসসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রটের পাশাপাশি পাঁচ আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছেন।

বৃহস্পতিবার ২৬১ বাড়ি পরিদর্শন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এরমধ্যে ১৮টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা থাকায় ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমনা করে। একইদিনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ১১৮টি বাড়িতে অভিযান চালায়। এতে ৪৪ হাজার টাকা জরিমানা করে সংস্থাটির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এ পর্যন্ত ৫৮ হাজার ৭৪৮ বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৩৮ লাখ টাকা জরিমানা করেছে ডিএসসিসি।

গত ২৪ জুলাই থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এডিস মশার লার্ভা শনাক্তের অভিযান শুরু করে ডিএনসিসি। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সংস্থাটির ভ্রাম্যমাণ আদালত দুই হাজারের বেশি বাড়ি পরিদর্শন করে ১৫১টি বাড়িতে এডিস মাশার লার্ভা শনাক্ত করেছেন। এসব বাড়ির মালিকদের ৫৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এর পাশাপাশি তাদের সতর্ক করতে 'এই বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে' লেখাযুক্ত লাল স্টিকার লাগিয়ে দেয়। পরবর্তীতে স্টিকার লাগানো বাসায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে জেল-জরিমানা করা হবে বলেও সতর্ক করা হয়। তাছাড়া চলতি মাসে বাণিজ্যিক ও নির্মাণাধীন ভবনে অভিযান চালিয়ে এডিস মশার লার্ভা থাকার দায়ে ১৩৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয় সংস্থাটি।

এ প্রসঙ্গে আলাপকালে ঢাকা মহানগরীতে এডিস মশার লার্ভা শনাক্তের অভিযান পরিচালনাকারী একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যায়যায়দিন জানান, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করা হচ্ছে। বিশেষ করে নির্মাণাধীন ভবনগুলোতে এডিস মশার লার্ভা বেশি পাওয়া যাচ্ছে। জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। অনেক সময় বাড়ির মালিকরা প্রভাবশালী থাকায় কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। নানা মহল থেকে অনেক চাপও আসে। মানুষ নিজেরা সচেতন না হলে এডিস মশার বিস্তার রোধ করা কঠিন বলে জানান তিনি।

ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল হাই বলেন, মৌসুমের বাকি সময়ের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চিরুনি অভিযান শুরু করা হয়েছে। এই অভিযান মাসব্যাপী চলবে। ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগসহ সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মৌসুমের বাকি সময়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে 'ফোর টেকনিক' কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করেছে ডিএসসিসি। আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলমান থাকবে। এরপর পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

সাতক্ষীরায় ডেঙ্গুজ্বরে গৃহবধূর মৃতু্য

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, সাতক্ষীরায় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে শাহানারা খাতুন (৩৭) নামে আরও এক গৃহবধূর মৃতু্য হয়েছে। শুক্রবার রাত ৩টার দিকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল থেকে খুলনা মেডিকেলে নেয়ার পথে তার মৃতু্য হয়। শাহানারা খাতুন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কুশখালী গ্রামের খলিলুর রহমানের স্ত্রী। এ নিয়ে সাতক্ষীরায় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে দুইজনের মৃতু্য হয়েছে।

শাহানারা খাতুনের দেবর জিয়াউর রহমান জানান, গত ১৮ তারিখে তার ভাবী ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হলে তাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। রাত ৩টার দিকে তার অবস্থার অবনতি হলে তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানে নেয়ার পথে তার মৃতু্য হয়।

সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আসাদুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে ২২ আগস্ট বিকালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে খুলনার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃতু্যবরণ করে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার শ্রীকলা গ্রামের মাদ্রাসাছাত্র আলমগীর গাজী।

এদিকে, সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. আবু শাহিন জানান, সাতক্ষীরায় শুক্রবার পর্যন্ত মোট ৩০৮ জন ডেঙ্গু রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ভর্তি রয়েছে ৫১ জন। চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন আর ২১৭ জন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<63719 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1