বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এডিস লার্ভা নিধনে বড় চ্যালেঞ্জ

সাখাওয়াত হোসেন
  ২২ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০
রাজধানীর জুরাইন ওভার ব্রিজের নিচে ময়লার স্তূপ ও বৃষ্টির পানি জমে এডিস মশার প্রজনন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছবিটি বুধবার তোলা -যাযাদি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা সম্প্রতি ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন অফিস-আদালত, কল-কারখানা, হাসপাতাল-ক্লিনিক, বাস টার্মিনাল, থানা ক্যাম্পাস, নির্মাণাধীন ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট সংস্কার প্রকল্পসহ যেসব জায়গায় জরিপ চালিয়েছে, এর বেশিরভাগ স্পটেই ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বিস্তর লার্ভা পেয়েছে। তাদের জরিপে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭৮ শতাংশ এলাকায় এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৮ শতাংশ এলাকায় অতিমাত্রায় এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি রয়েছে। এ চিত্র থেকে বলা যায়, রাজধানীর ঘরে ঘরে এডিস মশার লার্ভা ছড়িয়ে পড়েছে। যা শুধু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রচেষ্টায় নিধন করা অসম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, শুধু ঢাকা মহানগরীর লার্ভা নিধন কার্যক্রম সফল হলেই ডেঙ্গু প্রকোপ কমবে- এমন আশা করা বোকামি। কেননা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে গণপরিবহন ও মালবাহী যানবাহনসহ নানা মাধ্যমে এডিস মশা খুব সহজেই ঢাকায় আসতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন কনটেইনারে জমে থাকা এডিস মশার ডিম ও লার্ভা পরিবহনের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই লার্ভা নিধনে ঢাকা মহানগরীর পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও গ্রাম-গঞ্জ সবখানেই একযোগে অভিযান চালানো জরুরি।

অথচ এ নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল দূরে থাক, জেলা শহরেও এখনো কোনো তৎপরতা শুরু হয়নি। স্বল্পসংখ্যক জেলায় ডিসিদের উদ্যোগে এডিস মশা ও লার্ভা নিধনে সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নেয়া হলেও তা এখনো নথিপত্রেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় লার্ভা নিধনের মাধ্যমে সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ করা সত্যিকার অর্থেই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেন কীটতত্ত্ববিদরা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কীটতত্ত্ববিদ মো. খলিলুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, 'বিষয়টি মূলত জেলা প্রশাসনের নিজ উদ্যোগের ব্যাপার। তবে আমার জানা মতে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মতো দেশের সব সিটি করপোরেশন ও জেলা-উপজেলায় মশার লার্ভা ধ্বংসের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে মশা নিধনে গণসচেতনতা তৈরি করতে উপজেলা, পৌরসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনদের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যেখানে মশার উপদ্রব বেশি সে সব প্রজনন স্থান ধ্বংস করতে প্রয়োজনীয় কীটনাশক ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কারিগরি সহযোগিতা দিতে বলা হয়েছে।' এ লক্ষে অধিকাংশ জায়গায় কাজও শুরু হয়েছে বলে দাবি করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই কীটতত্ত্ববিদ।

তবে আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে লার্ভা নিধনে কার্যক্রম শুরুর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনরাও এ তৎপরতা সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির কথা জানাতে পারেননি। তবে কোনো কোনো সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা লার্ভা নিধনে শিগগিরই সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানান।

এদিকে এডিস মশার লার্ভা নিধন অভিযানে নেমেই ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে। মহানগরীর বিশাল এলাকায় এডিস মশার যে বিস্তীর্ণ প্রজনন ক্ষেত্র রয়েছে তা কতদিনে তারা ধ্বংস করতে পারবে তা নিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছে। লার্ভা নিধন অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, তারা যেখানেই অভিযান চালাচ্ছে, সেখানেই কমবেশি এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র মিলছে। এ অবস্থায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও এ কাজে সফলতা আনা দুরূহ। কেননা মহানগরীর এক একটি ওয়ার্ডের এক প্রান্ত থেকে লার্ভা নিধন অভিযান শুরু করে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছতে অন্তত দেড়-দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। অথচ যে কোনো প্রজনন ক্ষেত্রেই ৩ দিনে এডিস মশার লার্ভা জন্মাতে পারে। এছাড়া মহানগরীর প্রতিটি মহলস্নার বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রজনন ক্ষেত্র শনাক্ত এবং এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করা সিটি করপোরেশনের পক্ষে অনেকটাই অসম্ভব।

লার্ভা নিধন অভিযানে অংশ নেয়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা জানান, দিনের বেলায় পরিবারের সদস্যরা অফিস-আদালতসহ বিভিন্ন কর্মস্থল বা স্কুল-কলেজে থাকায় ঢাকা শহরের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়ি তালাবদ্ধ থাকে। আবার অনেক বাড়িতে গৃহপরিচারিকা থাকলেও তাদের বাইরে থেকে তালা দিয়ে রেখে যাওয়া হয়। এছাড়া অভিযান চালানোর খবর পেয়ে অনেক গৃহকর্তা বাড়ির মেইন গেটই খুলতে চান না। এ অবস্থায় কোনো এলাকাতেই ধারাবাহিকভাবে প্রতিটি বাসা-বাড়িতে অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। অথচ কোনো অ্যাপার্টমেন্টের একটি ফ্ল্যাটে এডিস মশার কোনো প্রজনন ক্ষেত্র থাকলে সেখানকার লার্ভা থেকে জন্ম নেয়া এডিস মশা শুধু ওই ভবনই নয়, গোটা এলাকার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। কেননা ভ্রূণ-পূর্ণতাপ্রাপ্ত ডিম পানির সংস্পর্শ ছাড়াই এক বছর পর্যন্ত জীবন্ত থাকে। পানি পেলেই ফুটে লার্ভায় পরিণত হয়। তাই দীর্ঘমেয়াদে ডেঙ্গুর প্রকোপের ঝুঁকি থেকেই যায়।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৩ এর নির্বাহী কর্মকর্তা মীর নাহিদ আহসান যায়যায়দিনকে বলেন, লার্ভা নিধন অভিযানে বাড়ি মালিকরা অনেকে অসহযোগিতা করছেন। কোথাও কোথাও পরিষ্কার করতে গেলে, ওষুধ দিতে গেলে সিটি করপোরেশন কর্মীদের প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। তাদের সঙ্গে পরিচয়পত্র থাকলেও কেউ কেউ নিরাপত্তার অযুহাত দেখাচ্ছেন। এ অবস্থায় অনেক বাসায় ঢুকতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সহায়তা নিতে হয়। এতে লার্ভা নিধন অভিযান জোরদার করা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবর রহমান জানান, ডেঙ্গুসহ আরও কয়েকটি রোগের ভাইরাস বাহক এডিস মশার লার্ভা ও পিউপা পানিতে বাস করে আর ডিম ও পূর্ণাঙ্গ মশা শুকনো জায়গায় বিচরণ বা বাস করে। এই মশা বসতবাড়ি অথবা বিভিন্ন স্থাপনার কাছাকাছি কৃত্রিম কনটেইনার যেমন টায়ার, ক্যান, ড্রাম, ফুলের টব বা অনুরূপ পাত্র এবং প্রাকৃতিক পাত্র যেমন কাটা ডাবের খোলস, ছোট লেক, নার্সারির টব ইত্যাদিতে প্রজনন ঘটায়। পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী এডিস ফার্টিলাইজড (নিষিক্ত) হলে প্রজননের জন্য ওইসব পাত্রের নিচের অংশে পানি থাকলে এবং পাত্রের ওপরের খালি অংশ শুকনো থাকলে পাত্রের সেই খালি অংশের ভেতরের গায়ে এক মিলিমিটার লম্বা সিগার আকৃতির একটি করে ১০০ থেকে ২০০ ডিম পাড়ে। আর্দ্র ও উষ্ণ আবহাওয়ায় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এবং ঠান্ডা আবহাওয়ায় পাঁচ দিনের মধ্যে ভ্রূণের পূর্ণতা ঘটে এবং ডিম পানির সংস্পর্শে এলেই এক থেকে দুই দিনের মধ্যে লার্ভায় (রিগলার) পরিণত হয় এবং পানিতে ভাসতে থাকে। যদি কোনো কারণে ভ্রূণ-পূর্ণতাপ্রাপ্ত ডিম পানির সংস্পর্শে না আসতে পারে এবং শুকিয়ে যায় সে অবস্থায়ও এক বছর পর্যন্ত জীবন্ত থাকে। পানি পেলেই ফুটে লার্ভায় পরিণত হয়।

লার্ভা প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে দুর্বল প্রকৃতির থাকে। এরা কিছু শুকনো আবহাওয়ায়ই মারা যায়। আর অতি বৃষ্টিপাত বা বৃষ্টির পানিতে বন্যা হলে এরা সম্পূর্ণ মারা যায়। কিন্তু চতুর্থ পর্যায় ধীরে খোলস বদলায়, বাড়তে কিছু বেশি সময় নেয়। এরা ভারি বৃষ্টিপাতেও কম মরে। লার্ভা উপযুক্ত আবহাওয়ায় (আর্দ্র এবং উষ্ণ) সাধারণত পাঁচ দিনে এবং শুকনো ও ঠান্ডা আবহাওয়ায় সর্বোচ্চ সাত থেকে ১৪ দিনে পিউপা বা পুত্তলিতে পরিণত হয়। পুত্তলি দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ পোকায় পরিণত হয়। স্ত্রী ও পুরুষ পূর্ণাঙ্গ পোকা পুত্তলি থেকে বের হওয়ার এক দিন পরই মিলন ঘটায় এবং ডিম পাড়তে পারে। তবে পূর্ণাঙ্গ মশা বেশি দূরে ওড়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে না। গ্রাভিড (ফার্টিলাইজড) স্ত্রী মশা এক থেকে সর্বোচ্চ তিন কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত ওড়ে, পুরুষ মশা বেশি দূর উড়তে পারে না। এরা কনটেইনারের ডিম ও লার্ভা পরিবহনের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

এদিকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন লার্ভা নিধনে চিরুনি অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামলেও বাস্তবিক অর্থে তা কতটা কার্যকর তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছেন। খোদ উচ্চ আদালতই এডিস মশা ও লার্ভা নিধনে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

অন্যদিকে যেসব এলাকায় সরকারি স্থাপনা, কল-কারখানা ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে এখনো এডিস মশার বিস্তীর্ণ প্রজনন ক্ষেত্র রয়েছে ওইসব এলাকার বাসিন্দারা সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম নিয়ে রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

রাজধানীর শ্যামপুর, কদমতলী, রায়েরবাগ, দনিয়া ও শেখদি এলাকার বাসিন্দারা জানান, সেখানে এখনো এডিস মশার অসংখ্য প্রজনন স্থান রয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন এসব প্রজনন স্থান ধ্বংস করছে না। সরকার গঠিত কমিটির সদস্যরা শুধু বাসবাড়িতে ঘুরে ঘুরে মশার লার্ভা অনুসন্ধান করছেন। যদিও সে সব ধ্বংসে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। এ ধরনের অভিযানের ফলাফল শূন্য বলে মন্তব্য করেন তারা।

এদিকে কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর চৌধুরী বলেন, 'এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে না আসার একমাত্র কারণ মশার প্রজনন স্থান ধ্বংস করতে না পারা। এডিস নির্মূলে যেসব কর্মসূচি জোরদার করা প্রয়োজন, সেগুলো যদি সঠিকভাবে করা সম্ভব না হয়, তাহলে পরিস্থিতি কী হবে বলা মুশকিল।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<63410 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1