বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কয়লা উত্তোলনে কচ্ছপ গতি

বিষয়টি এখনো পরিকল্পনা ও গবেষণায় সীমাবদ্ধ
হাসান আরিফ
  ১৬ জুলাই ২০১৯, ০০:০০
কয়লা উত্তোলনের চিত্র -ফাইল ছবি

দেশের জ্বালানি চাহিদার একটা বড় অংশ মেটানো হচ্ছে আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে। অথচ দেশের আবিষ্কৃত খনির কয়লা উত্তোলনের বিষয়টি এখন পর্যন্ত পরিকল্পনা আর গবেষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। শুধু বড়পুকুরিয়া খনি থেকে ২০০৫ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। বাকি চার খনির বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।

দেশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত পাঁচটি কয়লা খনি হচ্ছে- দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া, একই জেলার ফুলবাড়ি ও দীঘিপাড়া, রংপুরের খালাসপীর এবং জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ। আবিষ্কৃত এই পাঁচ কয়লা খনির মজুদের পরিমাণ ৭ হাজার ৫৬৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। যা তুললে কয়লার বিদেশনির্ভরতা থাকবে না। সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা।

বিদু্যৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কয়লার ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা বিবেচনা করে বড়পুকরিয়া খনি থেকে কয়লা তোলা বাড়ানোর জন্য সমীক্ষা করা হয়েছে। সমীক্ষা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে খনির সেন্ট্রাল বেসিন-সংলগ্ন উত্তর ও দক্ষিণাংশে খনি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এই সম্প্রসারণের ফলে উভয় অংশ থেকে আলাদাভাবে বছরে প্রায় ০ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব হবে। এর পাশাপাশি বড়পুকরিয়া খনির উত্তরাংশে এই পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের জন্য এটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি স্টাডি প্রকল্প গ্রহণ কার্যক্রম চলমান আছে বলেও এই সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।

খনিজ সম্পদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে নিশ্চিত করেছেন, দীঘিপাড়া কয়লা ক্ষেত্র উন্নয়ন প্রকল্পটি চলমান রয়েছে। তবে ভৌত কাজ চলতি মাসে শেষ হওয়ার সময়সীমা নির্ধারণ করা আছে। এই ক্ষেত্র থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু হলে বছরে ৩ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব হবে।

কয়লার উৎপাদন বাড়াতে ফুলবাড়ী কয়লা খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের কোনো পরিকল্পনা আছে কী না জানতে চাইলে বিদু্যৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এ বিষয়ে নতুন করে সরকার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিডেট (বিসিএমসিএল) সূত্রে জানা গেছে, দীঘিপাড়া কয়লা খনি চালু হলে প্রথম পর্যায়েই এক হাজার মেগাওয়াটের একটি বিদু্যৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে, যাতে ব্যয় হবে ৩০ হাজার কোটি টাকা। যার স্থায়িত্বকাল ধরা হয়েছে কমপক্ষে একশ বছর।

জানা গেছে, বাংলাদেশের ভূ-গর্ভস্থ কয়লা সম্পদের অস্তিত্ব প্রথম প্রমাণিত হয় ১৯৫৬ সালে বগুড়ার তেল অনুসন্ধান খননকাজ চালনোর মাধ্যমে। এই খননকাজের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ১৯৬১ সালে জাতিসংঘের সহায়তায় পরিচালিত হয় খনিজ সম্পদ জরিপ। আবিষ্কৃত হয় জামালগঞ্জের কয়লা। কিন্তু গভীরতার কারণে এবং বিভিন্ন অর্থ ও কারিগরি সমস্যার কারণে জামালগঞ্জ কয়লা খনিটি উন্নয়নের মুখ দেখেনি। এরপর বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) তাদের অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে যায়। ১৯৮৫ সালে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার ও ফুলবাড়ীর পার্শ্ববর্তী বড়পুকুরিয়ায় ভূপৃষ্ঠের ১১৯ মিটার থেকে ৫০৬ মিটার গভীরতায় আবিষ্কৃত হয় কয়লা। মাত্র ৬ দশমিক ৬৮ বর্গকিলোমিটার সমীক্ষিত ও মূল্যায়নকৃত এলাকায় এখানে কয়লার মজুদের পরিমাণ ৩৯০ মিলিয়ন মেট্রিক টন। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে রংপুরের খালাসপীরে আবিষ্কৃত হয় আরেকটি কয়লা ক্ষেত্র। এখানে ১২ দশমিক ৫৬ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভূপৃষ্ঠের ২৫৭ থেকে ৪৮৩ মিটার গভীরতায় কয়লার মোট মজুদ রয়েছে ৬২৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এরপর দিনাজপুরের দিঘিপাড়ায় ১৯৯৪ সালে এবং ফুলবাড়ীতে ১৯৯৭ সালে আরও দুটি কয়লা ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। তবে এই দুটি কয়লা ক্ষেত্রের মজুদ বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির চেয়ে প্রায় ১০ গুণ। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলের যে কয়টি কয়লা ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে বড়পুকুরিয়া কয়লা ভূপৃষ্ঠের স্বল্প গভীরতায় অবস্থিত। বড়পুকুরিয়ার কয়লা ক্ষেত্রে যে পরিমাণ কয়লা মজুদ রয়েছে তাপজনক ক্ষমতার দিক থেকে মোট ৩০ দশমিক ৪৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাসের সমপরিমাণ। বড়পুকুরিয়ার কয়লা উন্নত (বিটুমিনাস) মানের। এতে সালফারের পরিমাণ অতি নগণ্য। এর তাপজনন ক্ষমতা ১১০৪০ বিটিইউ/ পাউন্ড।

সূত্র জানায়, দেশের জ্বালানি শক্তি বিদু্যতের শতকরা ৮০ ভাগ উৎপাদিত প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের ম্যধমে। এই প্রেক্ষাপটেই স্বল্প গভীরতায় প্রাপ্ত বড়পুকুরিয়া প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। বিদু্যৎ উৎপাদনের জন্য কয়লার বিকল্প ব্যবহার গ্যাসের ব্যবহারের ওপর চাপ উলেস্নখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে সহায়ক হবে। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে বছরে ১০ লক্ষ টন কয়লা উৎপাদন হয়। এই খনির মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ৬৪ বছর। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে উৎপাদিত কয়লার ওপর ভিত্তি করে খনির পশ্চিম দিকে ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি পস্ন্যান্ট নির্মাণ করা হয়েছে। এই তাপবিদু্যৎ কেন্দ্রে প্রতি বছর আনুমানিক ০ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন টন কয়লা ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ। অবশিষ্ট ০ দশমিক ১৭ মিলিয়ন টন কয়লা ইটের ভাটা, শিল্প, বাণিজ্য এবং গৃহস্থালিসহ অন্য কাজে ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ।

জানা গেছে, ১৯৯২ সালের ১১ মার্চ জাতীয় অর্থনীতিক কমিটি (ইসিএন আইসি) ৯১৬ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা (২৫৪ দশমিক ৪৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বিনিয়োগ-সংবলিত বড়পুকুরিয়ার কয়লা খনি উন্নয়ন প্রকল্পের পিসিপি অনুমোদন করে। পরবর্তীতে ৮৮৭ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকা (২২৭ দশমিক ৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। বিনিয়োগ ব্যয়-সংবলিত প্রকল্প ছকটি ১৯৯৩ সালের ২১ এপ্রিল, বিদু্যৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় অনুমোদন করে। জাতীয় অর্থনৈতিক কমিটি (ইসিএনআইসি) ২০০২ সালের ১৫ আগস্টে ১৪৩১ দশমিক ১৩ লক্ষ//// টাকার (২৫১ দশমিক ০৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ব্যয়-সংবলিত প্রকল্পের সংশোধিত পিপি অনুমোদন করা হয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) দেশীয় প্রোগ্রামের আওতায় ১৯৯২ সালে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের স্থান রাখলেও পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন কারণে অর্থায়নে আপারগতা প্রকাশ করে। দাতা দেশ বা অন্য সংস্থার কাছ থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নে সাড়া না পাওয়ায় চীনা সাপস্নাইয়ার্স ক্রেডিটের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ১৯৯৪ সালের ৭ ফেব্রম্নয়ারি পেট্রোবাংলা এবং চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট (সিএমসি)-এর মধ্যে ১৯৪ দশমিক ৯১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ওই বছরের ১ জুন। ১৯৯৪ সালের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১২ কূপ খনন করা হয়। প্রস্তুতি কাজ সম্পন্ন করে ১৯৯৬ সালের ১ জুন খনি নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০০১ সালের জুন মাসে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। কিন্তু ১৯৯৮ সালের ৫ এপ্রিল অপ্রত্যাশিতভাবে ৬০০ ঘন মিটার হারে পানি প্রবাহের কারণে খনির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়। ১৯৯৯ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে আলোচনা করে ২০০০ সালের এপ্রিল মাসে ডিজাইন চুড়ান্ত করা হয় এবং দুপক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০০০ সালের অক্টোবর মাসে পেট্রোবাংলা বোর্ডে ডিজাইন অনুমোদন হওয়ার পর আবার কাজ শুরু হয়। ২০০৪ সালে খনির কাজ শেষ হয়। ২০০৩ সালে অংশিক উৎপাদন শুরু হয়। ২০০২ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে কয়লার উৎপাদন শুরু হয়। এখানে ২৬৭৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যক্ষভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৯৪ সালের ২৭ জুন দেশের প্রথম খনি হিসাবে এর যাত্র শুরু হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<58474 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1