মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
ব্যাংক-পুঁজিবাজারে মুচকি হাসি

সঞ্চয়পত্র গ্রাহকদের নীরব কান্না

সাখাওয়াত হোসেন
  ২৭ জুন ২০১৯, ০০:০০

নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো না হলেও সরকার আগামী পহেলা জুলাই থেকে এর মুনাফার ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ কেটে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়ায় ব্যাংক উদ্যোক্তা ও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মুখে মুচকি হাসি দেখা দিয়েছে। তাদের আশা, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের আয়কর নিবন্ধনের তালিকায় আনার উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেটে উৎসে কর বৃদ্ধি করায় এ খাতে বিনিয়োগ বেশখানিকটা কমবে। সঞ্চয়কারীদের একটি বড় অংশ এখন ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের দিকে ঝুঁকবে। এতে ব্যাংকগুলোর চলমান তারল্য সংকট কমার পাশাপাশি শেয়ারবাজারের মন্দা দশাও কাটবে।

তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর দ্বিগুণ করার ইসু্যটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে সীমিত আয়ের গ্রাহকরা রীতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়েছে। সংসারের কোন খাতের ব্যয় কমিয়ে তারা এ ঘাটতি পূরণ করবেন তা ভেবে অনেকের রাতের ঘুম উধাও হয়ে গেছে। কেউ কেউ এ নিয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন।

এদিকে উৎসে কর বাড়ানোর ঘোষণায় ব্যাংক উদ্যোক্তা ও শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা খুশি হলেও এ সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বলে মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরাও। তারা বলছেন, এর ফলে স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের সঞ্চয়ের পথ সংকুচিত হয়ে পড়বে। সংসারের ঘাটতি মেটাতে দিশেহারা সঞ্চয়কারীদের অনেকে ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগে উৎসাহী হয়ে উঠবে। এতে সঞ্চয়ের একটি বড় অংশ শক্তিশালী প্রতারক সিন্ডিকেটের হাতে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। যার ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব সামাজিক অর্থনীতিতে পড়তে পারে বলে অভিমত অর্থনীতিবিদদের।

যদিও এ ধরনের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন ব্যাংক উদ্যোক্তরা। তাদের ভাষ্য, সঞ্চয়পত্র বিক্রি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই সরকারকে এ ঋণ বহন করতে হচ্ছে; গুনতে হচ্ছে সুদ। এতে সরকার চাপের মুখে পড়ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে পাল্টা আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।

যদিও 'ঘাটতি বাজেট' প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএস'র সাবেক মহাপরিচালক এমকে মুজেরি বলেন, সাধারণত সঞ্চয়পত্রের সুদহার বেশি ও ব্যাংকের কম। ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে বেশি ঋণ নিলে সুদ বেশি গুনতে হবে। যে কারণে সরকার এ খাত থেকে ঋণ নেয়া কমিয়েছে। তবে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নেয়া হলে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বেসরকারি ঋণে। এতে বেসরকারি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ বেসরকারি উদ্যোক্তারা পর্যাপ্ত ঋণ না পেলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। তিনি আরও বলেন, ঋণ গ্রহণ করলে সেটি যেন উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার হয় সেদিকে সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। তাহলে ঋণ নেয়ার বিরূপ প্রভাব কাটাতে পারবে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, সঞ্চয়পত্র নিয়ে নানাজন নানা কথা বলছে। সঞ্চয়পত্র সরকারের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, এর সুদের হার বেশি- এসব অযৌক্তিক যুক্তি। সঞ্চয়পত্র পৃথিবীর সব দেশেই আছে। বিশেষ করে যারা নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তরা সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্যই সরকার এ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সাধারণ মানুষদের জন্য এটি একটি ইতিবাচক উদ্যোগ ছিল।

সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই যৌক্তিক হয়নি দাবি করে বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ বলেন, 'সঞ্চয়পত্র যারা কিনে তারা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ। উৎসে কর দ্বিগুণ করা হলে তাদের আয় আরো কমে যাবে। তাই সরকার যেটা করতে পারে তা হলো, অবস্থাসম্পন্ন যেসব লোক সঞ্চয়পত্র কিনছে, তাদের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে টিআইএন বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। তবে কোনোভাবেই সঞ্চয়পত্রে উৎস কর বাড়ানো ঠিক হবে না। এতে স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের বিনিয়োগের পথ আরো সংকুচিত হয়ে পড়বে।'

সঞ্চয়পত্রের কারণে সরকারের ঋণের খরচ বেড়ে গেছে, ইন্টারেস্ট রেট বেড়ে গেছে- এসব আর্গুমেন্ট অযৌক্তিক দাবি করে তিনি আরো বলেন, 'সরকারের কাজ ঋণ করা, সরকার তো ঋণ করবেই। আর সঞ্চয়পত্র কেনা দোষ হয়ে গেছে তা তো না। দরকার হলে সরকার কম ঋণ করবে। আর ঋণ করলে যদি সুদ বেশি হয়, দেখতে হবে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারকে কর দিচ্ছে। গরিবরা ইন রিটার্ন সরকারকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে। এই সুদের হার বাড়ানোটা আমি মনে করি একটি দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করবে।'

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সঙ্গে ব্যাংক ডিপোজিট কমে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই দাবি করে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকে যারা ডিপোজিট রাখেন তারা অল্প টাকা রাখেন; বিশেষ কাজে রাখেন। এটা তারা তাৎক্ষণিক খরচ করেন না। সাংসারিক কাজে লাগানোর জন্য কিংবা সন্তানের লেখাপড়ার কাজে লাগাতে তারা এটি ডিপোজিট রাখেন। সুতরাং এটি কোনো যুক্তির মধ্যে পড়ে না। ব্যাংকের ডিপোজিট যখন অনেক বেশি ছিল, তখনো তো অনেক সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। তখন তো ব্যাংকের ডিপোজিট কমেনি। ব্যাংকের ডিপোজিট কমার অনেক কারণ আছে। সুদের হার কম, ব্যাংকের সার্ভিস খারাপ, ব্যাংকের ওপর থেকে মানুষের আস্থা চলে গেছে। সেটার প্রভাব পড়েছে সঞ্চয়পত্রের ওপর।

অর্থনীতিবিদদের এ ধারণা যে অমূলক নয়, তা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিনিয়োগকারীদের অনেকে শেয়ারবাজারকে সরাসরি 'ফটকা বাজার' বলে অভিহিত করেছেন। তাদের ভাষ্য, দেশের শেয়ারবাজার বরাবরই বিশেষ সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি। সরকার নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও তাদের দমন করতে পারেনি। তাই এ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ মানে প্রকারান্তরে জুয়ার বোর্ডে বাজি ধরা বলে মনে করেন তারা।

অন্যদিকে ব্যাংকের স্বল্প-মাঝারি ও দীর্ঘ মেয়াদী আমানত বিনিয়োগে স্বল্প সুদ এবং বেশকিছু ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা তাদের এ খাত বিমুখ করে তুলেছে বলে জানান বিনিয়োগকারীরা।

অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক ওবায়েদ উল্যাহ জানান, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমিজমা এবং পেনশনের টাকা দিয়ে তিনি ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছেন। তা থেকে মাসে ৪৩ হাজার ৭শ' টাকা মুনাফা পেতেন। যা দিয়ে তিনি কোনোরকমে বাড়িভাড়া, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া, নিজেদের ওষুধপত্রসহ সংসাদের অন্যান্য সব খরচ বহন করে আসছিলেন। সামনে সন্তানরা নতুন ক্লাসে উঠলে তাদের টিউশন ফি বাড়বে; পাশাপাশি বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য খরচও বৃদ্ধি পাবে। সব মিলিয়ে তাতে তাল সামলানোই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এর উপর বাড়তি উৎসে কর তাদের কাছে 'বোঝার উপর শাকের আঁটি' হয়ে উঠবে বলে মন্তব্য করেন এই অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক।

একই ধরনের আশঙ্কায় বেশ খানিকটা মুষড়ে পড়েছেন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার বিধবা স্ত্রী ফাতেম খানম জোহরা। ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধা জানান, সঞ্চয়পত্র থেকে প্রাপ্ত মুনাফা-ই তার উপার্জনের একমাত্র উৎস। যা দিয়ে এতদিন তিনি কোনোভাবে সংসার চালিয়ে আসছিলেন। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর নতুন করে আরো ৫ শতাংশ উৎস কর তার জন্য বড় ধরনের 'দুঃসংবাদ' বলে জানান তিনি।

তবে এত দিন যারা ৫ শতাংশ উৎসে কর দিয়ে আসছেন, তাদের জন্য কি এই হার বহাল থাকবে? নাকি নতুন ও পুরোনো সবার জন্যই আগামী ১ জুলাই থেকে ১০ শতাংশ উৎসে কর চালু হবে? তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

যদিও অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেন, শুধু নতুন করে যারা সঞ্চয়পত্র কিনবেন তাদের ক্ষেত্রেই ১০ শতাংশ উৎসে কর কাটা হবে। কেননা পুরোনো বিনিয়োগকারীদের কাছে ৫ শতাংশ কর কেটে রাখার শর্তেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<55524 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1