শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
সমন্বয়হীনতা চরমে

বাজার নিয়ন্ত্রণে চলছে চোর-পুলিশ খেলা!

বাজার মনিটরিংয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ নেই। যে যার মতো করে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এতে সংস্থাগুলোর মধ্যেই উল্টো হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে
সাখাওয়াত হোসেন
  ২০ মে ২০১৯, ০০:০০
এরই নাম ঘি। দেখলে মনে হয় মেজবানের জন্য রান্না করে রাখা ডাল। আসলে এটা রাজধানীর দক্ষিণ গোড়ানের অনিল ঘোষের বাঘাবাড়ী স্পেশাল গাওয়া ঘি। হাইকোর্ট নিম্নমানের এ খাদ্যপণ্যটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করার নির্দেশ দিলেও তার উৎপাদন অব্যাহত রাখায় রোববার ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, ঘি জব্দ এবং কারখানাটি সিলগালা করে দেয় -ফোকাস বাংলা

খাদ্যে ভেজাল রোধ ও ভোগ্যপণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর অপরিকল্পিত কার্যক্রম এবং তাদের ফাঁকি দিতে ব্যবসায়ীদের নানা অপতৎপরতায় রমজানের বাজারে চলছে দিনভর 'চোর-পুলিশ খেলা'। এতে বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ার পরিবর্তে উল্টো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই) ও ভোক্তা অধিদপ্তরসহ বাজার নিয়ন্ত্রণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্র পরিসরের ঝটিকা অভিযানের মুখে হাতে গোনা স্বল্প সংখ্যক ব্যবসায়ী ছোট অংকের জরিমানা গুনলেও তারা এ অর্থের কয়েকগুণ পুষিয়ে নিতে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর অবর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া হাঁকছে। তাই অনিয়ন্ত্রিত বাজারে চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য ক্রয় করতে দিয়ে সাধারণ মানুষের রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠেছে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, বাজার মনিটরিংয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ নেই। তাই সবাই যে যার মতো করে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এ সমন্বয়হীনতার ফলে বাজার নিয়ন্ত্রকারী সংস্থাগুলোর মধ্যেই উল্টো হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব ভীষণভাবে বাজারে পড়ছে। অর্থনীতিবিদদের অভিমত, অজোপাড়াগায়ের এক খন্ড জমিতে কৃষকের উৎপাদিত খাদ্যপণ্য নানা হাত ঘুরে রাজধানীর আড়তে এসে পৌঁছে। সেখান থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পাইকারি দরে কিনে এনে তা রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচা বাজারে খুচরা বিক্রি করেন। এ বিস্তৃত পথের প্রতিটি ধাপেই দুর্নীতি-অনিয়মের পাশাপাশি নানা অব্যবস্থাপনা রয়ে গেছে। তাই নির্ধারিত রোডম্যাপ ধরে এসব বিষয়ের সুরাহা না করে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে শুধুমাত্র খুচরা কাঁচাবাজারে আকস্মিক অভিযান চালালে তাতে বাস্তবিক অর্থে কোনো সুফল আসবে না বলে মনে করেন তারা।

এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করে ভোক্তা প্রতিনিধিরা বলেন, সরকারি গাড়িতে চড়ে দুই-চারজন পুলিশ সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন বাজারে গিয়ে এলোমেলোভাবে দু-চারজন ব্যবসায়ীকে জরিমানা করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। বরং এতে শুধু চারদিকে নতুন করে চোর-পুলিশ খেলাই জমবে।

তাদের এ ধারণা যে একেবারে অমূলক নয়, তা বাজার নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন সংস্থার নানামুখী তৎপরতা এবং পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চিত্র পর্যালোচনা করলেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের অভিযান চলাকালে সকালে যে বাজারে ৪২ টাকা দরে কাঁচা মরিচ বিক্রি করা হয়েছে, অভিযান শেষ হতেই তার দাম এক লাফে বেড়ে ৮০ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। অভিযানের খবর পেয়ে ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানে দোকানে পণ্যমূল্যের তালিকা টাঙালেও ভ্রাম্যমাণ আদালত বাজার থেকে বের হয়ে যেতেই তারা তা খুলে ফেলেছেন। আবার অনেকে সরকার নির্ধারিত পণ্যমূল্যের তালিকা দোকানে ঝুলিয়ে রেখেই তাদের খেয়াল খুশি মতো বাড়তি দরে জিনিসপত্র বিক্রি করছেন।

এ নিয়ে ক্রেতারা কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে ব্যবসায়ীরা উল্টো দল বেধে তার উপর চড়াও হচ্ছেন। রাজধানীর অধিকাংশ বাজারে প্রতিনিয়ত এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। অথচ এ ব্যাপারে ভুক্তভোগীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করতে গেলে তারা পাল্টা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

এদিকে রাজধানীর বেশকিছু কাঁচাবাজারে আরেক ধরনের চিত্র দেখা গেছে। সেখানকার দোকানিরা জানান, দোকানে পণ্যের মূল্য তালিকা টাঙানোর কোনো নির্দেশনা তারা কারো কাছ থেকে পাননি। বিভিন্ন পণ্যের সরকার নির্ধারিত বাজার দর কী তা-ও তারা জানেন না। তারা পাইকারি মার্কেট থেকে বিভিন্ন পণ্য কিনে এনে এর সঙ্গে সামান্য কিছু লাভ যোগ করে তা বিক্রি করেন। পাইকারি বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ালে তারাও খুচরা দর বাড়িয়ে দেন। তবে পাইকারি দাম কমলেও দোকানিরা খুচরা দর অত দ্রম্নত কমাতে পারেন না। এজন্য তাদের আগের কেনা মালের গোটা মজুদ শেষ হতে হয় বলে জানান দোকানিরা।

অন্যদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণে নেমে চোর-পুলিশ খেলার ফাঁদের কথা স্বীকার করেছেন খোদ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারা জানান, তারা মার্কেটের একদিক দিয়ে ঢুকতে না ঢুকতেই অন্যদিকের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো দোকানি দোকান বন্ধ করার সুযোগ না পেলে নিজেই দোকান ফেলে সটকে পড়েন। কোনো কোনো দোকানি আবার ক্রেতা সেজে দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকেন। এতে তাদের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে অভিযান পরিচালনা করা অনেকটাই দুষ্কর হয়ে পড়ে।

গত ১৬ মে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রাজধানীর মিরপুর পাইকপাড়া এলাকায় অভিযান চালায়। তবে খবর পেয়ে 'আরাফাত' ও 'আনন্দ' নামের দুটি বেকারির কর্মীরা কারখানায় তালা লাগিয়ে পালিয়ে যান। পরে অভিযান পরিচালনাকারীরা তালা ভেঙে কারখানার ভেতরে ঢোকেন। নোংরা ও সঁ্যাতসেঁতে পরিবেশে বিভিন্ন বেকারি আইটেম তৈরি করার অভিযোগে কারখানা দুটিকে দেড় লাখ টাকা করে মোট তিন লাখ টাকা জরিমানা করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

এর আগে গত ১২ মে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুলস্নাহ আল মামুন ফার্মগেট এলাকায় অভিযান চালানোর সময় প্রিন্স রেস্তোরাঁর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভেতরে ৫০ জন কাস্টমার রেখে রেস্টুরেন্টের বাইরে থেকে শাটারে তালা ঝুঁলিয়ে দেন। পরে তালা ভেঙে হোটেলে ঢুকে ফ্রিজে বাসি-পচা খাবারসহ কাঁচা মাছ-মাংস ও রান্না করা খাবার একই সঙ্গে সংরক্ষিত অবস্থায় পাওয়া যায়। এছাড়া রান্নাঘরে অস্বাস্থ্যকর ও নোঙরা পরিবেশ দেখতে পায় ভ্রাম্যমাণ আদালত।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দাবি, শুধু এ ধরনের একটি-দুটি ঘটনাই নয়। প্রতিনিয়তই এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। এছাড়া অনেক সময় অভিযানে সহায়তা করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ডাকা হলে তারা এ খবর ফাঁস করে দিচ্ছে। এতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পূর্বনির্ধারিত বাজারে অভিযান চালাতে গিয়ে সেখানকার অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ পাচ্ছে। কালেভদ্রে অভিযান চালিয়ে বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার প্রত্যাশা নেহাৎ বোকামি বলে মনে করেন তারা।

এদিকে মালিবাগ বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানের মূল্যতালিকাগুলো নিয়মিত হালনাগাদ হয় না। তাই এসব নিয়ে মানুষের আগ্রহও নেই। আর এ জন্য মূল্যতালিকা ক্রেতাদের চোখের আড়ালে পড়ে থাকে।

সিটি করপোরেশনের এসব বাজারে মূল্যতালিকা হালনাগাদ করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নিয়মিত বাজারে যানই না বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় ব্যবসায়ীরাই অনেক সময় এ দায়িত্ব পালন করেন। যদিও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।

মালিবাগ কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা এবাদুল হক বললেন, তারা কেউ সিটি করপোরেশনে মূল্যতালিকা দেখেন না। তিনি অভিযোগ করেন, মূল্যতালিকা বাজারের সঙ্গে মিল রেখে করা হয় না। তার ভাষ্য, 'ওই তালিকা দেখলে আমাদের দোকান থুইয়্যা পালানো লাগব। ব্যবসা করতে পারমু না। এইটা বাজারের সঙ্গে মিল রাইখ্যা করা দরকার।'

একই দোকানের পাশে একজন বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওই তালিকা মাঝেমধ্যে হালনাগাদ হয়, তবে সেটি এই বাজারেরই এক দোকানদার করেন। এর জন্য সিটি করপোরেশনের লোক আসে না।

মূল্যতালিকা দেখে বাজার করেন কি না, জানতে চাইলে তালতলা সিটি করপোরেশন কাঁচাবাজারের নিয়মিত ক্রেতা সাহাব উদ্দিন বলেন, 'তিন বছর ধরে এই বাজারে বাজার করছি। কোনোদিন কোনো মূল্যতালিকা চোখে পড়েনি। তবে বাজারের এক কোণে ছোট্ট একটি বোর্ড ঝুলতে দেখেছি।'

তার মতো এই বাজারের অনেক ক্রেতাই মূল্যতালিকা সম্পর্কে কিছু জানেন না। গোড়ানের বাসিন্দা ইকবাল হোসেন এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'এসব মূল্য তালিকা স্রেফ ভাউতাবাজি। কারণ মূল্য তালিকা অনুযায়ী বাজারে পণ্য বিক্রি হয় না। আর এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে কেউ এগিয়ে আসে না।' কারো কাছে এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ করারও সুযোগ নেই বলে জানান তিনি।

মূল্যতালিকা দেখে সবজি বিক্রি করেন কি না, জানতে চাইলে রামপুরা কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা এনামুল মিয়া বলেন, 'তালিকা আছে শুনেছি, কিন্তু দেখার সময় পাই না। আর দশটা দোকানে যে দামে সবজি বিক্রি হয়, আমিও সেই দামে সবজি বিক্রি করি। আর ভ্রাম্যমাণ আদালত বাজারে হানা দিলে তড়িঘড়ি করে দোকান বন্ধ করে দেই।'

বাজারের মূল্যতালিকা না দেখা ও ঠিকমতো হালনাগাদ না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো সদুত্তোর দিতে পারেননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসসিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, 'মূল্যতালিকাটির পণ্যের দামের তালিকা তারা প্রথমে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে পাই। সে অনুসারে প্রতিটি বাজারে আমাদের লোক তালিকা হালনাগাদ করেন। তবে তাদের অনেকেই সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না এমন অভিযোগ আমরাও পেয়েছি।

প্রসঙ্গত, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৩৬টি বাজার আছে। রমজানে এসব বাজার তদারকি করার জন্য তাদের তিনটি কমিটিতে ২০ জন কর্মকর্তা আছেন। এ ছাড়া প্রতিটি আঞ্চলিক জোনের প্রধান নির্বাহীরা আলাদা করে কমিটি করে তদারকি পরিচালনা করেন। অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি সিটি করপোরেশনে ৮৬টি মার্কেট আছে। কোনো কোনো বাজারের নিচে কাঁচাবাজারও আছে।

\হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<50277 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1