বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদযাত্রায় এবার ভোগান্তি বাড়াবে ঢাকার যানজট

ফয়সাল খান
  ১৯ মে ২০১৯, ০০:০০
বুদ্ধপূর্ণিমা উপলক্ষে শনিবার সরকারি ছুটি থাকলেও রাজধানীতে ছিল ভয়াবহ যানজট। বিশেষ করে ইফতারের আগে ঘুরমুখো মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েন। ছবিটি নিউমার্কেট এলাকা থেকে তোলা -যাযাদি

বড় ছুটি ছাড়া রাজধানীর যানজট নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এর উপর বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে সড়কের প্রশস্ততা কমে যানজট বেড়েছে কয়েকগুণ। তাই আসন্ন ঈদে নগরবাসী সড়ক-রেল-নৌ কিংবা আকাশ যে পথেই বাড়ি ফেরার উদ্যোগ নিন না কেন ঢাকার যানজট ঠেলে সময়মতো নির্ধারিত বাহনে উঠতে পারবেন কি না তা নিয়ে ব্যাপক শঙ্কা রয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর মূল সড়কগুলোতে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় যানজট বেড়েছে কয়েকগুণ। রোজার শুরু থেকে প্রায় প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকতে হচ্ছে নাগরিকদের। ঈদুল ফিতরের আগে গাড়ির চাপ আরও বাড়বে। এতে ঘর থেকে বের হয়েই ভোগান্তিতে পড়ার আশঙ্কা করছেন ঈদযাত্রীরা। ফলে সড়ক পথের পাশাপাশি যারা লঞ্চ, ট্রেন বা আকাশ পথে বাড়ি ফিরবেন তারাও রেহাই পাবেন না যানজট থেকে। যানজটে পড়ে নির্ধারিত সময়ের লঞ্চ, ট্রেন বা বিমানের ফ্লাইট মিস করার আশঙ্কাও রয়েছে তাদের। প্রকল্প হাতে নেয়ার সময় সঠিক জরিপ ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ত্রম্নটি থাকার কারণে জনদুর্ভোগ বাড়ছে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। আর ট্রাফিক বিভাগ বলছে, গাড়ি বের হওয়ার জায়গা কমে যাওয়ায় আসন্ন ঈদযাত্রায় দুর্ভোগ আরও বাড়তে পারে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজের জন্য আগারগাঁও-ফার্মগেট থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সড়কের প্রশস্ততা অর্ধেকের বেশি কমেছে। বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাসর্ যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজের জন্য একইভাবে মহাসড়কের প্রশস্ততা কমেছে। সড়ক-মহাসড়কে গাড়ি চলাচলের পথ সঙ্কুচিত হয়েছে। বেশি গাড়ি চলতে না পারায়

সড়কের দীর্ঘস্থায়ী যানজট তৈরি হচ্ছে। এই যানজট ধীরে ধীরে অলিগলি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা শহরে। তাছাড়া অনেক এলাকার ছোট রাস্তায়ও সেবা সংস্থাগুলোর বিভিন্ন উন্নয়ন ও সংস্কার কাজের জন্য রাস্তা কেটে রাখা হয়েছে।

যাত্রীরা বলছেন, রোজার শুরু থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকা লাগছে। এই যানজট শুধু মূল সড়কেই সীমাবদ্ধ থাকে না। অলি-গলি হয়ে বাসার সামনে চলে যাচ্ছে। সকাল, দুপুর কিংবা রাত কোনো সময়ই যানজট থেকে মুক্তি মিলছে না। বিভিন্ন এলাকায় এমন অবস্থা তৈরি হয় পয়ে হাঁটারও জায়গা থাকে না। ঈদযাত্রায় কী হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

মিরপুর এলাকার বাসিন্দা কুসুম আক্তার। সড়ক পথে তীব্র যানজট থাকায় প্রতি ঈদেই রেলপথে বাড়ি যান। এবারও রেলে বাড়ি যাবেন বলে ঠিক করেছেন। কিন্তু যানজটের কারণে ঠিক সময়ে স্টেশনে পৌঁছাতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় তার। আলাপকালে তিনি বলেন, প্রায় প্রতি সকালে মিরপুরের কাজীপাড়া এলাকার ভাড়াবাসা থেকে বের হওয়ার কোনো অবস্থা থাকে না। মূল সড়কে জ্যাম থাকায় গলির ভেতরেও রিকশা, প্রাইভেটকাগুলো বের হতে পারে না। অনেক সময় হেঁটে যাওয়ারও কোনো উপায় থাকে না। এই অবস্থায় বাড়ি ফেরার জন্য রেলের আগাম টিকিট কাটেও নির্ধারিত সময়ে স্টেশনে পৌঁছাতে পারবেন কি না তা নিয়ে সন্দিহান তিনি।

কাঁঠালবাগান থেকে প্রতিদিন মতিঝিলে অফিস করেন ব্যাংকার জোবায়েত হাসনাত। তিনি বলেন, সকাল থেকেই জ্যাম লেগে যায়। মেট্রোরেলের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে কোনো বেশিরভাগ দিনই ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছাতে পারেননি। অসহনীয় যানজটের কারণে প্রেসক্লাবের সামনে নেমে হেঁটে মিতিঝিল যান। তাছাড়া সময় বাঁচাতে মাঝেমধ্যে বাংলামোটর থেকে শাহবাগ পর্যন্তও হেঁটে যেতে হয়। এমন অবস্থায় ঈদের আগে পরিবার পরিজন নিয়ে বাড়ি ফেরা নিয়ে চিন্তিত তিনি।

খিলক্ষেতের বাসিন্দা সফিকুল ইসলাম পরিবার নিয়ে বরগুনা গ্রামের বড়ি যাবেন লঞ্চে করে। প্রতি ঈদেই আগে টিকিট কেটে রাখেন। ঈদের ছুটি শুরুর আগের দিন অফিস শেষ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন তিনি। আলাপকালে সফিকুল বলেন, গত মাসে বাড়ি গিয়েছিলাম। তিনটার দিকে অফিস থেকে বের হয়ে সদরঘাট পৌঁছেছি সাড়ে সাতটায়। যে লঞ্চে যাওয়ার কথা ছিল তা ৬টায় ছেড়ে চলে গেছে। পরে বিকল্প লঞ্চে যেতে হয়েছে। কিন্তু ঈদের সময় আগাম টিকিট কেটে না রাখলে পরিবার নিয়ে যাওয়া যায় না। এরমধ্যে এমন অসহনীয় জ্যামে ঠিক সময়মতো পৌঁছাতে পারবেন কিনা তা নিয়ে চিন্তিত তিনি।

গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার হাফিজুর রহমান বাস ট্রেন বা লঞ্চের ঝক্কি ঝামেলায় না গিয়ে আকাশ পথে গ্রামের বাড়ি ফিরবেন বলে ঠিক করেছেন। তারও ভয় টঙ্গি থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কের যানজট নিয়ে।

শুধু যাত্রীরাই নয়, চালক হেলপাররাও এবারের যানজট নিয়ে চিন্তিত। মতিঝিল থেকে বিমানবন্দর রুটে চলাচলকারী বিআরটিসি বাসের চালক সহকারী আসাদুজ্জামান বলেন, আগের থেকে তিন চারগুণ সময় বেশি লাগে। অনেক জায়গায় একটির বেশি গাড়ি যেতে পারে না। বিশেষ করে ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত যেতে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট কখনো বা এক ঘণ্টার বেশি লেগে যায়। যাত্রীরা অনেক সময় বিরক্ত হয়ে পা হেঁটে চলে যায় বলে জানান তিনি। অন্য একটি পরিবহনের ড্রাইভার নয়ন সরকার বলেন, রাস্তাঘাটের এই অবস্থায় গাড়ি চালানো খুবই বিপজ্জনক। যেটুক রাস্তা গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত আছে সেটুকুতেও খানাখন্দে ভরা। যানজটের কারণে ট্রিপ অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানান তিনি।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কিছুদিন আগেও ঢাকার যেসব সড়কে লেনে তিন থেকে চারটি গাড়ি পাশাপাশি চলতে পারত সেখানে একটি বা দুটির বেশি গাড়ি চলতে পারছে না। আবার মূল সড়কে একটির বেশি গাড়ি যেতে পারছে না। রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা কারওয়ান বাজার থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত সড়কে একটির বেশি গাড়ি চলতে পারছে না। একই অবস্থা হাইকোর্ট মোড় থেকে দোয়েল চত্বর, টিএসসি হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত সড়কেরও। শাহবাগ থেকে পরিবাগ পর্যন্ত সড়কে একটি বড় বাস ও একটি প্রাইভেটকার অথবা দুটি ছোট বাস চলতে পারে। প্রেসক্লাব থেকে বায়তুল মোকাররমের সামনে দিয়ে মতিঝিল পর্যন্ত সড়কেও মেট্রোরেলেরে কাজের জন্য একটির বেশি গাড়ি চলতে পারছে না। তবে পরিবাগ সিগন্যাল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত সড়কে একটি বড় বাস চলতে পারে। পরিবাগ থেকে কারওয়ান বাজার সড়কে এক সঙ্গে দুটি বাস চলতে পারে।

মেট্রোরেল ও বিআরটি প্রকল্পের কাজ চলমান থাকা সড়কের অনেক অংশে বিভাজক তুলে ফেলা হয়েছে। বসানো হয়েছে কংক্রিটের বেষ্টনী। শতাধিক রুটের বাস চলছে বিকল্প পথে। বিকল্প সড়কে প্রাইভেট কার চলাচলের কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। রুট পরিবর্তন করায় গাবতলী থেকে মতিঝিল বা সদরঘাটমুখী বাস ফার্মগেটের পরিবর্তে সায়েন্সল্যাব হয়ে শাহবাগ দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে রামপুরা, মালিবাগমুখী যানবাহন ফার্মগেটের পরিবর্তে বিজয় সরণি, সাতরাস্তা হয়ে যাচ্ছে। সড়কের প্রশস্ততা কমে যাওয়ায় হওয়ায় সারাদিন যানজট লেগে থাকতে দেখা গেছে।

জানা গেছে, মূলত রাজধানীর ভেতরে তিনটি প্রধান সড়ক রয়েছে। এরমধ্যে আব্দুলস্নাহপুর-বিমানবন্দর-ফার্মগেট-শাহবাগ-জিরোপয়েন্ট-মতিঝিল সড়ক একটি। দ্বিতীয়টি পল্টন-বাড্ডা-বসুন্ধরা আবাসিক এ লাকা-বিমানবন্দর-আব্দুলস্নাহপুর সড়ক। আর তৃতীয় সড়কটি হলো গুলিস্তান-মিরপুর সড়ক। এরমধ্যে দুটি সড়কে মেট্রোরেল ও আব্দুলস্নাহপুর-মতিঝিল সড়কের একপ্রান্তে বিআরটি অন্যপ্রান্তে চলছে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ। মূলত সড়কগুলোর কোনো না কোনো অংশে এসব প্রকল্পের কর্মযজ্ঞ চলছে। সড়কের প্রশস্ততা এতটাই কমেছে যে কোনো কোনো কোনো অংশে পাশাপাশি দুটি বাসও চলতে পারে না।

আগারগাঁও-ফার্মগেট থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সড়কটি প্রস্থে প্রায় ২২ মিটার। এর মধ্যে সড়কের দুই পাশের মধ্যবর্তী ১১ মিটার অংশে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ চলবে। তাই একপাশের মাত্র সাড়ে পাঁচ মিটারের মধ্যে যানবাহন চলাচল করছে। এই অংশ দিয়ে মাত্র একটি বাস অথবা প্রাইভেট কারের সঙ্গে খুব বড়জোর একটি মোটরসাইকেল পাশাপাশি একসঙ্গে চলছে। তাই অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এই সড়কে যানজট বেড়েছে কয়েকগুণ।

এদিকে, বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত চলছে বাসর্ যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ। এজন্য বিমানবন্দর, উত্তরা, আব্দুলস্নাহপুরসহ টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কের মাঝখানে মেট্রোরেলের কাজের মতোই কর্মযজ্ঞ চলছে। ওই এলাকার সড়কগুলোর আয়তনও কমেছে। তাছাড়া ড্রেন নির্মাণসহ গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত আরও কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এসব উন্নয় কর্মযজ্ঞে প্রতিদিনই ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকছেন যাত্রীরা।

এ প্রসঙ্গে আলাপকালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মফিজ উদ্দীন আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, মেট্রোরেলের কাজের জন্য সড়কের প্রশস্ততা অনেক কমে গেছে। গাড়ি চলার জায়গা না থাকলে পুলিশের করার কিছু থাকে না। এরপরও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে যানজট নিয়ন্ত্রণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। ঈদ উপলক্ষে শপিংমলে মানুষের ভিড় বাড়বে। ঈদে ঘরমুখো মানুষের চাপ ও গাড়ি বাড়লে যানজটও বাড়তে পারে। তবে এসব বাড়তি চাপ মোকাবেলায় বিভিন্ন কৌশল নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মানুষের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করার জন্য ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।

আলাপকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যায়যায়দিনকে বলেন, প্রকল্পগুলো নেয়ার সময় জনসাধারণের স্বার্থ বিবেচনায় নেয়া হয় না। প্রকল্প হাতে নেয়ার পূর্বেই জনদুর্ভোগ লাঘবে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। সঠিক পরিকল্পনা ও সম্ভাব্যতা যাচাই সঠিকভাবে হলে এমন সমস্যা সৃষ্টি হতো না বলে জানান তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<50120 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1