শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
স্বপ্নের ত্রিদেশীয় সিরিজ জয়

স্কোর সমান হওয়ার আগে নিশ্চিত হইনি

বিশেষ সাক্ষাৎকারে মাশরাফি বিন মর্তুজা
বিডিনিউজ
  ১৯ মে ২০১৯, ০০:০০
ট্রফি হাতে মাশরাফির উচ্ছ্বাস

পুরস্কার বিতরণী মঞ্চ থেকে ট্রফি নিয়েই এক ছুট! মাশরাফি বিন মর্তুজার হাসিই বলে দিচ্ছিল কত আরাধ্য সেই ট্রফি। মাঠে অবশ্য খুব বেশি সময় থাকতে পারেননি। চার দিনের ছুটিতে দেশে ফিরছেন, ছিল ফ্লাইট ধরার তাড়া। মাঠ থেকেই ছুটতে হয়েছে বিমানবন্দরে। তবে বিমানে ওঠার আগে একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফিজয়ী অধিনায়ক কথা বললেন এই সাফল্য, অতীতের হতাশা আর সামনের বিশ্বকাপের চ্যালেঞ্জ নিয়ে।

শিরোপার উৎসব রেখে এয়ারপোর্টে ছুটতে হলো, মনে হচ্ছে না আরেকটু থাকতে পারলে ভালো হতো?

মাশরাফি বিন মর্তুজা: দলের সবার সঙ্গে থাকলে ভালো লাগেই। তবে উৎসবের কিছু নেই। জয়টা দরকার ছিল, জিতেছি। সাফল্য উদযাপন করা যেমন জরুরি, তেমনি সামনের অভিযানে ফোকাস রাখা আরও জরুরি। বিশ্বকাপ অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জ।

দেশে ফেরা নিয়ে তো আগেই বলেছি, লম্বা সফরে মানসিকভাবে চাঙা থাকা প্রয়োজন। ছোট্ট ছুটিতে আসা যাওয়ায় যদিও অনেক সময় লাগবে, তবু মনে হয়েছে পরিবারের সঙ্গে দুই-তিন দিন কাটালে ভালো লাগবে। তাছাড়া রোজার সময় কয়েকটি দিন বাসায় কাটালে মানসিকভাবে স্বস্তি পাই।

এই ট্রফি জয়ের মানে আপনার কাছে কী?

মাশরাফি: দেশের ক্রিকেটের জন্য বড় ব্যাপার। বড় একটি মাইলফলক। খুব বড় টুর্নামেন্ট নয় অবশ্যই, তবে প্রথম যে কোনো কিছুই স্পেশাল। আগে বারবার ফাইনাল হারের কারণেও এই জয় বিশেষ কিছু।

একটা কথা মনে করিয়ে দেয়া দরকার, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেশের প্রথম ট্রফি আমাদের মেয়েরা এনে দিয়েছে গত এশিয়া কাপে। ছেলেদের একটি ট্রফির অপেক্ষা ছিল। সেটি হলো। আকরাম ভাই, বুলবুল ভাইরা ২২ বছর আগে আইসিসি ট্রফি জিতেছিলেন। ওই পর্যায়ে সেটিও ছিল প্রথম। একটি ইতিহাসও। ভালো লাগছে যে আমরা, আমাদের এই দল ছেলেদের প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফি জয়ের ইতিহাসের অংশ হতে পেরেছি।

আর অধিনায়ক হিসেবে ও ক্রিকেটার হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে?

মাশরাফি: অধিনায়ক হিসেবেই বললাম আগেরটুকু। দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জয়। ব্যক্তিগতভাবে বললে... জানি না। তেমন কিছু নেই মনে হয়। ভাবতে হবে অনেক...।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্বকাপ দল নয়, আর আয়ারল্যান্ড, এমনিতে এই টুর্নামেন্টে শিরোপা জয় তো অনেকটা প্রত্যাশিতই ছিল?

মাশরাফি: প্রত্যাশা আগেও অনেকবার ছিল। গত বছর দেশের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজে তো আরও বেশি প্রত্যাশা ছিল। পারিনি আমরা। এখানে শুরুতে কন্ডিশন কত কঠিন ছিল, আপনারাও দেখেছেন। আইরিশরা পর্যন্ত এবার এখানের ঠান্ডায় কাবু।

প্রত্যাশার চেয়ে পারফরম্যান্স গুরুত্বপূর্ণ। যেটা আমরা আগের ফাইনালগুলোতে পারিনি। এবার ফাইনালের আগে থেকে প্রতিটি ম্যাচে যেভাবে খেলেছি, এরপর ফাইনালে এমন রান তাড়া, সব মিলিয়ে ভালো লাগছে।

বৃষ্টিতে ৫ ঘণ্টার বেশি বন্ধ ছিল খেলা, ম্যাচ পরিত্যক্ত হলে বাংলাদেশই চ্যাম্পিয়ন হতো। তখন কী মনে হচ্ছিল?

মাশরাফি: এখন তো উত্তর দেয়া খুব সহজ। তবে আমি মন থেকেই সত্যিটা বলছি, না খেলে চ্যাম্পিয়ন হতে চাইনি। চাইনি আমাদের প্রথম ট্রফি এভাবে আসুক। তাছাড়া বিশ্বকাপের আগে প্রতিটি ম্যাচই গুরুত্বপূর্ণ। শেষ পর্যন্ত যা হয়েছে, মোটামুটি সব চাওয়া পূর্ণ হয়েছে।

২৪ ওভারে ২১০, জয়ের বিশ্বাস ছিল ইনিংস বিরতিতে?

মাশরাফি: অবশ্যই। কেন থাকবে না? আমরা জানতাম আমাদের সামর্থ্য আছে এই রান তাড়ার। খুব ভালো ব্যাটিং লাইন আপ আমাদের। এই টুর্নামেন্টে সবাই ফর্মে আছে। আমি একা নই, ড্রেসিং রুমে সবাই বলেছে যে এই রান করতে পারব। শুধু বলার জন্য বলা নয়, সবাই বিশ্বাস করেছে বলেই আমরা পেরেছি।

সাকিবকে না পাওয়া তো ক্রিকেটীয় শক্তিতে ঘাটতির পাশাপাশি মানসিক ধাক্কাও। দল কিভাবে সামলেছে?

মাশরাফি: খেলতে নাও পারে, একটি মানসিক প্রস্তুতি দলের ছিলই। সকালে মাঠে আসার পর ওর অবস্থা দেখে আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে পাচ্ছি না। সবাই স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে। সাকিব বা আমি, কিংবা যে কাউকে ছাড়া আমরা জিততে পারি, সবার এই বিশ্বাস থাকা জরুরি।

সত্যি বলতে, এবার আর ফাইনাল হারতে চাইনি। সবাইকেও ছোঁয়াটা দেয়ার চেষ্টা করেছি হারা যাবে না। সবাইকে এটিই বলেছিলাম যে ম্যাচের পর যে 'ইস-উস' না করতে হয়, এটা করতে পারতাম বা ওটা। সবটা ঢেলে দিতে হবে, তার পর যা হয়। 'পারব না' ধরনের কোনো ভাবনা যেন কাউকে স্পর্শ না করে। সব নেতিবাচকতা থেকে সবাইকে দূরে রাখতে চেয়েছি।

মুশফিক ও মিঠুন যখন কাছাকাছি সময়ে আউট হলো, তখন শঙ্কা জাগেনি যে আবার হার ডাকছে!

মাশরাফি: নাহ, প্রয়োজনীয় রান রেট তো খুব ছিল না। জানতাম, তখন একটি জুটি হলেই কাজ হয়ে যাবে। রিয়াদ (মাহমুদউলস্নাহ) ও সৈকতের (মোসাদ্দেক) পর সাইফ ছিল, মিরাজ ছিল। এমনিতে ভয় ছিল না। শুধু অনেকবার কাছে গিয়ে, ঠিক এসব জায়গা থেকে হেরেছি বলেই ভাবনা ছিল।

ফ্যাবিয়ান অ্যালেনের এক ওভারে ২৫ রান নেয়া ওভারের পরই তো জয় নিশ্চিত বুঝছেন!

মাশরাফি: নাহ, অনেক শিক্ষা হয়েছে। হোক ২ ওভারে ২ রান লাগে। তবু জিতছি ধরে নেইনি। স্কোর সমান হওয়ার আগে নিশ্চিত হইনি। সমান হওয়ার পর মনে হয়েছে, যাক এবার হলো।

এইসব পরিস্থিতিতে সাধারণত মাহমুদউলস্নাহর কাছেই প্রত্যাশা বেশি থাকে। মোসাদ্দেকের ইনিংসটিতে চমকে যাননি?

মাশরাফি: একটুও না। অধিনায়ক হিসেবে সবার ওপর বিশ্বাস আছে বলেই দলে নিয়েছি। ভরসা করেছি। নামার আগেও সৈকতকে বলেছি, 'আমার বিশ্বাস আছে, তুই শেষ করে আসবি।'

মিঠুন আউট হয়ে যাওয়ার পর আমাদের পরিকল্পনা ছিল, রিয়াদ শেষ পর্যন্ত উইকেটে থাকবে, সিঙ্গেল খেলবে। সৈকতকে ফ্রি লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। ও যদি আউট হয়ে যেত, এরপর সাইফ-মিরাজ-আমি, সবাই ওই একইভাবে ব্যাট করতাম। সৈকতকে বিশ্বকাপ দলে নেয়া হয়েছে মানে তার সামর্থ্যে আমাদের আস্থা আছে।

সিনিয়রদের পাশাপাশি অন্যদের পারফর্ম করা না নিয়ে এমনিতে অনেক হাহাকার। প্রথম ট্রফিটা এলো পরবর্তী প্রজন্মের দুইজন সৌম্য ও মোসাদ্দেকের সৌজন্যে। এটা কী বার্তা দেয়?

মাশরাফি: ওদের দুজনের জন্য খুব ভালো ব্যাপার। অন্যদের সামনেও উদাহরণ। এমনিতে সিনিয়র-জুনিয়র বিভাজন আমরা করি না। হ্যাঁ, বলার সময় বা বোঝাতে অনেক সময় ব্যবহার করা হয়। কিন্তু দলের পরিকল্পনায় সিনিয়র-জুনিয়র হিসেবে ভূমিকা দেয়া হয় না। যার যার ভূমিকা থাকে, সবাই মিলেই দল।

যেটা বলছিলাম যে এরকম বড় ম্যাচে দুইজন দারুণ পারফর্ম করেছে, এটা ওদেরকে আত্মবিশ্বাস জোগাবে। অন্যদেরও বিশ্বাস দেবে। এই পারফরম্যান্স ধরে রাখা জরুরি।

এই দুজনকে দলে রাখতে অনেক লড়াই করতে হয়েছে আপনাকে। অনেক সময়ই দলের প্রয়োজনের ভাবনায় অনেকের জন্য করতে হয়। সেই ক্রিকেটাররা পারফর্ম করলে বাড়তি তৃপ্তি মেলে না?

মাশরাফি: এভাবে ভাবার কিছু নেই। লড়াইটা তো নিজের নয়। ওরা ভালো করলে দলের ভালো। ওদের জন্য ভালো। সেজন্য ভালো লাগে। আবার ওরা খারাপ করলে আমার খারাপ লাগে যে ওরা নিজেদের সম্ভাবনা-সামর্থ্য বুঝতে পারছে না। ওরা যদি নিজেদের মেধা-সামর্থ্যকে কাজে লাগায়, কতদূর যেতে পারে, এটা ওদের বোঝা জরুরি। সাকিব যেমন বুঝেছে, তামিম বুঝেছে। নিজেদের অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সৌম্য, লিটন, সৈকত, আরও কয়েকজন, ওরা আরও অনেকদূর যেতে পারে। কিন্তু সেই উপলব্ধি জরুরি।

শিরোপার পাশাপাশি তো আরও অনেক প্রাপ্তিও আছে এই টুর্নামেন্ট থেকে। অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলেছে!

মাশরাফি: হ্যাঁ, আলস্নাহর রহমতে যাকে নিয়েছি, সেই ভালো করেছে। সৌম্য ভালো করল, সাকিবের ফেরাটা দারুণ হলো। তামিম যথারীতি রান পেয়েছে। মুশফিক-রিয়াদ পেয়েছে। লিটন এক ম্যাচে সুযোগ পেয়ে ভালো করেছে। মোসাদ্দেক ফাইনালের ইনিংস ছাড়াও আগের দিন ভালো বোলিং করেছে। মিরাজ আমি বলব অসাধারণ বোলিং করেছে। রাহিকে যে আশায় দ্বিতীয় ম্যাচ খেলানো হলো, সেটা পূরণ করেছে। সাইফ দারুণ করছে। রুবেল ফিরে খারাপ করেনি। মুস্তাফিজ ম্যাচ জিতিয়েছে। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপের আগে দলের জন্য ভালো খবর। তবে এই ধারা ধরে রাখা জরুরি। খারাপ সময় আসতেও সময় লাগে না।

৭৬ রান করার পরও লিটন বা ৫ উইকেট নেয়ার পরও আবু জায়েদ সুযোগ পেল না, অন্য অনেক দেশে স্বাভাবিক হলেও বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে বিরল। কতটা কঠিন ছিল সিদ্ধান্ত?

মাশরাফি: একটুও না। কারণ আমাদের ভাবনায় আমরা পরিষ্কার ও অটল ছিলাম। আমাদের এখানে এসব কম হয়, তবে নিয়মিত করে তোলা উচিত। কারণ এসবই পেশাদার সিদ্ধান্ত। মূল একাদশের বাইরে যারা, তারাও পারফর্ম করা মানে দলের জন্য দারুণ খবর। তার মানে এই না যে মূল পরিকল্পনার সঙ্গে আপস করতে হবে।

হ্যাঁ, যদি বিকল্প প্রয়োজন হয় পরিস্থিতি বা প্রতিপক্ষ অনুযায়ী, তখন সময়ই ঠিক করে দেবে সবকিছু। তখন যার সুযোগ আসবে, সে যদি তৈরি থাকে, তাহলে তার জন্য ও দলের জন্য সেটা বড় সুখবর। একটা সেটেলড ও পেশাদার দলে এভাবেই দল গড়া হয়।

এবার ফাইনালের আগে বা আগেও বেশ কবার বলেছেন ফাইনালে মেন্টাল বস্নকের কথা। যে বস্নক একবার কাটাতে পারলে আরও ট্রফি আসবে বলেই বিশ্বাস করেন। গত এশিয়া কাপের ফাইনালে হারার পর বলেছিলেন, 'একবার জিততে শুরু করলে একদিন এসব ট্রফি আমাদের জন্য মামুলি হয়ে উঠবে।' মেন্টাল বস্নক কি কাটল এবার?

মাশরাফি: আশা তো করি কাটল। ফাইনালে একটা জয় না আসা পর্যন্ত স্বস্তিটা আসছিল না। এখন অন্তত প্রথম জয়ের তীব্র মরিয়া ভাবটা থাকবে না। যা চাপ কমাবে। এখন আমি মনে করি, ৫টি ফাইনাল খেললে অন্তত ২টি আমরা জিতব। ৩টিও পারি জিততে। এবং হারলেও হয়তো ক্রিকেটীয় কারণে হারব, মানসিক নয়।

বিশ্বকাপ নিয়ে আপনি বলেছিলেন, স্বপ্ন দেখলে বড়ই দেখব। বড় স্বপ্নের সাহস আরও জোরালো করল এই জয়?

মাশরাফি: নাহ, আত্মবিশ্বাস বাড়াল বলতে পারেন। নিজেদের ওপর বিশ্বাস আরও পোক্ত হলো। কিন্তু বিশ্বকাপের সঙ্গে এটার তুলনাই চলে না। অন্তত তিনগুণ কঠিন হবে বিশ্বকাপ। প্রতিটি মাঠ, প্রতিপক্ষ, পরিস্থিতি সব সামলে দীর্ঘ সময় ধরে ছন্দে থাকা খুবই কঠিন হবে। ভালো সময়, খারাপ সময় আসবে। এসবের সঙ্গে কিভাবে মানিয়ে নিচ্ছি, এটাও গুরুত্বপূর্ণ হবে।

আমাদের কাজটি আরও কঠিন। কারণ আমাদের প্রথম তিন ম্যাচ এমন দলের সঙ্গে, ইংল্যান্ডের কন্ডিশন আর উইকেটে যারা অভ্যস্ত। শুরুতেই তিন ম্যাচ হেরে গেলে ছন্দে ফেরা, মনোবল পাওয়া কঠিন হয়ে উঠবে। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপ অনেক কঠিন হবে। কঠিন হওয়াটাই স্বাভাবিক। বড় কিছু পেতে হলে সহজ পথ বলে কিছু নেই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<50116 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1