শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাজার নিয়ন্ত্রণে সেই পুরান ছক!

প্রতি বছরের মতো এবারও রোজায় খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা
নতুনধারা
  ২৫ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০
রমজান উপলক্ষে বুধবার রাজধানীতে শুরু হয় টিসিবির পণ্য বিক্রি। ছবিটি সচিবালয় এলাকা থেকে তোলা -আমিনুল ইসলাম শাহীন

সাখাওয়াত হোসেন

টিসিবির মাধ্যমে খোলা বাজারে ইফতারির অনুষঙ্গ ডাল, ছোলা, চিনি, তেল ও খেজুর বিক্রি জোরদার, সড়কপথে পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ ও কথিত বাজার মনিটরিংসহ ডজনখানেক গতানুগতিক কৌশলে প্রতি বছর রমজানের বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলেও এবারও সেই একই ছক নিয়ে মাঠে নেমেছে সরকার। ফলে বিগত সময়ের মতো এবারও রোজা শুরুর আগেই ইফতারির প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের পাশাপাশি অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দর বেশ খানিকটা বেড়েছে। বরাবরের মতো রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের নিত্যপণ্যের বাজার সিন্ডিকেটের দখলে চলে গেছে বলে জানান বাজার সংশ্লিষ্টরা।

তাদের আশঙ্কা, প্রতি বছরের মত এবারও রোজার মাসে খাদ্যপণ্যের দাম আরও বেশি বাড়বে। এতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হবে; নাভিশ্বাস উঠবে নিম্নবিত্তের। রমজানের প্রথম সপ্তাহ পার হওয়ার পর বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পুরোপুরি খেই হারিয়ে ফেলতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তারা।

এদিকে রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হলেও ভোগ্যপণ্যের দর স্থিতিশীল রয়েছে- সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের বরাবরের এমন দাবি বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্য, প্রতি বছর রোজার মাসে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সে দায় পাশ কাটিয়ে বরং মূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। এতে বাজার সিন্ডিকেট আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এবারও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। যা বাজার পরিস্থিতিকে ভীষণভাবে বেসামাল করে তুলতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন অর্থনীতিবিদরা।

তাদের এ উৎকণ্ঠা যে একেবারে অমূলক নয়, তা বাজার পরিস্থিতির সাম্প্রতিক চিত্র এবং বাণিজ্যমন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রমজানে জিনিসপত্রের দর বাড়বে না বলে গত ১৮ এপ্রিল বাণিজ্যমন্ত্রীর ঘোষণা দেয়ার পরদিন অর্থাৎ ১৯ এপ্রিল ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারে ডাল, ছোলা, চিনি ও পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়েছে। মাত্র দুদিনের ব্যবধানে ডালের দাম প্রায় ৪৫ শতাংশ, ছোলার দাম প্রায় ১৪ শতাংশ, চিনির দাম ৪ শতাংশ ও পেঁয়াজের দাম ৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। অথচ বাজারে এসব পণ্যের কোনো সংকট নেই। যদিও রোজার অনুষঙ্গ এ চার পণ্যের দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে আড়তদাররা আন্তর্জাতিক বাজারকে দায়ী করছেন। তাদের ভাষ্য, মাঝেমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ে। তখন ব্যবসায়ীরা সেই দরের সঙ্গে সমন্বয় করেন। এতে জিনিসপত্রের দাম সাময়িকভাবে বেড়ে যায়।

তবে, তাদের এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন খুচরা ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, একজন ব্যবসায়ী আজকে যে পণ্য বাজারে তুলেছেন সেটা ৪-৫ মাস আগে এলসি খুলেছেন। সেই হিসাবে তার পণ্যের দাম আজকের আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের কোনো সুযোগ নেই। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, রোজা সামনে রেখে আড়তদাররা পণ্যগুলো মজুদ করায় কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে এবং এ কারণে দাম বাড়ছে। এক্ষেত্রে শক্তিশালী সিন্ডিকেট সক্রিয় বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

অথচ গত ১৮ এপ্রিল সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, চাহিদার তুলনায় নিত্যপণ্যের মজুদ অনেক বেশি। তাই এবারের রমজানে পণ্যের দাম বাড়বে না। পণ্য আনা-নেয়ার রাস্তায় যেন কোনো ধরনের চাঁদাবাজি না হয় সে জন্য সংশ্লিষ্টদের শিগগিরই চিঠি দেয়া হবে। এ ছাড়া মনিটরিংয়ের সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। রমজানকে কেন্দ্র করে কেউ সুযোগ নিচ্ছে কি না সে বিষয়টি নজরে রাখা হচ্ছে। রমজানকে পুঁজি করে নিত্যপণ্যের দাম যাতে না বাড়ে সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা আছে।

এদিকে রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার পেছনে সড়কে পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজিকে দায়ী করে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির কাছে এর প্রতিকার চাইলে তিনি বিষয়টি কঠোর হাতে দমনের আশ্বাস দেন। পরবর্তীতে এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের পদক্ষেপ নিতে সরকারের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়। তবে ব্যবসায়ী ও পণ্য পরিবহনের সঙ্গে জড়িত মালিক-শ্রমিকদের অভিযোগ, বরাবরের মতো সরকারের এ গতানুগতিক কৌশল এবারও শুরুর আগেই ভেস্তে গেছে।

ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা জানান, পণ্য পরিবহনে পুলিশের বেপরোয়া চাঁদাবাজি আগের মতোই রয়েছে। এর ওপর ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের চাঁদা মড়ার উপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে এ চাঁদার টাকা উঠিয়ে নিচ্ছে। যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ঘাড়ে গিয়ে চাপছে।

বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির একজন নেতা জানান, সড়ক বা মহাসড়কে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করতে এক-একটি স্পটে আগের মতোই ৫০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে। এই চাঁদা যেমন হাইওয়ে পুলিশ নেয়, তেমনি মালিক ও শ্রমিক সমিতির নামেও আদায় করা হয়। তাই ডিসি-এসপিদের এ ব্যাপারে সতর্ক করে বাস্তবিক অর্থে কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং এতে হয়রানি উল্টো বেড়েছে বলে দাবি করেন ওই নেতা।

এদিকে পরিবহন শ্রমিকরা জানান, পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি গত সপ্তাহখানেক ধরে আরও কিছুটা বেড়েছে। এ সেক্টরের চাঁদাবাজিতে ঢাকার পরই উত্তরাঞ্চলের রাজধানী হিসেবে পরিচিত বগুড়ার স্থান। এ শহরের ওপর দিয়েই উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার যানবাহন চলাচল করে। উত্তরাঞ্চলের বিশাল শস্যভান্ডার থেকে সারাদেশে বিভিন্ন ধরনের পণ্য পরিবহন করা হয়। অথচ সেখানকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে এখনো আশানুরূপ কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন পরিবহন শ্রমিকরা।

অন্যদিকে রমজানের বাজার নিয়ন্ত্রণে সাতটি সংস্থার সমন্বয়ে ডজন দুইয়েক মনিটরিং টিম গঠন করা হলেও তারা বরাবরের মতোই লোক দেখানো কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ তুলেছে।

তাদের ভাষ্য, বাজারে সরকারি মনিটরিংয়ে যে টিম আছে তাদের যথাযথ তদারকি না থাকার সুযোগে অসৎ ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা লুটে নিচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে জানান, পণ্যের মূল্য তালিকা তৈরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এফবিসিসিআইয়ের মনিটরিং টিমের কার্যক্রম। অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং টিমও বাজার পরিদর্শনের নামে হাজিরা দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব খালাস করে।

এদিকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে বাজার মনিটরিংয়ের জন্য মাঠপর্যায়ের জনবল থাকলেও তারা শুধু পণ্যের মূল্য তালিকা সংগ্রহ করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করছে। পণ্যের দাম কেন বাড়ল, এটি তদারকি করে না। ভোক্তা অধিকার পরিষদ থেকে মাঝেমধ্যে বাজার পরিদর্শন করা হয়। তারা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তা খতিয়ে দেখে। তবে জনবল কম থাকায় নিয়মিত বাজার পরিদর্শন কার্যক্রম চালাতে পারছে না।

বাজার নিয়ে সরকারের একাধিক সংস্থা কাজ করলেও একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো মিল নেই। ফলে তারা যে বাজার দর সংগ্রহ করে সেটিরও কোনো মিল নেই। ফলে বাজার মূল্য তদারকির ক্ষেত্রে সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলোও নেয়া হচ্ছে ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। এ কারণে বাজারের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সরকারি তথ্যের কোনো মিল থাকছে না।

বিষয়টি স্বীকার করে টিসিবির একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতিদিন সকালে টিসিবির একটি টিম কয়েকটি বাজার ঘুরে পণ্যমূল্যের তালিকা তৈরি করে। তবে বাজারভেদে পণ্যের দামের ভিন্নতা থাকে। তাই টিসিবির সঙ্গে মূল বাজার দরের মিল হয় না।

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিটি বাজারে পণ্যের মূল্য তালিকা টাঙানোর কথা থাকলেও অধিকাংশ বাজার কমিটি তা মানছে না। কোনো কোনো বাজারে মূল্য তালিকার সাইনবোর্ড থাকলেও তা নিয়মিত লেখা হচ্ছে না। আবার বেশকিছু বাজারের মূল্য তালিকা টাঙানোর সাইনবোর্ড বেশ আগেই উধাও হয়ে গেছে। এছাড়া অধিকাংশ বাজারেই মূল্য তালিকার চেয়ে বেশি দরে জিনিসপত্র দেদার বিক্রি হচ্ছে। অথচ মনিটরিং কমিটি বাজারে ঢোকামাত্র তারা ভোল পাল্টে ফেলছে। ফলে এ তদারকির বরাবরই ফল শূন্যই থাকছে।

এদিকে ভোক্তা অধিকার আইনে রয়েছে, পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশের ৫ ধারা অনুযায়ী, উৎপাদক, পরিশোধক বা আমদানিকারক অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্য যৌক্তিকভাবে হ্রাস, বৃদ্ধি বা পুনর্র্নির্ধারণ করতে ইচ্ছুক হলে সংশ্লিষ্ট পণ্যের ব্যবসায়ী সমিতির মাধ্যমে উক্ত রূপ হ্রাস, বৃদ্ধি বা পুনর্নির্ধারণ করবেন। অথচ বাজার নিয়ে বিভিন্নভাবে অনেকে কাজ করলেও তার কোনো সমন্বয় নেই। পণ্যের চাহিদা বা কতটুকু জোগান দিতে হবে তার কোনো সঠিক তথ্য জানা নেই কারও।

অর্থনীতিবিদ গোলাম মোয়াজ্জেম এ বিষয়ে বলেন, দেশে কোন পণ্যের চাহিদা কী, সেই হিসাব নেই সরকারের কাছে। নেই আন্তর্জাতিক বাজারের দাম এবং সরবরাহ ব্যবস্থার হালনাগাদ তথ্যও। চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সমন্বয় রেখে সারা বছর বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য কোনো প্রতিতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাও সরকার গড়ে তোলেনি। তাই এসব ব্যাপারে বরাবরই সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<46728 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1