শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
কলম্বোর তিন গির্জা ও চার হোটেলসহ ৮ স্থানে সিরিজ বোমা হামলা

মৃতু্যপুরী শ্রীলংকায় শোক আতঙ্ক, নিহত বেড়ে ২৯০

যাযাদি ডেস্ক
  ২৩ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০
আপডেট  : ২৩ এপ্রিল ২০১৯, ০০:২৭
গত রোববার ইস্টার সানডেতে শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোতে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় বিধ্বস্ত সেইন্ট অ্যান্থনি গির্জা -রয়টার্স

শোকে স্তব্ধ, আতঙ্ক ও বিস্ময়ে বিমূঢ় মৃতু্যপুরী শ্রীলংকায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯০ জনে। গত রোববার ইস্টার সানডের পর্বের মধ্যে দুই দফায় তিনটি গির্জা ও চারটি হোটেলসহ আট জায়গায় বোমা হামলার পর সন্ধ্যা থেকে পুরো শ্রীলংকায় জারি করা হয়েছিল কারফিউ। সোমবার সকালে তা তুলে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। শ্রীলংকায় গৃহযুদ্ধের পর গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় এই হামলার দায় এখনো কেউ স্বীকার করেনি। পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে ২৪ জনকে আটক করার কথা জানিয়েছে। তবে কারা ওই সমন্বিত হামলা চালিয়ে থাকতে পারে, সে বিষয়ে সরকার এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলেনি। এই হামলার শিকার হয়েছে দেশটিতে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের তিনটি বড় গির্জা সেইন্ট অ্যান্থনির চার্চ, সেইন্ট সেবাস্টিয়ানের চার্চ আর জিয়ন চার্চে, যেখানে ইস্টার সানডের প্রার্থনায় সমবেত হয়েছিল হাজারো মানুষ। হামলার অন্যতম লক্ষ্য ছিল কলম্বোর পাঁচ তারকা হোটেল শাংরি লা, কিংসবুরি আর সিনামন গ্র্যান্ডের বিদেশি পর্যটকরা। শ্রীংকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে অন্তত ২৭ জন বিদেশি নাগরিক রয়েছেন। পাঁচ শতাধিক মানুষ আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। যেভাবে হামলা : বিবিসি জানিয়েছে, তিনটি গির্জা ও তিনটি হোটেলে বিস্ফোরণের খবরটি আসে রোবার স্থানীয় সময় সকাল পৌনে ৯টার দিকে। 'যিশুর পুনরুত্থান' দিবস উদযাপনে গির্জাগুলোতে তখন চলছিল বিশেষ প্রার্থনা। এর মধ্যে ১৯ শতকের শুরুতে নির্মিত কোচিকাডের সেইন্ট অ্যান্থনির গির্জা শ্রীংকার একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। খ্রিষ্টানদের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছেও এটি একটি আকর্ষণীয় জায়গা। এছাড়া কাটুয়াপিতিয়ার সেইন্ট সেবাস্টিয়ানের চার্চ এবং বাত্তিকালোয়ার জিয়ন গির্জাও শ্রীলংকায় ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাসনালয়। বিস্ফোরণে প্রতিটি গির্জাই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ছাদ উড়ে যায়। বিধ্বস্ত গির্জাগুলোর বেঞ্চ আর যিশুর ভাস্কর্যে রক্তের দাগ লেগে থাকতে দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আসা ছবি ও ভিডিওতে। এক প্রত্যক্ষদর্শী বিস্ফোরণের শব্দ শোনার পর দৌড়ে সেইন্ট অ্যান্থনির চার্চে গিয়ে মেঝেতে লাশ পড়ে থাকতে দেখার কথা বলেছেন বিবিসিকে। কামাল নামের ওই ব্যক্তি বলেন, পৌনে ৯টার দিকে বিকট ওই বিস্ফোরণের শব্দ পান তিনি। এরপর লোকজনকে দৌড়ে বের হয়ে আসতে দেখেন। তারা চিৎকার করে অনেক লোকের মৃতু্যর কথা বলছিলেন। 'আমরা দৌড়ে গির্জার ভেতরে গিয়ে লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম। আমরা পস্নাস্টিক দিয়ে সেগুলো ঢেকে দিলাম। এরপর পুলিশ এসে সবাইকে সেখান থেকে বের করে দিল।' ইস্টার সানডের প্রার্থনার জন্য ওই গির্জায় পাঁচ শতাধিক লোক জড়ো হয়েছিল বলে জানিয়েছেন তিনি। প্রায় একই সময়ে বিস্ফোরণ হয় কলম্বোর শাংরি লা, সিনামন গ্র্যান্ড ও কিংসবুরি হোটেলে। প্রতিটি হোটেলের রেস্তোরাঁয় তখন সকালের নাশতা সারতে আসা পর্যটকদের ভিড় ছিল। আর সেই পর্যটকরাই ছিল আত্মঘাতী হামলাকারীদের টার্গেট। শ্রীংকায় বেড়ে ওঠা ৪৮ বছরের চিকিৎসক জুলিয়ান ইমানুয়েল পরিবার নিয়ে থাকেন যুক্তরাজ্যে। আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে কলম্বো এসে তারা উঠেছিলেন সিনামন গ্র্যান্ড হোটেলে। বিবিসিকে ইমানুয়েল বলেন, 'বিকট বিস্ফোরণের সময় আমরা হোটেলের ঘরেই ছিলাম। বিস্ফোরণের ধাক্কায় আমাদের ঘর কেঁপে উঠল। পরে আমাদের হোটেলের লাউঞ্জে নিয়ে আসা হলো, পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে যেতে বলা হলো। সেখানে আমরা কয়েকজন হতাহতকে দেখতে পেলাম, তাদের তখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।' সকালের নাশতা খেতে যেতে তার সামান্য দেরি হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান লন্ডন বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক কিরণ আরাসারত্নম। তিনি বলেন, 'এত জোরে শব্দ হয়েছিল যে আমি বজ্রপাত ভেবেছিলাম। সবাই আতঙ্কে ছুটোছুটি শুরু করে। বেশিভাগ মানুষ বুঝতে পারেনি আসলে কী হয়েছে। লোকজনের শার্টে রক্ত লেগে ছিল, ছোট একটা মেয়েকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলছিল, দেয়াল, মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছিল।' একের পর এক অ্যাম্বুলেন্সে করে হতাহতদের নেয়া হচ্ছিল হাসপাতালে। স্বেচ্ছাসেবীদের আহবানে বহুন মানুষ ততক্ষণে রক্ত দিতে ভিড় করেছেন বস্নাড ব্যাংকে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর দেহিওয়ালায় চিড়িয়াখানার কাছে ট্রপিকাল ইন হোটেলে সপ্তম এবং দেমাটাগোদা এলাকায় অষ্টম বিস্ফোরণের খবর আসে। দেহিওয়ালার ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্য নিহত হন। দুই দফা হালার কারণে ইস্টার সানডের সন্ধ্যার সব জমায়েত বাতিল করা হয়। শ্রীলংকার সব সরকারি স্কুলে দুই দিনের জন্য ছুটি দিয়ে দেয়া হয়। জোরদার করা হয় কলম্বোর বন্দরনায়েকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কারফিউয়ের মধ্যে রাতের ফ্লাইটের যাত্রীদের টিকিট ও পাসপোর্ট দেখিয়ে বিমানবন্দরে যেতে হবে। যাত্রীদের নির্ধারিত সময়ের অন্তত চার ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে উপস্থিত হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কেন ইস্টার সানডে : শ্রীলংকায় সিংহলি ও তামিলদের মধ্যে সিকি শতাব্দী ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান হয় ২০০৯ সালে। এরপর বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছে ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপ দেশ হয়ে ওঠে আকর্ষণীয় গন্তব্য। শ্রীলংকার দুই কোটি বিশ লাখ জনসংখ্যার মোটামুটি ৭০ শতাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বাকিদের মধ্যে ১৩ শতাংশ হিন্দু, ১০ শতাংশ মুসলমান, আর ৭ শতাংশ খ্রিষ্টান। ইস্টার সানডেতে খ্রিষ্টানদের গির্জাগুলো থাকে জমজমাট। এই সময়টায় পর্যটকরাও ছুটি কাটাতে আসেন। হামলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি নিশ্চিত করার জন্যই ইস্টার সানডে এবং গির্জা ও হোটেলগুলো বেছে নেয়া হয়েছে বলে মনে করেন বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের এথিরাজন আনবারাসন। এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রীংকার পুলিশ প্রধান পুজুথ জয়সুন্দর গত ১১ এপ্রিল দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে একটি সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিলেন। বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে তিনি বলেছিলেন, জঙ্গি দল ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াত (এনটিজে) কলম্বোয় ভারতীয় হাইকমিশন ও শ্রীংকার প্রধান গির্জাগুলোতে আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা করছে। গত বছর একটি বৌদ্ধমূর্তি গুঁড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শ্রীংকার উগ্রপন্থি মুসলিমদের সংগঠন ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াতের নাম খবরে এসেছিল। কিন্তু পুলিশ প্রধানের ওই সতর্কবার্তা পুরোপুরি আমলে না নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে বলেছেন, 'আমাদের এ বিষয়গুলো আরও খতিয়ে দেখতে হবে। দেশকে অস্থিতিশীল করার মতো সুযোগ দেয়া কোনোভাবেই উচিত হয়নি।' বিবিসি সিনহলার প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন এ ঘটনার পেছনে ছিল বলে প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করছেন।

ভারত সীমান্তে হাই অ্যালার্ট!

শ্রীলংকায় ভয়াবহ সিরিজ বিস্ফোরণে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পরপর চালানো এ হামলায় ভারত-শ্রীলংকা উপকূল এলাকায় বিশেষ টহল দিচ্ছে ভারতীয় বাহিনী।

ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো জানায়, শ্রীলংকায় হামলার সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীদের ভারতে প্রবেশের সম্ভাবনা এড়াতে ভারত-শ্রীলংকা জলসীমায় কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সংবাদ সংস্থা এ এন আই জানিয়েছে, ভারতের জলপথে সন্দেহজনক গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া বিমানগুলোতেও নজরদারি চালানো হচ্ছে বলেও জানায় তারা। তাছাড়া ভারতে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ইন্ডিয়ান কোস্ট গার্ডকেও অতিরিক্ত সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এর আগে রোববার হামলার পরপরই শ্রীলংকার বিষয়টি ভারত গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছে বলে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ।

সুষমা বলেছেন, কলম্বোয় ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে আমি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। পরিস্থিতির ওপর আমাদের গভীর নজর রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে