বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিরোধে স্থবির ডাকসু হতাশ শিক্ষার্থীরা

শিক্ষার্থীরাও বলছেন, প্রথম দুই সপ্তাহে তারা নেতাদের কাছ থেকে যে সাড়া পাচ্ছিলেন, এখন আর তা পাচ্ছেন না। এর কারণ অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রথমে মৌখিক ও পরে সহিংস বিরোধে জড়িয়ে পড়েন ডাকসু নেতারা
এস এম মামুন হোসেন
  ২১ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

মতবিরোধ আর বিভেদে স্থবির হয়ে পড়েছে মাত্র এক মাস আগে কার্যক্রম শুরু করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) কার্যক্রম। এ সংসদ যাত্রা শুরুর পর সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে সরব হতে শুরু করেন। তবে মাত্র এক মাসেই একাধিক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, নেতাদের বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থ ভাগাভাগির অভিযোগ, সহিংস কার্যক্রমে জড়িত হওয়া ও অসাধু উপায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াদের ব্যাপারে নেতাদের সহনীয় মনোভাবে শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়েছেন। এ অবস্থায় ডাকসু ছাত্রদের অধিকার আদায়ে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে তা নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতোমধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে।

গত মার্চে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক উঠলেও সব পক্ষ দায়িত্ব গ্রহণ করায় আশাবাদী হয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। ছাত্র সংসদ নেতারা দায়িত্ব গ্রহণের পর শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে তাদের দ্বারস্থ হন। নেতারাও উদ্যোগী হয়ে বেশ কিছু কাজও করেন। আর তাতে আরও বেশি আশান্বিত হয়ে ওঠেন সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা। ফলে তারা অবৈধদের হল থেকে বের করা, বিভাগ ও হলের অযৌক্তিক ফি কমানো, জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াদের শাস্তি, রিডিং রুমের সিট বাড়ানোসহ বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে দরকষাকষি শুরু করেন। অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ফলও মেলে। আবার কিছু বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণেও তৎপর হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

তবে ডাকসুর কেন্দ্রীয় ও হলের নেতাদের মধ্যকার বিরোধ স্বল্প সময়েই সামনে আসে। প্রথমে মৌখিক ও পরে সহিংস বিরোধে জড়িয়ে পড়েন ডাকসু নেতারা। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের দাবি দাওয়া নিয়ে কাজ করার চেয়ে নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কাজেই বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েন নেতারা। শিক্ষার্থীরাও বলছেন, প্রথম দুই সপ্তাহে তারা নেতাদের কাছ থেকে যে সাড়া পাচ্ছিলেন, এখন তা আর পাচ্ছেন না।

ডাকসু নেতারা দায়িত্ব গ্রহণের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে শুরু হয় 'আদু ভাই হল ছাড়ো' আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু, এসএম হলসহ বিভিন্ন হলে শিক্ষার্থীরা যাদের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে তাদের হল ছাড়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এ আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান ডাকসুর কেন্দ্রীয়সহ হলের সব নেতাই। ফলে শিক্ষার্থীরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন অবৈধদের হল ছাড় করার বিষয়ে। এছাড়া বহিরাগতরাও ওই আন্দোলনের ফলে হল ছাড়তে শুরু করেন।

বিজয় একাত্তর হল এবং কয়েকটি বিভাগে অযৌক্তিকভাবে বাড়তি ফি আদায় করে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ওইসব ফিও প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় প্রশাসন। এছাড়া শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে ভিপি নুরুপন্থি ও জিএস রাব্বানী পন্থিদের মধ্যে কে কতবেশি শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করতে পারে সে বিষয়ে এক ধরনের ইতিবাচক প্রতিযোগিতা শুরু হয়। খাবারের মান-দাম থেকে শুরু করে বাথরুমের পরিচ্ছন্নতাও বাদ যাচ্ছিলো না এ প্রতিযোগিতা থেকে।

কিন্তু এসব ইতিবাচক কাজে হঠাৎই ছেদ পড়ে গত ২ এপ্রিলের পর থেকে। ওইদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলে এক শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভিপি নুর প্রক্টরের নির্দেশে হলটির প্রভোস্টের কাছে স্মারকলিপি দিতে গেলে তাকে অবরুদ্ধ ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। এরপর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও সরাসরি এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদাগারে নামে। শিক্ষার্থীদের অধিকার ও দাবি নিয়ে এর পূর্ববর্তী দুই সপ্তাহে যে ইতিবাচক প্রতিযোগিতা ছিল তা হঠাৎই শেষ হয়ে যায়।

ডাকসুতে জনবল নিয়োগকে কেন্দ্র করেও দুই পক্ষের সম্পর্কে অবনতি হয়। ডাকসুতে কিছু জনবল নিয়োগ চেয়ে কোষাধ্যক্ষ বরাবর জিএস ও এজিএসের স্বাক্ষর করা এক চিঠি নিয়েও তুমুল বিতর্কে জড়ান তারা। ভিপির স্বাক্ষর ছাড়া এমন চিঠি কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গ্রহণ করলো তা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।

আর সর্বশেষ বিতর্কের বিষয় হয়েছে চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরে দুই দিনব্যাপী লোকসঙ্গীত উৎসব ও কনসার্টের অনুষ্ঠানস্থলে ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। মূলত এ কনসার্ট দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের ব্যানারেই হয়ে আসছে। কিন্তু সংগঠনটির সভাপতির সঙ্গে সাধারণ সম্পাদকের বিরোধের জেরে রাব্বানী ও তার অনুসারীরা ডাকসুর ব্যানার ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। ওই অনুষ্ঠানের অর্থ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠার পর ভিপি নুর ডাকসুর ব্যানার ব্যবহারে আপত্তি জানান, যা রাব্বানীপন্থিদেরকে ক্ষুব্ধ করে।

আর এসব ঘটনার পর এখন সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিষয় নিয়ে কাজ করার চেয়ে একপক্ষ আরেক পক্ষের সমালোচনাতেই বেশি তৎপর। এতে করে শিক্ষার্থীরা ডাকসু নির্বাচনের পর নেতাদের কাছে যে সমাদর পাচ্ছিলো তাও আর অবশিষ্ট নেই।

ডাকসু নির্বাচনের পর থেকে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব বিষয় নিয়ে ওবায়দুল হক নামের এক শিক্ষার্থী যায়যায়দিনকে বলেন, 'নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ডাকসুর প্রথম দুই সপ্তাহ শিক্ষার্থীদের ব্যাপক কদর ছিল নেতাদের কাছে। শিক্ষার্থীরাও তাদের প্রতিটি বিষয়ে ডাকসু ও হল সংসদের নেতাদের শরণাপন্ন হচ্ছিলেন। সাড়াও মিলছিল ভালো। সত্যিই বিষয়গুলো তাদেরকে বেশ আশাবাদী করে তুলেছিল। কিন্তু ভিপির উপর হামলার মধ্য দিয়ে সেই দায়িত্বশীলতা ও শিক্ষার্থীদের উপর দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে নেতারা সরে এসেছেন বলে এখন মনে হচ্ছে। সর্বশেষ মল চত্বরের ঘটনায় তাদেরকে অপমানিত করা হয়েছে। তারা নেতাদের কাছ থেকে এটা প্রত্যাশা করেননি। অতীতে যে যাই থাক এখন তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতা। তারা এটা মাথায় রেখে কাজ করবেন বলে তারা বিশ্বাস করতে চান। এছাড়া জালিয়াতি করে যারা ভর্তি হয়েছেন তাদের অনেকেই রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এদের কোনো সংগঠন প্রশ্রয় দিলে ঢাবির শিক্ষার্থীরা তা মেনে নেবে না।

এ বিষয়ে ডাকসু ভিপি মো. নুরুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমরা কাজ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমাদের কাজে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। প্রথম থেকেই আমি সকলকে নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। কিন্তু কেউ যদি নিজের স্বার্থে বা অসৎ উদ্দেশ্যে গোপনে গোপনে কিছু করেন সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব প্রশাসনের। তারা সে ব্যবস্থা নেবেন বলে আমরা আশা করতে চাই। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা এখানে ভালো নয়। আমি আমার সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি দাওয়ার বিষয়ে প্রথম থেকেই সরব ছিলাম, এখনো আছি। আমার উপর হামলা, জোর জবরদস্তি, অর্থ নয় ছয়ের পরও আমি একত্রে কাজ করতে চাই। কারণ ঢাবি শিক্ষার্থীরা তেমনটিই চান। যারা অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও স্বোচ্চার আছি। যারা অসাধু তারা খুব বেশি সুযোগ সন্ধানী হয়। আমরা এরই মধ্যে প্রায় ছয়জনের নাম পেয়েছি যারা এখন ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদ হোল্ড করছেন। তারা অসাধু উপায়েই ভর্তি হয়েছেন বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। আমরা প্রশাসনকে এসব তথ্য দিয়েছি। আমাদের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। আমরা চাই ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেও এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। তা না হলে ঢাবির শিক্ষার্থীরা ধরে নেবে ছাত্রলীগই এসব কাজের মূল হোতা।'

নুর আরও বলেন, 'তবে এত কিছুর পরেও আমাদের অনেক অর্জনও রয়েছে এ সময়ে। আমরা অবৈধদের হল থেকে বের করতে কাজ করছি, অনেক বিভাগ ও হলের অযৌক্তিক ফি কমানো হয়েছে, আরও কিছু বিভাগের এ ধরনের ফি কমানোর বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে, খাবারের মান ও দাম নির্ধারণ, রিডিং রুমের সিট বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমরা কাজ করছি। হল নির্মাণের মতো বিষয় সময়সাপেক্ষ হলেও আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যখন দেখা করি তখন আমাদের একাডেমিক ও আবাসনের দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে তাকে অনুরোধ করি। প্রধানমন্ত্রী সে ডাকে সাড়া দিয়েছেন। ভবন নির্মাণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে। কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আমাদেরকে বিব্রত করেছে। তবে আমি থেমে যাব না। কেউ সহায়তা করুক বা নাই করুক আমি আমার জায়গা থেকে ঢাবি শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব।'

এ বিষয়ে ডাকসুর এজিএস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, 'কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে। এটার দায় অস্বীকার করব না। তবে আগামীতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব যেন এ ধরনের ঘটনা এড়ানো যায়। এসব কিছু বিষয় বাদ দিলে মাত্র এই এক মাসে আমরা কিন্তু একেবারে কম কাজ করিনি। অবৈধদের হল থেকে বের করা, বিভাগ ও হলের অযৌক্তিক ফি কমানো, রিডিং রুমের সিট বাড়ানোসহ নতুন ভবন নির্মাণে প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করা, লাইব্রেরি রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা রাখতে প্রশাসনকে অনুরোধ করা- এসব বিষয়ে আমরা কাজ করেছি, করছি এবং করব।'

ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদে জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা রয়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক গ্রম্নপে এ বিষয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে সাদ্দাম হোসেন বলেন, 'সুবিধাবাদীরা সব সময় সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে। এমন কেউ প্রবেশ করলে তা আমাদের অগোচরেই ঘটেছে। আমরা জ্ঞাতসারে এমন কাউকে পদ দেইনি। এমন যেন আর না ঘটে সে জন্য আমরা এখন থেকে তৎপর থাকব।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<46269 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1