মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
বিবিসি প্রতিবেদন

যৌন নির্যাতন: শিশুদের কীভাবে সচেতন করবেন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক সামিনা লুৎফা বলেন, এগুলোকে নিয়ে পরিবারের সবাইকে একসঙ্গে বসে কথা বলতে হবে যে আমাদের শিশুরা কারও কাছে নিরাপদ নয়
যাযাদি ডেস্ক
  ২০ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০
আপডেট  : ২০ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০৫
সূর্যমুখী ফুল বাগানের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দুই শিশু শিক্ষার্থী -ফাইল ছবি

দেশে গত ১৫ দিনেই কমপক্ষে ৪৭টি শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯টিই ছিল ধর্ষণের ঘটনা। উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এ তথ্য দিয়েছে। শিশুদের প্রতি এমন নির্যাতনের সংখ্যা হঠাৎ করে বাড়ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। যারা এসব ঘটনার শিকার, অর্থাৎ সেই শিশুদের যৌন নির্যাতন কাকে বলে আর তাদের নিজের প্রতি তা ঘটছে কি-না, সেটি শিশুরা কীভাবে চিহ্নিত করবে? এমন স্পর্শকাতর বিষয় অভিভাবকরা ছোট শিশুদের কীভাবে শেখাতে পারেন? বিষয়টি জানানো দরকার; কিন্তু তা কতটা মুশকিল? কয়েকজনের মায়ের কথা : কর্মজীবী এক মা। অফিসে থাকলেও মাথার মধ্যে সারাদিন ঘুরতে থাকে তার সাত আর ১০ বছর বয়সী দুটি কন্যা শিশুর কথা। কী করছে তারা সারাদিন? বলছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মা। সে উদ্বেগের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, 'চারপাশে আজকাল যা ঘটে তা খুবই ভীতিকর। যেমন কিছুদিন আগে ডেমরায় দুটি বাচ্চা খেলা করছিল। ওদের লিপস্টিক কিনে দেয়ার কথা বলে নিয়ে গিয়েছে। তারপর রেপ করে মেরে ফেলেছে। এ খবরটা যখন দেখলাম তখন সঙ্গে সঙ্গেই আমার নিজের বাচ্চা দুটির চেহারা ভেসে উঠল। এগুলোর কারণেই আমি সব সময় একটা টেনশনে থাকি।' এই মা বলেন, সন্তানকে তিনি সেভাবেই প্রস্তুত করছেন। তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু যৌন নির্যাতন কাকে বলে, সেটি শিশুরা কীভাবে চিহ্নিত করবে, সাত ও দশ বছর বয়সী ছোট শিশুদের এমন জটিল বিষয় তিনি কীভাবে জানাচ্ছেন? তিনি বলেন, 'আমি ওদের শিখিয়েছি কোন স্পর্শটা ভালো আর কোনটা খারাপ। আমি আমার বাচ্চাদের সঙ্গে একটা ওপেন রিলেশনশিপ তৈরি করার চেষ্টা করেছি। যাতে ওরা আমাকে সব কিছু বলতে পারে। তারা নিজেরাই নিচে খেলতে যায়। তাদের শিখিয়েছি কেউ যদি তোমাকে বলে আমার সঙ্গে আস, তোমাকে খেতে দেব, তোমার মা বলেছে। তুমি কখনোই যাবে না।' ছেলে বাচ্চাকে নিয়েও ভাবা দরকার নানা উদ্বেগের কারণে সাত বছর বয়সী ছেলের দেখভালের জন্য মাহিন চৌধুরী তার চাকরিটাই ছেড়ে দিয়েছেন। তাকে চোখের আড়াল হতে দেন না প্রায় কখনোই। কিন্তু ছেলে সন্তান বলে তার প্রতি যৌন নির্যাতনের কোনো ঘটনা যে ঘটতে পারে তিনি সেটা ঠিক ভাবেন না। তিনি বলেন, 'সত্যি কথা বলতে কী, আমার যদি মেয়ে বাচ্চা হতো তাহলে অনেক বেশি এ ব্যাপারে চিন্তিত হতাম। কিন্তু যেহেতু আমার ছেলে বাচ্চা, তুলনামূলকভাবে কিন্তু ওই চিন্তাটা একটু কমই আসে। টেনশনটা কম হয়। কিন্তু তারপরও বাচ্চার কথা চিন্তা করেই আমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি।' বিষয়টি নিয়ে কথা বলা কঠিন কিন্তু তিনিও তার বাচ্চাকে এ বিষয়টি বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু একটি শিশুর মাথায়, যৌন নির্যাতনের ধারণাটা অনুপস্থিত। আপত্তিকর বিষয়টিও সে বোঝে না। তার কাছে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা কঠিন বলে জানালেন মাহিন চৌধুরী। তিনি বলেন, 'একটি ছোট বাচ্চাকে বিষয়টি বোঝানো খুব কঠিন। আর সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ তো আমাদের নেই। দেশের বাইরে দেখি মা বা অভিভাবকদের ট্রেইন করা হয়। সচেতনতামূলক অনেক বার্তা থাকে। আমি ছেলেকে ভালো আদর, খারাপ আদর বিষয়টির পার্থক্যটা বোঝানোর চেষ্টা করেছি।' বাবাদের জন্য বিষয়টি কি বেশি কঠিন? তামিম হাসানের স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন দুই বছর আগে। এ ঘটনার কারণে তিনি একজন 'সিঙ্গেল প্যারেন্ট'। তবে এরপর থেকে সাড়ে তিন বছরের সন্তানকে বড় করতে তিনি তার পরিবারের সহায়তা পাচ্ছেন। মায়ের ওপর তিনি অনেকটাই নির্ভরশীল। কিন্তু শিশুটির প্রতি তিনি বাড়তি মনোযোগ দেন, কারণ তার মা নেই। তাই ছেলের ব্যাপারে তার উদ্বেগ আরও বেশি। তবে তার মতে বাবাদের জন্য শিশুদের এ বিষয়ে শেখানো বেশ কঠিন, কারণ বাংলাদেশের সমাজে বাবাদের সেভাবে তৈরি করা হয় না। সন্তানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার ধরন ভিন্ন। তিনি বলেন, 'একজন মা যেভাবে বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতে পারেন, একজন বাবা সেভাবে পারেন না। বাবাদের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের একটু দূরত্ব থাকে। বাবারা অফিসের কাজে বাইরে থাকেন বেশি। তাই ততটা সময় দিতে পারেন না। আর সিঙ্গল মায়ের থেকে সিঙ্গল বাবাদের জন্য বিষয়টা তো আরও কঠিন।' একজন চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীর দেয়া টিপস শিশুদের এরকম একটি বিষয়ে কীভাবে জানানো যায় সে প্রসঙ্গে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী ডা. ইশরাত শারমিন রহমান বলেন, একটি শিশু এমন প্রসঙ্গ বোঝার ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু তবুও তাকে জানাতে হবে। আর তার জন্য কী করা যেতে পারে সে ব্যাপারে তিনি কয়েকটি টিপস দেন। তিনি বলেন, 'একটি শিশুকে তার শরীরের তিনটি জায়গা সম্পর্কে জানাতে হবে। তার ঠোঁট, গোপনাঙ্গ ও পায়ুপথ। তাকে জানাতে হবে এই তিনটা তার বিশেষ জায়গা। এখানে বাবা-মা গোসল করানো বা পরিষ্কার করার সময় ছাড়া অন্য কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। কেউ সেটি করলে সে কী করবে সেটিও তাকে জানানো। সেটি বাবা-মাকে যে জানাবে সেটি শেখাতে হবে। এতে বাচ্চারা সচেতন থাকবে।' শিশুদের কি ভয় বাড়িয়ে দেয়া হবে? ডা. ইশরাত শারমিন বলেন, বিষয়টি জানানোর কাজ সঠিকভাবে করার জন্য অভিভাবকদের আগে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। জিনিসটা করতে হবে একটু খেলার ছলে, ছবি এঁকে অথবা গল্প করে ধীরে ধীরে ধারণাটা তার মাথায় দিয়ে দিতে হবে। বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মুখে বলা যেতে পারে। কিন্তু শিশুরা সবকিছু ভুলে যায়। তাদের মধ্যে সন্দেহ কম, তাই তাদের বিষয়টি মনে করিয়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, 'শিশুর আচরণ পরিবর্তন খেয়াল করতে হবে। বাচ্চার আচরণ থেকেও অনেক সময় অনেক কিছু বোঝা যায়। সে যদি কাউকে দেখে ভয় পায়, কারও কোলে যেতে না চায়, তাকে জোর করা উচিত নয়। যে বাচ্চা বিছানা ভেজানো বন্ধ করে দিয়েছে, সে যদি হঠাৎ আবার তা করে। সে যদি ভয় পেয়ে চমকে ওঠে বা রাতে দুঃস্বপ্ন দেখছে, এমন পরিবর্তন খেয়াল করতে হবে।' শিশুর কথা শুনতে হবে ও তাকে বিশ্বাস করতে হবে বাংলাদেশে শিশুদের কথা না শোনার একটি প্রবণতা রয়েছে। ডা. ইশরাত শারমিন বলেন, 'বাচ্চারা যদি এই বিষয়ক কিছু কখনো বলে সেটিকে সিরিয়াসলি নিতে হবে, বাবা-মাকে বিশ্বাস করতে হবে। কারণ বাচ্চারা যতরকম গল্প বানিয়ে বলুক না কেন এ বিষয়ে বানিয়ে কথা বলার ক্ষমতা তার থাকার কথা নয়।' তিনি বলেন, 'আমার ক্লায়েন্টদের দেখে বলছি, অনেক বাবা-মা বিষয়টি বিশ্বাস করতে চান না, মানতে চান না। অনেক সময় বলেন, তুমি বানিয়ে বলছ। এরকম হলে শিশুরা তার বলার জায়গাটি হারিয়ে ফেলে। এতে নির্যাতক ব্যক্তি আরও সুযোগ পায়।' সামাজিক সম্পর্কের কথা কতটা ভাববেন? ডা. ইশরাত শারমিন বলেন, শিশুকে কার কাছে দিচ্ছেন, বাবা-মায়েদের সেদিকে নজর রাখা উচিত। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য, আত্মীয়, প্রতিবেশী অথবা ঘনিষ্ঠদের দ্বারাই যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে। কিন্তু হঠাৎ করে বাচ্চাদের সচেতন করতে গিয়ে নিজের পরিবারের সদস্য অথবা আত্মীয়দের সন্দেহ করা শুরু করবেন কি-না সে ব্যাপারেও ভাবেন অনেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক সামিনা লুৎফা বলেন, 'সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট করার ভয়ে অনেক সময় এগুলো নিয়ে সবাই চুপ করে থাকে। কিন্তু এগুলোকে নিয়ে পরিবারের সবাইকে একসঙ্গে বসে কথা বলতে হবে যে আমাদের শিশুরা কারও কাছে নিরাপদ নয়।' তিনি বলেন, 'আপনি কেন ভাবতে যাবেন আপনার ভাইকে বা বাবাকেও আপনার সন্দেহ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ আলোচনাটা যদি পরিবারে খাবার টেবিলে হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু সবাই এ বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন থাকে।' বিবিসি বাংলা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে