বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শবেবরাত ও রমজানের মজুদ পণ্য পুড়ে ছাই

যাত্রাবাড়ীর মাদ্রাসার পর মালিবাগের কাঁচাবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড
যাযাদি রিপোর্ট
  ১৯ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০
বৃহস্পতিবার রাজধানীর মালিবাগ কাঁচাবাজারে আগুন লেগে বেশ কিছু দোকান পুড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে -ফোকাস বাংলা

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা কুতুবখালী এলাকায় বুধবার দিবাগত মধ্যরাতে একটি মাদ্রাসা ভবনের নিচতলায় টেলিভিশনের গোডাউনে আগুন লেগে সেখানে রাখা মালামাল পুড়ে গেছে। আগুন লাগার পরপরই ভবনের ৬ ও ৭ তলায় থাকা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের পাশের একটি বাড়ির ছাদ দিয়ে দ্রম্নত নামিয়ে আনায় তাদের কেউ গুরুতর আহত হয়নি। তবে আগুন লাগার খবরে আতঙ্কিত হয়ে মাদ্রাসার কয়েকজন ছাত্র তাড়াহুড়ো করে বিকল্প পথে নামতে গিয়ে কিছুটা আঘাত পেয়েছেন।

এই ঘটনায় মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার ভোরের দিকে ভয়াবহ আগুনে মালিবাগ কাঁচাবাজারের প্রায় আড়াইশ' দোকান ভস্মীভূত হয়েছে। এ ঘটনায় দোকানিরা কেউ হতাহত না হলেও আগুনে তাদের সর্বস্ব পুড়ে যাওয়ায় দিনভর সেখানে কান্নার রোল শোনা গেছে। আসন্ন শবেবরাত ও রমজান উপলক্ষ্যে বাজারের প্রতিটি দোকানি তাদের শেষ সম্বল ভেঙে প্রচুর মালামাল মজুদ করেছিলেন। তা পুড়ে যাওয়ায় তাদের এখন পথে বসতে হবে বলে আহাজারি করেন ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিরা।

ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, বুধবার দিবাগত রাত আনুমানিক ১২টা ৫ মিনিটের দিকে উত্তর কুতুবখালীর বায়তুল মামুর জামে মসজিদের পাশের গলিতে একটি ভবনের নিচতলায় আগুন লাগে। এখানে টেলিভিশনের গোডাউন ছিল। ভবনের ৬ ও ৭ তলায় মাদ্রাসার শিক্ষার্থী থাকত। অগ্নিকান্ডের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিট দ্রম্নত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালায়। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর রাত ১টা ৩২ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে এর আগেই মাদ্রাসার নিচতলার ওই টেলিভিশন গুদামের সব মাল পুড়ে যায়।

ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণকক্ষের কর্তব্যরত কর্মকর্তা মাহফুজ রিবেন গণমাধ্যমকে জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে বৈদু্যতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত। তবে এ ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

স্থানীয় দোকানি মোসলেম উদ্দিন জানান, বুধবার রাত ১২টার দিকে আকস্মিক টেলিভিশনের গোডাউন থেকে কুন্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া বাইরে বের হতে থাকে। এ সময় আশপাশের লোকজন 'আগুন' 'আগুন' বলে চিৎকার শুরু করলে চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের ৬ ও ৭ তলায় থাকা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা নিরাপদে সেখান থেকে নেমে আসতে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি শুরু করে। খবর পেয়ে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ দ্রম্নত ঘটনাস্থলে পৌঁছে সেখানে আটকে পড়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের পাশের বাড়ির ছাদ দিয়ে নামিয়ে আনতে সহায়তা করে।

ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণকক্ষের অপারেটর ফরহাদুল আলম জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর টেলিভিশনের গোডাউনে থাকা পুড়ে যাওয়া মালামাল বাইরে বের করে এনে কয়েকটি জায়গায় স্তূপ করে রাখা হয়। তবে ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে কিছু জানা যায়নি।

যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী ওয়াজেদ আলী মিয়া যায়যায়দিনকে জানান, ৭ তলা ভবনের পঞ্চম থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত ওই মাদ্রাসার নাম ইফতান। সেখানে আনুমানিক একশ'জন শিক্ষার্থী থাকেন। অগ্নিকান্ডের সময় তাদের সবাইকে নিরাপদে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

মালিবাগ কাঁচাবাজারে আগুন : রাজধানীর গুলশান কাঁচাবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর সপ্তাহ না ঘুরতেই খিলগাঁও কামারপাড়া বস্তি কাঁচাবাজারে আগুন এবং এ ঘটনার মাত্র ১৪ দিনের মাথায় মালিবাগ কাঁচাবাজার ভস্মীভূত হওয়ার ঘটনায় স্তম্ভিত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এসব অগ্নিকান্ডের নেপথ্যে বিশেষ কোনো মহলের ষড়যন্ত্র রয়েছে কি না তা নিয়েও সংশয়ে তারা।

তবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের দাবি, প্রতিটি কাঁচাবাজারে আগুন লাগার ঘটনায় দোকানিদের অসচেতনতা এবং মার্কেট কমিটির দুর্বল তদারকির প্রমাণ পাওয়া গেছে। একের পর এক অগ্নিকান্ড ঘটলেও তাদের কেউই সতর্ক হয়নি।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, রাজধানীর মালিবাগ কাঁচাবাজারে আগুন লাগার ঘটনায় প্রায় ২৫০ দোকান পুড়ে গেছে। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে দাবি দোকানিদের।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৃহস্পতিবার ভোর ৫টা ২৭ মিনিটে ওই বাজারে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে ভোর ৬টা ৩৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে দোকানিদের অনেকেই বাজারে আগুন লাগার খবর তাৎক্ষণিক পাননি। তারা সকালে বাজারে এসে চোখের সামনেই নিজেদের দোকান পুড়তে দেখেন। তবে আগুনের ভয়াবহতার কারণে কেউ তা রক্ষা করতে এগিয়ে যেতে সাহস পাননি। এ সময় দোকানিদের অনেককে উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করতে দেখা গেছে। বড় ব্যবসায়ীরা আহাজারি না করলেও তাদের চোখেমুখে ছিল চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।

সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সরেজমিনে মালিবাগ বাজার ঘুরে দেখা যায়, আগুনে বাজারের প্রায় সব দোকান পুড়ে গেছে। বেশির ভাগ দোকানের মজুদকৃত আলু, চাল, গরম মসলা, চিনি, তেলসহ সব মাল পুড়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

মাছ, সবজি ও ডিমের দোকানেরও কোনো কিছুই আর বিক্রয়যোগ্য নেই। পুড়েছে ৩০টি ছাগল, দুটি গরু, অর্ধ সহস্রাধিক মুরগি এবং মজুদ রাখা কয়েক মণ ছোট-বড় মাছ। তবে দারোয়ানের বুদ্ধিমত্তার কারণে বাজার সংলগ্ন একটি মেসে ঘুমিয়ে থাকা অন্তত ৫০ জন প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন।

হতাশ ব্যবসায়ীরা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। কেউ দোকানের বাইরে বসে কাঁদছেন, কেউ পুড়ে যাওয়া মালের ধ্বংসস্তূপ থেকে ভালো মাল খুঁজে বের করছেন।

আগুনে পুড়ে যাওয়া দোকানের পাশে বড় ভাইকে জড়িয়ে কাঁদছেন গরম মসলা ব্যবসায়ী মালেক। তিনি জানান, শুক্রবার ও শবেবরাত উপলক্ষ্যে তার দোকানে মাল বেশি ছিল। আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার কম হবে না। আগুনে গরম মসলা তো পুড়েছেই, এছাড়া দোকানের শাটার, কাঠের তাক এবং ক্যাশবাক্সও পুড়ে গেছে।

চাল ব্যবসায়ী মো. মামুন জানান, তার দোকানে ২৫ লাখ টাকার চাল ছিল। এর মধ্যে ৪০-৪৫ বস্তা চাল বাঁচাতে পেরেছেন। তবে এগুলোর অধিকাংশই পানিতে ভিজে গেছে।

কাঁচাবাজারের চারটি মুদি দোকানের মালিক নাদিম আলী। আগুনে তার ৩টি দোকান পুরোপুরি পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, এই বাজার মধ্যবিত্তদের অনেক পছন্দের ছিল। বাড্ডা-রামপুরা থেকেও অনেকে এখানে এসে বাজার করতেন। রমজান মাসে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, এ আশঙ্কায় তিন-চার বছর ধরে ক্রেতারা আগেভাগেই রোজার কেনাকাটা করেন। তাই সবাই অনেক মাল মজুদ করেছিলেন। তাদের সবই পুড়ে গেছে। সরকার ঋণ না দিলে তাদের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না।

কাঁচাবাজারের একটু ভেতরে কসাইপট্টিতে আগুনে পুড়ে মরা ছাগল সামনে রেখে কাঁদছিলেন আমজাদ হোসেন নামে আরেক ব্যবসায়ী। তিনি জানান, বুধ ও বৃহস্পতিবার বেশি মাল থাকে। কারণ শুক্রবার বেশির ভাগ মানুষ বাজার করে। বুধবার রাতে তিনি কুষ্টিয়া থেকে দেড় লাখ টাকার ১৮টি ছাগল এনেছিলেন। সকালে জবাই করার কথা ছিল। তার সব ছাগলই পুড়ে গেছে বলে জানান আমজাদ হোসেন।

মালিবাগ বাজার বণিক সমবায় সমিতির কার্যকরী কমিটির সদস্য মো. নুরুল হক নুরু বলেন, ২৬০টির দোকানের কোনোটির অবশিষ্ট নেই, নগদ টাকাও পুড়েছে। এতে প্রায় ২০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দিলীপ কুমার ঘোষ বলেন, ২০-২৫ জনকে নিরাপদ স্থানে বের করা হয়েছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে আগুন লাগার কারণ জানা যায়নি। তদন্ত কমিটি গঠন করে এর কারণ বের করা হবে।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ফায়ার সার্ভিস প্রথমে পানি ছাড়া এসেছে। তারা দ্রম্নত আগুন নির্বাপণের কাজ শুরু করলে বেশ কিছু দোকান রক্ষা করা যেত।

তবে ফায়ার সার্ভিস জোন-৬ এর পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান বলেন, খবর পেয়েই তারা দ্রম্নত ঘটনাস্থলে আসেন। তবে পানির কানেকশন দিতে কিছু সময় লাগে। তাই অনেকে মনে করেছেন, দমকলকর্মীরা পানি ছাড়াই ঘটনাস্থলে গিয়েছে।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করেন ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা বলেন, আগুন নেভানোর প্রক্রিয়ায় তাদের কোনো ত্রম্নটি ছিল না। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে ভোর ৬টা ৩৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে এর আগেই আগুনে বাজারের প্রায় ২৫০ দোকান পুড়ে গেছে।

ক্ষতিগ্রস্ত এক দোকানি জানান, পাশের পলিথিনের দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় ভোর ৫টার দিকে। এরপরই অন্য দোকানে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

এদিকে বাজার কমিটির কর্মকর্তারা জানান, শবেবরাত ও রমজানকে সামনে রেখে বাজারের প্রায় সব দোকানেই বিপুল পরিমাণ খাদ্য ও ভোগ্য পণ্য মজুত ছিল, যার সবই আগুনে পুড়ে গেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<45978 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1