শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সিলেট-নারায়ণগঞ্জের বাতিল গাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঢাকা

সাখাওয়াত হোসেন
  ২৭ মার্চ ২০১৯, ০০:০০
রাজধানী ঢাকায় অবাধে চলছে দেশের বিভিন্ন জেলার নিবন্ধন বাতিল হওয়া সিএনজি অটোরিকশা। ছবিটি মঙ্গলবার মালিবাগ বিশ্বরোড এলাকা থেকে তোলা -যাযাদি

মালিবাগ বাজার থেকে বিশ্বরোড ধরে কিছুটা পূবদিকে এগিয়ে বাম পাশের বাইপাস সড়কে যাত্রীর জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে ১৫-২০টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা। এর কোনোটি সিলেট, কোনোটি নারায়ণগঞ্জ, কোনোটি আবার মুন্সিগঞ্জ কিংবা গাজীপুর জেলা থেকে নিবন্ধিত। এসব অটোরিকশার একটিরও মিটার নেই। ভাঙাচোরা বডির অনেক জায়গাতেই রং উঠে গেছে; বাম্পার-হেডলাইটসহ বিভিন্ন অংশ জিআই তার কিংবা মোটা রশি দিয়ে বাঁধা। চলন্ত গাড়ির ঘড় ঘড় বিকট আওয়াজ শুনলেই বোঝা যায় ইঞ্জিনের অবস্থাও বেশ নাজুক। ঢাকা মহানগরীর বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরের এসব অটোরিকশার নিবন্ধন বাতিল হয়েছে বেশ আগেই। তাই বাতিল এ অটোরিকশাগুলো সেখানে চলতে দেয়া হয়নি। অথচ নিবন্ধনহীন ভিন্ন রুটের যানবাহন আটকে নগরজুড়ে চলমান বিশেষ অভিযানের মধ্যেও অবৈধ এ অটোরিকশা নির্বিঘ্নে ঢাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু মালিবাগই নয়, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ, ধানমন্ডি, জিগাতলা থেকে হাজারীবাগ হয়ে ঝাউচর, ভাটারার নতুনবাজার থেকে বনানী, জোড়পুকুর মাঠ থেকে দক্ষিণ বনশ্রী, গোড়ান, সিপাহীবাগ, যাত্রাবাড়ী থানার কাজলা ব্রিজ থেকে নারায়ণগঞ্জ, জুরাইন রেলগেট থেকে কেরানীগঞ্জ, ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার মোড় থেকে নন্দীপাড়া, মিরপুর ১০ নম্বর থেকে ১৪ নম্বরসহ বিভিন্ন এলাকায় বাতিল এসব অটোরিকশা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। অবৈধভাবে চলাচলকারী বাতিল এসব অটোরিকশার সঠিক হিসাব পাওয়া না গেলেও, এ সংখ্যা অন্তত ১০ হাজার বলে জানিয়েছেন অনেকেই। তবে ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের একাধিক নেতার দাবি, এসব অটোরিকশা সংখ্যা অন্তত ১২ হাজার। বৈধ অটোরিকশার মালিক-চালকেরা বলছেন, বিষয়টি বহুবার প্রশাসনকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি একটি অবৈধ অটোরিকশা আটকেরও কোনো নজির নেই। কীভাবে চলে এমন অটোরিকশা- জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের একজন নেতা বলেন, অবৈধ অটোরিকশাগুলো চালাতে প্রতি মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পাশাপাশি পুলিশ এই চাঁদার ভাগ পায়। ফলে এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না কেউই। সরেজমিনে দেখা গেছে, ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার মোড় থেকে অটোরিকশাগুলো চলে নন্দীপাড়া মোড় পর্যন্ত। ওই রুটের দুজন অটোরিকশার চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ পথে অবৈধ অটোরিকশাগুলো চালাতে দৈনিক ১৮০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। পুলিশ কোনো বাধা দেয় কি না জানতে চাইলে তারা বলেন, চাঁদার টাকার ভাগ পুলিশও পায়। তাই সমস্যা হয় না। আবার রায়েরবাজার থেকে আঁটিবাজার পর্যন্ত রুটেও একইভাবে চলে ঢাকা জেলা থেকে নিবন্ধন নেয়া অটোরিকশা। এই রুটের একাধিক চালক জানিয়েছেন, অটোরিকশাগুলো চালাতে প্রতিদিন ২১০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। মালিবাগ থেকে জোড়পুকুর মাঠ, দক্ষিণ বনশ্রী ও গোড়ান রুটে চলা অবৈধ অটোরিকশাগুলোকে দিতে হয় প্রতিদিন ১৭০ টাকা। স্বপন নামের এক ব্যক্তি অটোরিকশাগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। এ ছাড়া শ্রমিক লীগের বেশ কয়েকজন নেতাও এ চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। জানা গেছে, রুট ধরে এভাবে চাঁদা নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো রসিদ বা প্রমাণ রাখা হয় না। টাকা নেয়া হয় অনেকটা গোপনে। ঢাকা জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন জানান, নম্বর পেস্নটে ঢাকা মেট্রো লেখা অটোরিকশাগুলোই কেবল ঢাকা মহানগরীতে চলতে পারবে। এমন অটোরিকশার সংখ্যা ১৩ হাজার ৬৪৯। তবে ঢাকায় কত অবৈধ অটোরিকশা চলে তার সঠিক হিসাব তার কাছে নেই। বিআরটিএর উপ-পরিচালক পদমর্যদার একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাতে রুট পারমিট, ফিটনেস সনদের প্রয়োজন হয়। অবৈধভাবে চলা অটোরিকশাগুলোর কোনো রুট পারমিট নেই। এগুলোর বিরুদ্ধে বিআরটিএ নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। বিআরটিএর পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশ ও সিটি করপোরেশনও এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের একাধিক নেতার অভিযোগ, ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক ও সার্জেন্ট এই অবৈধ অটোরিকশাগুলো চলতে সাহায্য করে। আগে পরিদর্শক ও সার্জেন্টের দেয়া বিভিন্ন ছবিসংবলিত টোকেন নিয়ে অবৈধ অটোরিকশাগুলো চলত। এখন একটি কাগজে লেখা ফোন নম্বর দিয়ে অটোরিকশাগুলো চলে। তবে ডিএমপির একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার দাবি, এ অবৈধ অপতৎপরতার সঙ্গে মূলত ক্ষমতাসীন দলের নেতারা জড়িত। তারা তাদের সুবিধামতো ঢাকার বাইরের জেলা শহর থেকে নিবন্ধন বাতিল হওয়া অটোরিকশা এনে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চালানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। তবে এসব গাড়ি কোনোটিই তাদের নিজের নয়। অটোরিকশা চালকরাই মূলত এর মালিক। এসব অটোরিকশা যে কোনো রুটে যুক্ত করতে স্থানীয় নেতাদের ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। এর বাইরে প্রতিদিনের খরচা তো রয়েছেই। পুলিশের কোনো কোনো সদস্য গোপনে এসব অটোরিকশার চালকদের কাছ থেকে উৎকোচ নিলেও নির্ধারিত অংকের কোনো টাকা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কেউ নেন না বলে দাবি করেন তারা। যদিও অবৈধ অটোরিকশা চালকরা এ চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত ট্রাফিক পুলিশের একাধিক পরিদর্শক ও সার্জেন্টের নামও এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। তবে তাদের উৎকোচ গ্রহণের ব্যাপারে কোনো প্রমাণ তারা দিতে পারেননি। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (দক্ষিণ) মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ট্রাফিক পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে