শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
বাঘাইছড়ি থেকে বলছি

ভোটের দায়িত্বে থাকা এক ম্যাজিস্ট্রেটের শোকলিপি

যাযাদি ডেস্ক
  ২১ মার্চ ২০১৯, ০০:০০
আপডেট  : ২১ মার্চ ২০১৯, ০০:০৮
ইমদাদুল হক তালুকদার

রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে ভোট শেষে ফেরার পথে নির্বাচনকর্মীদের ওপর হামলায় হতাহতদের প্রথমে যে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল, সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন ভোটের দায়িত্ব পালনে ওই এলাকায় যাওয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক তালুকদার। বুলেটবিদ্ধ মৃতদেহ, রক্তাক্তদের আর্তচিৎকার আর তাদের স্বজনদের আহাজারি ছুঁয়ে যায় এই তরুণ কর্মকর্তার হৃদয়। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে পিছপা হননি তিনি। গুরুতর আহতদের তড়িঘড়ি করে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রামে পাঠানোর প্রক্রিয়ায় তৎপর ছিলেন, সাহস যুগিয়েছিলেন মৃতু্যপথযাত্রী পোলিং অফিসার আবু তৈয়বের ভাইকে। কিন্তু মাঝআকাশেই তৈয়বের মৃতু্যর পর তাকে ঘিরে একটু স্বচ্ছলতার স্বপ্নবোনা ওই ভাইয়ের প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি তিনি। নিদারুণ বেদনার সেই সব স্মৃতি ফেইসবুক পোস্টে তুলে ধরেছেন কুমিলস্নার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নির্বাহী হাকিম ইমদাদুল। গত সোমবার সন্ধ্যায় ওই হামলায় সাতজন নিহত ও ১৫ জন আহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে রাতেই 'বাঘাইছড়ি থেকে বলছি' শিরোনামে ওই ফেইসবুক পোস্টে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি। তিনি লিখেছেন, 'এসেছিলাম নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে। ভোট বর্জনের মাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রার্থী সরে দাঁড়ালেন শান্তিপূর্ণভাবে। সারা দিন খুব স্বাভাবিক, শান্ত পাহাড়ি জনপদ। সন্ধ্যায় হুট করে রক্তারক্তির খবর! দৌড়ে গেলাম হাসপাতালে। তিনটি চান্দের গাড়িতে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ, হাসপাতালের সিঁড়ি আর মেঝেতে রক্তের ছটা আর ভেতরে তীব্র আর্তনাদ! পুরো ওয়ার্ডে রক্তাক্ত মানুষ; কিছু মৃত, কিছু আর্তচিৎকারে হতবিহ্‌বল। কান্না, রক্ত, অসহায়ত্ব, মাতম। ৬ জন ততক্ষণে নিথর মৃত। আশঙ্কজনক ১১ জন ভয়াবহ আশঙ্কাজনক। বাকিরা চিকিৎসারত। 'ইউএনও স্যার, আমি, আর আরেক ম্যাজিস্ট্রেট রুহুল দিগবিদিকশূন্য ছুটছি রক্তাক্ত সিঁড়ি, করিডোর আর ওয়ার্ডে। কাতরদের পাঠাতে হবে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম। তাহলে হয়তো বাঁচবে। আমি পুলিশ সাথে নিয়ে চিৎকার করছি গাড়িযোগে হেলিপ্যাডে পাঠাতে। আমাদের গাড়িতে একটার পর একটা গুলিবিদ্ধ মানুষকে পাঠাচ্ছি। তারপর হেলিপ্যাডের দিকে যাত্রা। ছয়টি লাশ হাসপাতালে রেখে সবুজ হেলিপ্যাডের মাঠে আমরা। লাইন ধরে শুয়ে থাকা বিক্ষত মানুষ। কারও বুক থেকে, কারও মগজ থেকে, কারও উরু থেকে, কারও ডানা থেকে 'সস্তা' রক্ত ঝরছে। প্রথম দফায় ছয়জনকে উড়ানো হল। তার মধ্যে পোলিং অফিসার (প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক) আবু তৈয়বও ছিলেন। তার বড় ভাই বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন আর আমাকে ধরে বলছিলেন, স্যার, আমার ভাইটাকে বাচান; আমার ভাই ছাড়া আমার বেঁচে থেকে লাভ কী? আমার ভাইটা কিছুদিন আগে চাকরি পেয়েছে স্যার। অনেক কষ্টে আমি ভাইটারে পড়ালেখা শিখাইছি। 'আমি নিরুত্তর। কিছুক্ষণ পর জনা গেল, তৈয়ব আকাশপথে মারা গেছে। ওর ভাই আমাকে এসে কেবল বলল, স্যার, আপনে না কইছিলেন আমার ভাইয়ের কিচ্ছু হবে না। স্যার, আমার ভাই তো নাই স্যার। 'এদিকে অনেকের মাঝে আনুমানিক ১০ বছরের শিশু, চান্দের গাড়ির হেল্পার সাদ্দাম কাতরাচ্ছে। ওর লিঙ্গ ভেদ করে গুলি বের হয়ে গেছে। কপালে, মাথায় হাত বুলাতে গিয়ে কেমন গলা ধরে এলো। সাড়ে এগারোটায় শেষ লটে সবাইকে বিদায় জানিয়ে শূন্যতা নিয়ে ফিরে এলাম।' এই কর্মযজ্ঞ শেষে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যেন পাহাড়ের স্তব্ধতাকে অনুভব করেন ইমদাদুল। 'এখন পাহাড়ে শূন্যতা, জ্যোৎস্না স্নিগ্ধ আলোয় ছাপিয়ে রেখেছে অরণ্য। অরণ্যের গহিনে পাখিরা ঘুমোচ্ছে, আর চোখে জল নিয়ে জেগে আছে আর্তদের স্বজনেরা', লিখেছেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে