শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বকাপ হেরেও মন জিতেছে ক্রোয়েশিয়া

ক্রীড়া ডেস্ক
  ১৭ জুলাই ২০১৮, ০০:০০
আপডেট  : ১৭ জুলাই ২০১৮, ০০:৪৫
রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে হেরে রানাসর্আপ হয়ে পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে যাচ্ছেন ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলাররা। বিশ্বকাপ জিততে না পারলেও দলটি মন জয় করেছে ফুটবলপ্রেমীদের Ñওয়েবসাইট

ডেনমাকর্, রাশিয়া, ইংল্যান্ড। পরপর অঘটন ঘটাতে ঘটাতে শীষের্। স্বপ্নের ঘোড়া এসে থামল ফ্রান্সের সামনে। বিশ্বকাপ ছেঁায়ার মাত্র এক ম্যাচ দূরে। ক্রোয়াটদের কাছে প্রথমবার সুযোগ এসেও অধরাই থেকে গেল বিশ্বকাপ। তবু লড়াইয়ের যে বাতার্ দিয়ে গেল মদ্রিচ-রাকিতিচরা, বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে বহুদিন। প্রত্যাশার পারদ চড়তে চড়তে এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, আবেগ বলছিল, ক্রোয়াটরাই এবার বিশ্বকাপ পাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার ওয়াল, ইনবক্সেও তার প্রতিফলন হচ্ছিল। যুক্তি যতই বলুক, ধারে ভারে এগিয়ে ফ্রান্স, মন জিতে নিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া এবং শেষ পযর্ন্ত যুক্তির কাছে হার মানল আবেগ। জয় হলো শক্তি, দক্ষতা আর নৈপুণ্যের। ক্রোয়াটদের স্বপ্নের দৌড় থামিয়ে বিশ্বকাপ জিতল ফ্রান্স। বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে সোনার বুট নিয়ে গেলেন লুকা মদ্রিচ। সে সঙ্গে ঘরে ফিরলেন বিশ্বের তামাম ফুটবলপ্রেমীদের মন জয় করে। গ্যালারিতে ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কোলিন্দা গ্রাবার কিতারোভিচও ফাইনালের দিনটিতে ছিলেন কিছুটা শান্ত। শুধু দুটি গোলের সময় দু’বার তার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল। ডেভর সুকারকে জড়িয়ে ধরলেন। দু’হাত উপরে তুলে ভেসে গলেন উচ্ছ¡াসে। ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এলেন। সোনার বল নেয়ার সময় জড়িয়ে ধরলেন মদ্রিচকে। উদ্দাম-উচ্ছল গ্যালারি তখন শান্ত, ধীর-স্থির। মুষলধারে বৃষ্টি। আবেগের অগ্নিকুÐে যেন পানি ঢেলে দিয়েছে প্রকৃতি। গ্যালারিতে ঠায় দাঁড়িয়ে ভিজেছেন ক্রোট সমথর্করা। বীরের মতো লড়াই এবং শেষে এসে হার। আনন্দ আর শোকের মিলিত এক ভাবাবেগ। বৃ্িষ্ট আর চোখের পানি মিলিত ধারা হয়ে নামল গাল বেয়ে, নেমে এল লুঝনিকির গ্যালারি বেয়ে। মস্কোর ছবি যদি এটা হয়, জাগরেব যেন আক্ষরিক অথের্ই জাগ্রত হয়ে উঠেছিল। এ জাগরণ ফুটবলের জন্য। নবজাগরণ বললেও হয়তো পুরোটা বলা হয় না। গোটা দেশের সব পথ মিশেছিল ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী জাগরেবে। রাজপথ থেকে অলি-গলি, শুধুই লাল-সাদা রঙের বন্যা। ১৯৯৮ বিশ্বকাপেও প্রায় এমনটাই ঘটিয়েছিলেন ডেভর সুকার। সেই বছরও শুরুর আগে কেউই ধতের্ব্যর মধ্যে রাখেননি ক্রোয়েশিয়াকে। সেই দলই তৃতীয় স্থান নিয়ে দৌড় শেষ করেছিল। সবোর্চ্চ গোলদাতা হিসেবে সোনার বুট পেয়েছিলেন সুকার। এবার আরও এক ধাপ উপরে এবং দোরগোড়ায় এসেও হাতছাড়া বিশ্বকাপ। তবু যেন বিশ্বজয় করেই ফিরলেন সুকারের উত্তরসূরিরা। বষার্র বারিধারা পেয়ে প্রবৃতি হয়ে ওঠে শষ্যশ্যামলা। বষর্ণ তাই নবজন্মের প্রতীক। ফাইনাল ম্যাচের পরও প্রবল বষর্ণ। প্রকৃতিও কী তবে এই বাতার্ দিয়ে গেল, বিশ্ব ফুটবলে জন্ম নিয়েছে এক নতুন শক্তি। যে শক্তি ভবিষ্যতে হয়তো আরও এগিয়ে যাবে। ছুঁয়ে ফেলবে নতুন নতুন মাইলফলক। কে বলতে পারে, হয়তো চার বছর পর কাতারে অনুষ্ঠেয় ২২তম আসরে ছুঁয়ে ফেলবে বিশ্বকাপটাও। কেন দুরন্ত লড়েও জিততে পারল না ক্রোয়েশিয়া কিন্তু ফাইনালে কেন হারতে হলো রাকিতিচ, মানজুকিচদের? প্রথমাধের্র গোড়া থেকেই বিপক্ষ রক্ষণে ক্রমাগত আক্রমণ শানিয়ে গিয়েছেন তারা। তবে গোলের মুখ খোলা যায়নি। আর ফ্রান্স যখনই সুযোগ পেয়েছে, তার বেশির ভাগই কাজে লাগিয়েছে। এখানেই বড় তফাত হয়ে গিয়েছে। ভাগ্যের খেলাও রয়েছে। ফুটবলমহলে মজা করে বলাবলি হচ্ছে যে ফ্রান্স করেছে দুই গোল আর ক্রোয়েশিয়া চার। প্রথমাধের্ ফ্রান্সের দুই গোলেই রয়েছে ভাগ্য। প্রথমে মানজুকিচের আত্মঘাতী গোল ও তারপরে বক্সের মধ্যে ইভান পেরিসিচের হ্যান্ডবল। যার সুবাদে পেনাল্টি পায় ফ্রান্স এবং গোল করেন গ্রিজম্যান। খানিকটা রসিকতার সুরে তাই ক্রোয়েশিয়ার গোলকে বলা হচ্ছে চার! মজা বাদ দিলে যা পড়ে থাকছে, তা হলো, ভাগ্যের বিজয়মালা এদিন ক্রোয়েশিয়ার জন্য ছিল না। সে জন্যই বিশ্বকাপ ফাইনালে নজিরবিহীনভাবে আত্মঘাতী গোলের শিকার হতে হয়েছে। বক্সের মধ্যে হ্যান্ডবলের ব্যাপারও তাই। পেরিসিচ ইচ্ছাকৃতভাবে বল হাত লাগাননি। রেফারি শুরুতে পেনাল্টিও দেননি। ফরাসি ফুটবলাররা হাত দেখিয়ে হ্যান্ডবল দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন রেফারিকে। খেলা থামিয়ে রেফারি তখন ‘ভিএআর’ পদ্ধতির সাহায্য নেন এবং এই প্রথমবার বিশ্বকাপ ফাইনালে প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে দেয়া হলো পেনাল্টি। ফুটবলমহলে অনেকেই এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। বলা হচ্ছে, পেরিসিচ বলে হাত দেননি। বল এসে হাতে লেগেছে। যা দুঘর্টনাবশত হয়েছে। জিততে গেলে যে ‘চান্স ফ্যাক্টর’ প্রয়োজন হয়, তা এদিন ছিল না ক্রোয়েশিয়ার। দ্বিতীয়াধের্ ফ্রান্সের দুই গোলের নেপথ্যে অবশ্য ভাগ্য ছিল না। ছিল পল পগবা, কিলিয়ান এমবাপের দুরন্ত স্কিলের ঝলক। তবে দায় এড়িয়ে যেতে পারে না ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণও। তৃতীয় গোলের ক্ষেত্রে ডানদিক থেকে এমবাপের ক্রস পান আতোয়ান গ্রিজম্যান। তিনি একেবারেই অরক্ষিত ছিলেন। গ্রিজম্যানের থেকে বল পান পগবা। মদ্রিচ তাকে দ্বিতীয় বার শট নেয়া থেকে আটকাতে পারেননি। পগবা শট নেয়ার আগে মদ্রিচ বুঝতেই পারেননি বল ঠিক কোথায়। এমবাপেও গোলের সময় অনেকটা ফাঁকা জায়গা পেয়েছিলেন। তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কেউ ছিলেন না। দুবর্ল রক্ষণের মাসুল দিতে হয়েছে ক্রোয়াটদের। ফরাসি রক্ষণ কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার ঘনঘন আক্রমণেও বড় ভুল করেনি। ফ্রান্স কোচ দিদিয়ের দেশম ট্যাকটিকাল সিদ্ধান্তও বড় ভূমিকা নিয়েছে ফাইনালে। মাঝমাঠে একবারেই প্রত্যাশিত ছন্দে ছিলেন না এন গোলো কান্তে। পেরিসিচ, মানজুকিচরা বারবার টপকে যাচ্ছিলেন তাকে। এটা লক্ষ্য করে দ্বিতীয়াধের্ তাড়াতাড়ি তাকে তুলে নেন দেশম। নামান স্টিভেন এন’জোঞ্জিকে। তার রক্ষণাত্মক গুণাবলির জন্য পগবা ও এমবাপে নিজেদের সৃষ্টিশীল ফুটবল মেলে ধরার সুযোগ পান। দু’জনের গোল আসে ৫৮ মিনিটে স্টিভেন নামার পরই। মদ্রিচ-রাকিতিচরা লড়েছেন, হার-না-মানা অদম্য মানসিকতা দেখিয়েছেন, কিন্তু বিপক্ষ গোলে খুব একটা শট মারতে পারেননি। তাদের নেয়া শটের মধ্যে আটটাই গিয়েছে বাইরে। গোল পোস্টে ছিল মোটে তিনটি শট। অথচ, বলের দখলে ক্রোয়েশিয়া (৬১ শতাংশ) এগিয়ে ফ্রান্সের (৩৯ শতাংশ) থেকে ঢের এগিয়ে ছিল। নিখুঁত পাসের ক্ষেত্রেও ফ্রান্সের (৭৫ শতাংশ) চেয়ে এগিয়ে ক্রোয়েশিয়া (৮৩ শতাংশ)। কিন্তু বল দখলে রাখাই তো শেষ কথা নয়। তা কাজে লাগানোই আসল। ফ্রান্স এখানেই বাজিমাত করে গেল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে