১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রæয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্ররা মিছিল বের করলে সে মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। সালাম, রফিক, বরকতদের রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। এ খবরে সারা দেশে ওঠা প্রতিবাদের ঝড়ে সামিল হন কবিরাও। একুশের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় প্রথম কবিতা রচিত হয় চট্টগ্রামে।
মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী সেদিনই লিখেছিলেন একশ’ ২০ লাইনের কবিতা ‘কঁাদতে আসিনি, ফঁাসির দাবি নিয়ে এসেছি’। কবি এই কবিতার প্রতিটি লাইনের ঘটিয়েছেন প্রতিবাদের বিস্ফোরণ। রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়া এ কবিতাটি বাঙালির রক্তের কণায় কণায় প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। গ্রন্থ আকারে কবিতাটি প্রকাশ হলে কাব্যিক প্রতিবাদের ভয়ে ভীত শঙ্কিত তৎকালীন সরকার সাথে সাথেই বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ‘কঁাদতে আসেনি ফঁাসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতায় রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার তলে ভাষার দাবিতে যঁাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে রাজপথ, কবি তঁাদের মৃত্যুতে কঁাদতে আসেন নি। কবি এসেছেন যারা বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় তাদের ফঁাসির দাবি নিয়ে। কবি দেখতে পেয়েছেন ভাষা শহীদদের প্রতিটি রক্তকণা রমনার ঘাসের বুকে আগুনের মতো জ্বলছে। এসব শহীদদের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল লিংকন, রকফেলার, আইনস্টাইনের প্রতিচ্ছবি।
‘যারা গুলি ভরতি রাইফেল নিয়ে
এসেছিলো ওখানে/যারা এসেছিলো নিদর্য়ভাবে হত্যা করার আদেশ নিয়ে/আমরা তাদের কাছে/ভাষার জন্য আবেদন জানাতেও আসিনি আজ/আমরা এসেছি খুনি জালিমের ফাঁসির দাবি নিয়ে।’
কবিতার এই দাবি সেদিন হয়ে উঠেছিল সমগ্র বাঙালি জাতির দাবি। কবিতার মাধ্যমেই আছড়ে পড়ল ক্ষোভ, দুমড়ে মুচড়ে দিতে চাইলো সকল অন্যায় অবিচার। সময়, চিত্রকল্প, ভাষাশৈলীর বিচারে কেউ কেউ এই কবিতাকে বলেছেন একুশের সেরা প্রতিবাদী কবিতা।
শুধু মাহবুবুল আলম চৌধুরীই নন, বাংলা সাহিত্যে এমন কবি খুব কমই আছেন যারা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কবিতা লিখেন নি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রæয়ারির দিন থেকেই শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কবিতা লেখা। বায়ান্নের পঁচিশের ফেব্রæয়ারিতে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বরেণ্য সাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে বসে একুশে ফেব্রæয়ারি ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় লিখিছিলেন ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ কবিতাটি। ভাষা শহীদদের স্মৃতি, আত্মত্যাগের ইতিহাস তাদের মহাত্মকে বাড়ায়নি শুধু, সাথে সাথে বাড়িয়েছে সমগ্র বাঙালি জাতি সত্তার মযার্দা।
কবি মনে করেন, জালিমরা মানুষ নিমির্ত শহীদ মিনার ভাঙলে ভাঙুক, তাতে কি। শহীদরা মিশে আছে প্রতিটি বাঙালির রক্তের কণায় কণায়। এই রক্তে নিমির্ত শহীদ মিনার কে ভাঙবে? কবির পঙ্তিমালায়- ‘ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক/একটি মিনার গড়েছি আমরা চার কোটি কারিগর/বেহালার সুরে রাঙা হৃদয়ের বণের্লখায়। পলাশের আর/ রামধনুকের গভীর চোখের তারায় তারায়/দ্বীপ হয়ে ভাসে যাদের জীবন/ যুগে যুগে সেই শহীদের নাম/ এঁকেছি প্রেমের ফেনিল শিখায়, তোমাদের নামে তাই আমাদের/হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূযের্র মতো জ্বলে শুধু এক শপথের ভাস্কর।