শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাট শিল্পে অশনি সংকেত

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সংকট এই শিল্পের জন্য বড় সমস্যা প্রযুক্তি ও দক্ষতার দিক থেকে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ কারখানাগুলো চলছে ষাটের দশকের মেশিন দিয়ে বিশ্ব বাজার দখল করতে মরিয়া চেষ্টা ভারতের
ইমদাদ হোসাইন
  ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে ধস নেমেছে। সাম্প্রতিক সময় এই খাতে বাংলাদেশ অবনমনের দিকেই হঁাটছে। আগের বছরের তুলনায় এ বছর পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে ২৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত দিক থেকে পিছিয়ে থাকায় আন্তজাির্তক বাজারে পাটশিল্প টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়ছে। আর এই সুযোগটি কাজে লাগাতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে অন্যতম প্রতিদ্ব›দ্বী দেশ ভারত। যা পাটশিল্পের জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করছেন তারা।

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সবের্শষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৮-১৯ অথর্বছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) বাংলাদেশ পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে আয় করেছে ৪৯৮ দশমিক ৬৬ মিলিয়ন ডলার। অথচ আগের অথর্বছরের (২০১৭-১৮) একই সময় এই খাতের রপ্তানি আয় ছিল ৬৬১ দশমিক ৬৬ মিলিয়ন ডলার। অথার্ৎ আগের বছরের তুলনায় বাংলাদেশ পাট রপ্তানিতে ২৪ দশমিক ৬৬ পিছিয়ে পড়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুট গুড এক্সপোটাসর্ অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেজিইএ) সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মো. লুৎফুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, বাংলাদেশ অনিবাযর্ভাবে পাট রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়ছে। এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। একটি হলো- পাট পণ্য উৎপাদনে শ্রমিক ও মেধার অদক্ষতা। আরেকটি হলো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি। যেমন- ইরান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর একটি। সে দেশে ট্রাম্পের অবরোধের ঘোষণার পর বাংলাদেশের পাট রপ্তানি অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আফ্রিকার বাজার ভারত ইতোমধ্যে দখল নিয়েছে। বাংলাদেশেও তারা ঢুকে পড়ছে। দেশটি প্রযুক্তিগত দিক থেকে ইতোমধ্যে অনেক এগিয়েছে। বাংলাদেশের দেশের তুলনায় অনেক কমে পণ্য বিক্রির সুযোগ পাচ্ছে। প্রতিযোগিতার বাজারে পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাবে ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে ভিন্ন বাজার খুঁজছেন।

পণ্য উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তি এনে উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনতে পারলে এই খাতের পণ্য রপ্তানিতে অনিবাযর্ পতন থেকে উত্তরণ সম্ভব উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত এই খাতে একটি তহবিল দেয়া, যাতে উদ্যোক্তারা আধুনিক কারখানার মাধ্যমে কম খরচে পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানির সুযোগ পায়। দেশের অধিকাংশ মেশিনই সেই ষাটের দশকের। কোনো আধুনিকায়ন নেই। অবশ্য, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে কিছু বড় প্রতিষ্ঠান এখন আধুনিক মেশিন এনে উৎপাদনে নেমেছে। মেশিন আমদানির সক্ষমতা ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর একেবারে নেই বললেই চলে।

পাটজাত পণ্য-সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে পাট নিয়ে বিদ্যমান আইনের কোনো ব্যবহারই হয় না। দেশে পাট পণ্য ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে যে আইন হয়েছে, কোনো কোম্পানিই তা মানছে না। প্যাকেটজাত প্রক্রিয়ার জন্য প্লাস্টিকের ওপরই নিভর্রশীল তারা। পাটজাত পণ্যের ব্যবহার প্রসারে সরকারি কোনো তদারকিও নেই।

সরকারের দৃষ্টি আকষর্ণ করে রপ্তানিকারকরা দাবি করেন, অভ্যন্তরীণ বাজারে ৮০ শতাংশ বিক্রির সুযোগ রেখে ২০ শতাংশ রপ্তানির সুযোগ দেয়া উচিত। দেশের ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে তো উল্টোটা। দেশের বাজারে ৮০ শতাংশ বিক্রির সুযোগ দিলে রপ্তানিকারকরা আর বিদেশি ক্রেতাদের দিকে চেয়ে থাকতে হয় না। বাংলাদেশে এখন পাট চাষে ৪০ লাখ কৃষক সম্পৃক্ত আছেন। আর পাট কারখানায় সম্পৃক্ত আছেন এক লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক।

বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) চেয়ারম্যান এসকে সৈয়দ আলী জানান, বাংলাদেশ বিশ্ব বাজারের বড় বড় জায়গাগুলো থেকে ক্রমাগতভাবে বাজার হারাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সংকট ও এই শিল্পের প্রতিযোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ্িবশ্ব বাজারে টিকে থাকা বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

তিনি আরও জানান, বতর্মানে পাট পণ্য রপ্তানিতে ক্রমাগত ধসের কারণে চাষি হতে শুরু করে শ্রমিক রপ্তানিকারক সবাই সংকটের মধ্যে পড়ছেন। ফলে বেশিরভাগ পাট কারখানা এখন উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশের কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা এসে দঁাড়িয়েছে ৬৬ শতাংশে। উৎপাদন কম হলে খরচ বাড়বে। ফলে সারা বিশ্বের শিল্পখাতে এই প্রভাব অনিবাযর্ভাবে পড়বে।

সৈয়দ আলী প্রযুক্তির গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, ‘এই শিল্পে উৎপাদনের বৈচিত্র্যতা আনতে হলে নতুন নতুন প্রযুক্তিকে কারখানায় সংযুক্ত করতে হবে। বিশ্বের বাজারে পাটের চাহিদা অনেক। কিন্তু উৎপাদনে পণ্যের বৈচিত্র্য আনতে পারায় বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে পিছিয়েই যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষতা বাড়িয়ে পাটপণ্যের আন্তজাির্তক বাজারে আরও ভালো অবস্থান তৈরির সুযোগ রয়েছে। রিসাচর্ অ্যান্ড মাকের্টসের এক গবেষণায় বলা হয়ছে, ২০২২ সাল নাগাদ শুধু পাটের ব্যাগের বৈশ্বিক বাজার দঁাড়াবে ২৬০ কোটি ডলারের। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিকের ব্যাগ নিষিদ্ধের কারণে এই বাজার তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ, ভারত, চীনসহ পাটপণ্য উৎপাদনকারী দেশগুলোর সামনে এই বাজারে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশে উৎপাদিত পাটজাত সুতার সবচেয়ে বড় বাজার তুরস্ক। এরপরই রয়েছে চীন, ভারত, মিসর, ইরান, বেলজিয়াম, রাশিয়া, পাকিস্তান ও মেক্সিকো। পাটের অন্যান্য পণ্য সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় সুদান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, কেনিয়া, বেলজিয়াম ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে।

পাটপণ্যের বহুমুখীকরণ ও কমর্সংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি)। এরই মধ্যে ২৩৫ ধরনের দৃষ্টিনন্দন বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনও হচ্ছে। এ ছাড়া পাট থেকে পলিথিনের বিকল্প ‘সোনালি ব্যাগ’, ভিসকস, কম্পোজিট জুট টেক্সটাইল ও গামের্ন্ট, চারকোল, পাট পাতার পানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে পাটশিল্পের নতুন দিগন্ত উন্মোচনে কাজ করছে। ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০’-এর আওতায় ১৭টি পণ্য অন্তভুর্ক্ত করা হয়েছে। এই আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজারে পাটের বস্তার চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে বছরে প্রায় ১০০ কোটি পিস। পাটপণ্যকে উৎসাহিত করতে ৬ মাচর্ জাতীয় পাট দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।

ইপিবির প্রতিবেদনের পযাের্লাচনায় দেখা যায়, চলতি অথর্বছরের প্রথম সাত মাসে পাটের কঁাচামাল রপ্তানি হয়েছে ৭৮ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ডলার। আগের বছর একই সময় এই খাতে রপ্তানি হয়েছিল ৯৫ দশমিক ৫১ মিলিয়ন ডলার। এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। পাটের সুতা ও কুÐলি রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৩০৩ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন ডলার। আগের বছর একই সময় যা হয়েছিল ৪১৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের। অথার্ৎ এক বছরের ব্যবধানে এ জাতীয় পণ্যের রপ্তানি আয় কমেছে ২৬ দশমিক ৭২ ডলার। বস্তা ও ব্যাগ রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৫৫ দশমিক ৩০ মিলিয়ন ডলার। আগের অথর্বছরে এই খাতে আয় ছিল ৯২ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ডলার। বছরের ব্যবধানে এই আয় কমেছে ৪০ দশমিক ২৭ শতাংশ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<36929 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1