শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

থেমে গেল ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরের মূর্ছনা

আজ সকাল ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সবর্স্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন ও রাষ্ট্রীয় সম্মান
যাযাদি রিপোটর্
  ২৩ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
আপডেট  : ২৩ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০৮
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল হ জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৫৬, মৃত্যু ২২ জানুয়ারি ২০১৯

সুরের মায়া কাটিয়ে চিরবিদায় নিলেন বরেণ্য সুরকার, গীতিকার, সংগীত পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। দীঘর্ চার দশকের ক্যারিয়ারে দুইশর বেশি চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করে গেছেন তিনি। ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সুন্দর সুবণর্ তারুণ্য লাবণ্য’র মত দেশাত্মবোধক গানে তার দেয়া সুর বাংলাদেশের মানুষের বুকে চিরদিন বাজবে। মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর আফতাবনগরের বাসায় হাটর্ অ্যাটাক হলে বুলবুলকে মহাখালীর আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। একুশে পদক পাওয়া এই গানের মানুষটির বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। দীঘির্দন ধরে তিনি হৃদযন্ত্রের জটিলতায় ভুগছিলেন। হাটের্ বøক ধরা পড়ায় গত বছর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে তার অস্ত্রোপচারও করা হয়েছিল। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। হাসপাতালের চিকিৎসকরা শেষ কথা জানিয়ে দেয়ার পর মঙ্গলবার সকালে পরিবারের সদস্যরা বুলবুলের মরদেহ নিয়ে যান আফতাবনগরের বাসায়। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এই গীতিকার-সুরকারের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ জানান, বুলবুলের মরদেহ মঙ্গলবার বারডেমের হিমঘরে রাখা হবে। বুধবার বেলা ১১টায় তার কফিন নিয়ে যাওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে সবর্স্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের আগে এই মুক্তিযোদ্ধার প্রতি জানানো হবে রাষ্ট্রীয় সম্মান। বুলবুলের ছেলে সমীর আহমেদ জানান, বুধবার জোহরের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে তার বাবার জানাজা হবে। আসরের পর মিরপুরে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে। মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নেয়া আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন মাত্র ১৫ বছর বয়সে। তখন তিনি ঢাকার আজিমপুরের ওয়েস্টটেন্ট হাইস্কুলের ছাত্র। আন্তজাির্তক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসালমীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে সেই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল। ২৫ মাচর্ রাতের গণহত্যা দেখার পর প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেন বুলবুল ও তার কয়েকজন বন্ধু। প্রথমে বিহারিদের বাসা থেকে অস্ত্র ছিনতাই করে ছোট একটি মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করেন তারা। পরে জিঞ্জিরায় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘঁাটি তৈরি করেন। সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে ঢাকায় ফিরে আসেন বুলবুল। জানতে পারেন বড় ভাই ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ টুলটুল মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা দল ক্র্যাক প্লাটুনে যোগ দিয়েছেন। পরে বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া গ্রেনেড নিয়ে জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে নিউমাকেের্টর ১ নম্বর গেটে পাকিস্তানি বাহিনীর লরিতে আক্রমণ করেন বুলবুল ও তার বন্ধু সরোয়ার। আগস্টে ভারতের মেলাঘরে গিয়ে এক দফা প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে ঢাকার লালবাগ এলাকায় কাজ শুরু করেন বুলবুল ও তার বন্ধু সজীব। তাদের প্লাটুনকে বলা হতো ওয়াই (ইয়াং) প্লাটুন। অক্টোবরে রোজার মাসে আবার ভারতে যাওয়ার সময় কুমিল্লা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাঝামাঝি তন্তর চেকপোস্টে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে বন্দী হন বুলবুলরা চারজন। নিমর্ম নিযার্তনের পর তাদের উলঙ্গ অবস্থায় বাসে করে নিয়ে যাওয়া হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে। সেই জেলখানায় অন্তত ৫৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বন্দি রেখেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। রোজার ঈদের দিন সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশ কমর্কতার্ ছিরু ও তার ছেলেসহ ৩৯ জনকে আলাদা করে জেল থেকে বের করে এনে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। তাদের মধ্যে একজন প্রাণে বেঁচে যান। দুই দিন পর বুলবুলদের চার বন্ধুকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শান্তি কমিটির অফিস দানা মিয়ার বাড়িতে নিয়ে নিযার্তন চালানো হয়। সেই রাতেই সেখান থেকে পালিয়ে যান বুলবুলরা। ২০১২ সালের আগস্টে বুলবুল ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়ার পরের বছর খুন হন তার ছোট ভাই আহমেদ মিরাজ। ২০১৩ সালের ৯ মাচর্ রাতে কুড়িল ফ্লাইওভারের পাশ থেকে পুলিশ মিরাজের লাশ উদ্ধার করে। সেই ঘটনার বিচার না পাওয়ায় হতাশা ছিল বুলবুলের মনে। ২০১৮ সালের মে মাসে এক সাক্ষাৎকারে তিনি গিøটজকে বলেছিলেন সে কথা। গানের ভুবনে চার দশক ১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বিজলি বাদল’ সিনেমায় সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন বুলবুল। এরপর আমৃত্যু তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন সংগীতের সাধনায়। বেলাল আহমেদের পরিচালনায় ১৯৮৪ সালে নয়নের আলো চলচ্চিত্রের সংগীতায়োজন করেন বুলবুল। ওই সিনেমার জন্য তার লেখা ‘আমার সারাদেহ খেয়োগো মাটি’, ‘আমার বাবার মুখে’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমি তোমার দুটি চোখের দুটি তারা হয়ে’ গানগুলো সে সময় তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এর পরের চল্লিশ বছরে মরণের পরে, আম্মাজান, প্রেমের তাজমহল, অন্ধ প্রেম, রাঙ্গা বউ, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, পড়েনা চোখের পলক, তোমাকে চাই, লাভ স্টোরি, ভুলোনা আমায়, আজ গায়ে হলুদ, লাভ ইন থাইল্যান্ড, আন্দোলন, মন মানে না, জীবন ধারা, সাথি তুমি কার, হুলিয়া, অবুঝ দুটি মন, ল²ীর সংসার, মাতৃভূমি, মাটির ঠিকানাসহ দুই শতাধিক চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেন বুলবুল। প্রেমের তাজমহল সিনেমার জন্য তিনি ২০০১ সালে এবং হাজার বছর ধরে সিনেমার জন্য ২০০৫ সালে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। দেশের সংগীত অঙ্গনে অবদানের জন্য ২০১০ সালে সরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে একুশে পদকে ভূষিত করে। চলচ্চিত্রের জন্য সংগীত আয়োজনের পাশাপাশি দেশের সমকালীন শিল্পীদের নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করেছেন বুলবুল। তার কথা আর সুরের গান নিয়ে সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আবদুল হাদি, এ্রন্ড্র কিশোর, সামিনা চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, আগুন, কনক চঁাপাসহ দেশের বহু জনপ্রিয় শিল্পীর অ্যালবাম বের হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে