শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যানজট আর গণপরিবহন সংকটে দিনভর ভোগান্তি

যাযাদি রিপোটর্
  ২০ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

আওয়ামী লীগের বিজয় সমাবেশ উপলক্ষে ঢাকা মহানগর পুলিশ বেশকিছু সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় সোহরাওয়াদীর্ উদ্যান কেন্দ্রিক প্রতিটি সড়কের তীব্র যানজটে শনিবার সকাল থেকে দিনভর নগরীবাসীকে দুবির্ষহ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। অন্যদিকে এর প্রভাবে নগরীর বিভিন্ন অংশে তীব্র গণপরিবহন সংকট দেখা দেয়ায় তা মরার উপর খঁাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। শনিবার সরকারি সাপ্তাহিক ছুটির দিন হলেও বেসরকারি বিভিন্ন অফিস, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানা খোলা থাকায় পেশাজীবী লাখ লাখ মানুষকে কমর্স্থলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পথে নামতে হয়- এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে নগরীর কেন্দ্রস্থলে সমাবেশের মতো বৃহৎ কোনো রাজনৈতিক কমর্সূচি ভবিষ্যতে আর যাতে না দেয়া হয় ভুক্তভোগীরা সে অনুরোধ জানিয়েছেন। অনেকে আবার এ নিয়ে প্রকাশ্যে তীব্র ক্ষোভও ঝেরেছেন। যানজটের ভোগান্তির শিকার নগরবাসীর অভিযোগ, ঢাকা মহানগর পুলিশ অপরিকল্পিতভাবে সোহরাওয়াদীর্ উদ্যান কেন্দ্রিক বিপুল সংখ্যক রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ায় এ দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে ট্রাফিক পুলিশ এজন্য বিজয় সমাবেশে যোগ দিতে আসা আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকমীর্র বিশৃঙ্খলাকে দায়ী করেছেন। তাদের ভাষ্য, সকাল থেকে দুপুর অবধি আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকমীর্ বাস-মিনিবাস, প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহন নিয়ে সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানের সমাবেশে যোগ দিয়েছে। তাদের বহনকারী যানবাহন রাখার জায়গা আগেই নিধার্রণ করে দেয়া থাকলেও অনেকেই সে নিয়ম ভেঙেছে। তারা বিভিন্ন যানবাহন এলোমেলোভাবে বিভিন্ন সড়কে দীঘর্ সময় পাকর্ করে রেখেছে। এতে কোথাও কোথাও অহেতুক যানজট সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ ধরনের বিশাল রাজনৈতিক কমর্সূচিতে যান চলাচলে বিঘœ ঘটবে- এটাই স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেন ষ ছবি পৃষ্ঠা-১৬ ট্রাফিক পুলিশের একাধিক ঊধ্বর্তন কমর্কতার্। ট্রাফিক পুলিশের মাঠ কমর্কতার্রা জানান, সকাল থেকে দুপুর অবধি ফামের্গট থেকে শাহবাগমুখী সড়কে সবচেয়ে বেশি যানজট হয়েছে। সেখানে আধা কিলোমিটার পথ পেরুতে যে কোনো যানবাহনের ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট সময় লেগেছে। রাজারবাগ থেকে ফ্লাইওভারে ওঠা কোনো গাড়িই এক ঘণ্টার আগে বাংলামোটর মোড় সিগন্যাল পার হতে পারেনি। বিশেষ করে দুপুরের পর এসব সড়কে যানবাহনের সারি পুরোপুরি থমকে ছিল বলে জানান ট্রাফিকের মাঠ কমর্কতার্রা। এদিকে সকাল ১১টার পর থেকেই মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে চলাচলের গতি কমতে শুরু করে এক পযাের্য় তা শম্বুক গতিতে রূপ নেয়। চানখারপুল বকশিবাজার মোড়সহ আশপাশের সব রাস্তাতেই সকাল থেকেই সৃষ্টি হয় যানজট। এ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের ওইসব সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহনে বসে থাকতে হয়েছে। বেগতিক পরিস্থিতিতে কেউ কেউ মুমূষুর্ ও অক্ষম রোগীকে ঘাড়ে চড়িয়ে কিংবা কোলে নিয়ে হাসপাতালে পেঁৗছেছে। জাহিদ মালিক নামের একজন বেসরকারি চাকুরে জানান, মোহাম্মদপুরের কমর্স্থলে যাওয়ার জন্য তিনি সকাল ১০টায় যাত্রাবাড়ী থেকে বাসে চড়েন। সাপ্তাহিক এ ছুটির দিনে সাধারণত তিনি ৪০-৪৫ মিনিটে কমর্স্থলে পেঁৗছান। অথচ তীব্র যানজট ও বিভিন্ন সড়ক ডাইভারশনের কারণে তার অফিসে পেঁৗছতে সময় লেগেছে প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টা। যানজট ও পরিবহন সংকটের কারণে তার মতো অফিসের অন্য কমর্কতার্-কমর্চারীরাও দেড় দু’ঘণ্টা পর অফিসে পৌঁছেছে বলে জানান জাহিদ। দুপুরের দিকে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সড়কজুড়ে তীব্র যানজটের কারণে অধিকাংশ সড়কে চালকরা গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে বসে আছেন। এর মধ্যেই দলীয় নেতাকমীর্রা মিছিলসহ সমাবেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পান্থপথ সিগন্যালে আটকে থাকা দোলনচাঁপা বাসের চালক বাস থেকে নেমে ফুটপাতে বসে আছেন। বাসেও কোনো যাত্রী নেই। জানতে চাইলে চালক সালমান বলেন, ‘সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানে আওয়ামী লীগের সমাবেশ। সে কারণে সব রাস্তায় তীব্র যানজট। এক ঘণ্টার উপরে এখানে বসে আছি। সিগন্যাল ছাড়ছে না। যাত্রীরাও সবাই নেমে গেছে।’ মোহাম্মদপুর-গুলিস্তান রুটের একটি বাসের এক হেলপার জানান, প্রধানমন্ত্রী সমাবেশে যাওয়ার জন্য বেলা আড়াইটা থেকে প্রায় ৪০ মিনিট রাস্তা আটকে রাখায় খামারবাড়ি সিগন্যালে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়। এ সময় অনেক যাত্রী গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে রওনা দেন। এ অবস্থায় তাদের খালি গাড়ি নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটতে হয়েছে। যে কোনো ছুটির দিনে এ রুটে ৪ থেকে ৫ ট্রিপ দেয়া গেলেও বিজয় সমাবেশের যানজটের কারণে তারা মাত্র ২ ট্রিপ যাত্রী পরিবহন করতে পেরেছে। এদিকে নগরীর দক্ষিণ অংশে তীব্র যানজট থাকলেও উত্তরা, কুড়িল বিশ্বরোড, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, রামপুরাসহ আরও বিপুল সংখ্যক সড়ক ছিল অনেকটাই ফঁাকা। সকালের পিক-আওয়ারে এ সব রাস্তায় স্বল্প সংখ্যক যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। যা দুপুরের পর আরও অনেক কমেছে। ফলে বিকালের পিক-আওয়ারে কমর্স্থল থেকে ঘরে ফেরা মানুষকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। গণপরিবহনের সংকটের কারণে নগরীর অফিসপাড়ার প্রতিটি স্টপেজে শত শত মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দঁাড়িয়ে থেকেছে। দীঘর্ সময় পর পর এসব স্টপেজে গাড়ি আসার পর অপেক্ষমাণ যাত্রীরা রীতিমতো মল্লযুদ্ধে নেমেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে নারী যাত্রীরা পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাড়িতে চড়তে না পেরে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। উপায়ন্তর না পেয়ে অনেকে উচ্চ ভাড়া দিয়ে সিএনজি অটোরিকশা কিংবা উবার-পাঠাওয়ের মতো রাইড শেয়ারিং চড়ে ঘরে ফিরেছে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড, বাড্ডা ও রামপুরার বিভিন্ন স্টপেজ ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি বাসই যাত্রীতে কানায় কানায় ভরা। এরপরও এসব বাস প্রতিটি স্টপেজে থেমেছে। সেখানে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে বাসে উঠে আসনবিহীন যাত্রায় শামিল হচ্ছে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মতিঝিলগামী একটি বাস মধ্যবাড্ডা স্টপেজে এসে থামলেই হুড়মুড় করে যাত্রীরা উঠতে থাকেন। বাসের ভেতরে দঁাড়ানোরও বিন্দুমাত্র জায়গা নেই, তবুও ঝুলে হলেও যেতে চাইছেন সবাই। এ সময় রিয়াজ উদ্দিন নামের একজন অসুস্থ ব্যক্তি বাসে উঠতে না পেরে আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বিজয় সমাবেশ উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা উচিত ছিল। তাহলে সাধারণ মানুষকে এ ভোগান্তিতে পড়তে হতো না।’ রিয়াজ উদ্দিন জানান, সকাল সাড়ে ১০টা থেকে তিনি একই বাসস্টপেজে দঁাড়িয়ে আছেন। কিন্তু প্রতিটি বাসই যাত্রীতে ঠাসা থাকায় তিনি কোনো বাসে উঠতে পারছেন না। অথচ জরুরি চিকিৎসার জন্য তাকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেলা ১টার আগেই পেঁৗছাতে হবে। একই ধরনের ভোগান্তির শিকার কয়েকজন নারীও অনেকটা একই সুরে তাদের আক্ষেপের কথা জানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে সত্তরোধ্বর্ বাবার চিকিৎসা নিতে আসা শওকত উল্ল্যাহ জানান, বেলা দেড়টার দিকে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে মগবাজার পযর্ন্ত হেঁটে আসতে হয়েছে। এ পথে তারা কোনো রিকশারও দেখা পাননি। তবে টঙ্গী ডাইভারশন রোডে প্রায় আধা ঘণ্টা দঁাড়িয়ে থেকেও তারা গণপরিবহনের কোনো বাস না পাওয়ায় চারগুণ ভাড়া দিয়ে ‘উবার’এর ট্যাক্সিক্যাবে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। এ ধরনের আয়োজন করার আগে রাজনীতিবিদ ও ট্রাফিক পুলিশের অন্তত অসুস্থ রোগীদের কথা চিন্তা করা উচিত বলে ক্ষুব্ধ মন্তব্য করেন তিনি। যাত্রাবাড়ী-মিরপুর রোডের ১৫ নম্বর বাসের লাইনম্যান ইকবাল জানান, ‘সকাল ১০টার মধ্যে প্রতিদিন ৪০টির মতো বাস যাত্রাবাড়ী থেকে ছেড়ে যায়। কিন্তু আজ বাস এসেছে মাত্র নয়টি।’ কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, বাসগুলো মিরপুরে কণ্ট্রাক্টে গেছে। বিজয় সমাবেশে লোকজন আনা-নেয়ার জন্য সব বাসই আগে থেকে রিজাভর্ রাখা হয়েছে। আর এতেই এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। প্রসঙ্গত, ৩০ ডিসেম্বর তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের রেকডর্ করলেও বিজয় মিছিল না করার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। তবে দলীয় নেতাকমীর্ ও সমথর্করা যাতে বিজয় আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হন তাই ১৯ জানুয়ারি সোহরাওয়াদীর্ উদ্যানের বিজয় সমাবেশে করার ঘোষণা দেয় দলটি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে