মারিও মানজুকিচের কঁাধে চেপে বসলেন ইভান পেরেসিচ। এরপর উচ্ছ¡াসে দুই নায়কের উপর ঝঁাপিয়ে পড়লেন মদ্রিচ-রাকিতিচ-রেবিচরা, ঝঁাপিয়ে পড়ল পুরো দলই। মুহ‚তর্টা ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল ইতিহাসেই হয়তো অক্ষয় হয়ে থাকবে। থাকারই কথা। ইতিহাস গড়ে বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠার মুহ‚তর্, সেই ছবিটা কি আর মুছে যাওয়ার মতো? মাত্র ৪৩ লাখ মানুষের দেশ ক্রোয়েশিয়া। আয়তনে যে দেশটি (৫৬ হাজার ৫৯৪ বগির্কলোমিটার) বাংলাদেশের তিন ভাগের এক ভাগ, ১১ জন ফুটবল যোদ্ধার হাত ধরে ইউরোপের সেই ‘পুচকে’ দেশটিই এখন বিশ্বকাপের ফাইনালে! ভাবা যায়?
রাশিয়া বিশ্বকাপ শুরুর আগে যদি কেউ বলতেন- ক্রোয়েশিয়া ফাইনালে খেলবে; ওই ব্যক্তির মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়েই প্রশ্ন জাগত। অথচ এটাই এখন বাস্তব। আজন্মের আক্ষেপ ঘুচিয়ে ইউরোপের ‘ছোট্ট’ দেশটি বুধবার ‘বড়’ ইংল্যান্ডকে হারিয়ে উঠে গেছে ফাইনালে; অনেকের চোখেই যেটা অঘটন! আসলে অঘটন এই বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্নযাত্রার পুরোটাই। বলা যায়, অঘটন ঘটাতে ঘটাতেই ফাইনালে পেঁৗছে গেছে মদ্রিচ-রাকিচিতদের সোনালি প্রজন্ম। তারা হয়ে উঠেছে রাশিয়া বিশ্বকাপের বিস্ময়।
কেউ ভাবেনি আজেির্ন্টনার মতো দল থাকা সত্তে¡ও ‘ডি’ গ্রæপের চ্যাম্পিয়ন হবে ক্রোয়েশিয়া। লিওনেল মেসির দলকে ৩-০ গোলে বিধ্বস্ত করেই অভাবনীয় কাজটা করেছে ক্রোয়েশিয়া। অঘটনের শুরু ওখানেই। এরপর এক একটি বাধা ক্রোয়েশিয়া পেরিয়েছে খাদের কিনার থেকে ঘুরে দঁাড়িয়ে। শেষ ষোলো, কোয়াটার্র ফাইনাল আর সেমিফাইনাল; প্রতিটি ম্যাচেই ক্রোয়েশিয়া পিছিয়ে ছিল। প্রতিবারই প্রত্যাবতের্নর এক একটি উপাখ্যান লিখেছে জালাতকো দালিচের শিষ্যরা।
গ্রæপপবের্ যে তিনটি দল শতভাগ জয়ের রেকডর্ নিয়ে শেষ ষোলোয় উন্নীত হয়েছিল, ক্রোয়েশিয়া তাদের একটি। যে দলটির কাছে আজেির্ন্টনার মতো দুইবারের চ্যাম্পিয়ন পাত্তা পায়নি, তাদের কাছে আফ্রিকান সুপার ঈগল নাইজেরিয়া আর ‘পুচকে’ আইসল্যান্ডের পরাজয় তো নিয়তিরই লেখা! গ্রæপপবের্র ওমন দাপুটে ক্রোয়েশিয়া হয়ে উঠেছিল এই বিশ্বকাপের ‘কালো ঘোড়া’! গ্রæপসেরা হয়েছিল বলেই তারা পড়েছিল অপেক্ষাকৃত সহজ অধের্। আসলে ভাগ্যদেবীই এই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে তাদের।
ভাগ্যদেবী ক্রোয়েশিয়ার প্রতি সদয় ছিলেন বলেই না স্বাগতিক রাশিয়ার কাছে শেষ ষোলোর ম্যাচে হেরে যায় মহাশক্তিধর স্পেন। ম্যাচের মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মাথায় গোল করে এগিয়ে যাওয়ার পরও গোটা ম্যাচে আর হালে পানি পায় না ডেনমাকর্। ড্যানিশদের বিপক্ষে শেষ ষোলোর ওই ম্যাচে ক্রোয়েশিয়াও অবশ্য নিজেদের সেরাটা দেখাতে পারেনি। মানজুকিচের পায়ে চতুথর্ মিনিটে গোল শোধ করে দিলেও পরের ১১৬ মিনিট বলার মতো কিছু করতে পারেনি দালিচের শিষ্যরা।
ক্রোয়েশিয়ার গোলদ্বারে ড্যানিয়েল সুবাসিচ নামের একজন অতন্দ্রপ্রহরী টাইব্রেকারে গড়েছিলেন ব্যবধান। অবশ্য যোগ হওয়া ৩০ মিনিটের শেষ ভাগে পাওয়া পেনাল্টি থেকে মদ্রিচ গোল করতে পারলে খেলাটা শেষ হতো আগেই। তাতে অবশ্য টাইব্রেকারের নাটকটা দেখা হতো না ফুটবলপ্রেমীদের। রাশিয়ার বিপক্ষে কোয়াটার্র ফাইনালটা তো হলো আরও নাকটীয়। বরাবরের মতো এই ম্যাচেও শুরুতে পিছিয়ে পড়ে ক্রোয়েশিয়া। ডেনিশ চেরিশেভের চোখ ধঁাধানো গোল মদ্রিচদের ভীত কঁাপিয়ে দিয়েছিল।
এরপর ক্রোয়েশিয়ার সমতায় ফেরা, অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের খেলায় এগিয়ে যাওয়া; কিন্তু স্বাগতিক রাশিয়া শেষের আগে হার মানেনি। শেষ মুহ‚তের্ সমতা টেনে ম্যাচটাকে টাইব্রেকারে নিয়ে যায় তারা। তবে এবার আর স্পেনের মতো ক্রোয়েশিয়াকে বধ করতে পারেনি রুশরা। পারবে কি করে, ভাগ্যদেবী যে কৃপার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন ক্রোয়েশিয়ার দিকে! আবারও নায়ক গোলরক্ষক সুবাসিচ। প্রত্যাবতের্নর আরেকটি উপাখ্যান লেখা ক্রোয়েশিয়ার, ২০ বছরের অপেক্ষা ঘুচিয়ে সেমিফাইনালে নাম লেখানো।
১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপে নিজেদের অভিষেকেই ফুটবলবিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। ডেভর সুকারদের হাত ধরে উঠেছিল সেমিফাইনালে। বুধবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আবারও প্রত্যাবতর্ন-কাব্য লিখে মদ্রিচ-রাকিতিচ-পেরেসিচদের সোনালি প্রজন্ম সেই সাফল্যকেও ছাড়িয়ে গেছে। প্রথমবার বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছে ‘পুচকে’ ক্রোয়েশিয়া। এখন তাদের চোখে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। নাইজেরিয়াকে হারিয়ে যে স্বপ্নযাত্রা শুরু করেছিল দলটি, রোববারের ফাইনালে ফ্রান্সকে হারিয়েই সেই যাত্রার ইতি টানতে চায় তারা।
মদ্রিচ-রাকিতিচরা গড়তে চান আরও বড় ইতিহাস, জিততে চান বিশ্বকাপ। উঁচিয়ে ধরতে চান সোনালি ট্রফিটা। তাদের এই চাওয়া পুতিের্তও ভাগ্যদেবীর কৃপাদৃষ্টি লাগবে, ক্রোয়েশিয়াকে ফাইনালে তোলার নায়ক মানজুকিচ যেমন বলেছেন, ‘আমরা ইতিহাস গড়েছি। এখনও একটি ম্যাচ বাকি। ঈশ্বর চাইলে আমরা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হব।’ একই কথা দলীয় কোচ দালিচের কণ্ঠেও, ‘যদি সৃষ্টিকতার্ চান, আমরা চ্যাম্পিয়ন হব।’
দালিচ জানিয়ে রাখলেন- অঘটন ঘটাতে ঘটাতে নয়, নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই ফাইনালে উঠেছে ক্রোয়েশিয়া। ‘ফ্রান্সের জন্যও প্রস্তুত ক্রোয়েশিয়া’- শেষ কথাটায় ফাইনালের প্রতিপক্ষকে প্রচ্ছন্ন একটা হুমকিও তো দিয়ে রাখলেন দালিচ।