আজকের যায়যায়দিন

একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনে আওয়ামী লীগের কেন নিরঙ্কুশ জয় হয়েছে এবং বিএনপির কেন পরাজয় ঘটেছে, সে বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। শনিবার দুপুরে সজীব ওয়াজেদ জয় তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাসের মাধ্যমে নিবার্চনের ফল নিয়ে ব্যাখ্যা দেন। ফেসবুক স্ট্যাটাসে জয় লিখেছেন, ‘সাম্প্রতিক নিবার্চনে ব্যালটের মাধ্যমে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টকে বাংলাদেশের মানুষ পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই তারা এখন তাদের বিদেশি প্রভুদের কাছে নালিশ করছে ও সাহায্য চাইছে। আন্তজাির্তক অঙ্গনে যোগাযোগ ও লবিংয়ের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করতে চাইছে যে নিবার্চনে কারচুপি হয়েছে, যা পরিসংখ্যান মোতাবেক একেবারেই অসম্ভব।’ সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বিএনপি থেকে প্রায় ৪ কোটি ৯০ লাখ ভোট বেশি পেয়েছে। এতবড় ব্যবধানের জয় কখনোই কারচুপির মাধ্যমে করা সম্ভব না। বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট বলছে ভয়ভীতির কথা। কিন্তু যদি আমরা ধরেও নিই, আওয়ামী লীগের বাইরের সব ভোট বিএনপি-জামায়াতের পক্ষেই যেত, তাহলেও ২ কোটি ২০ লাখ ভোটের ব্যবধান থাকত বিএনপি আর আওয়ামী লীগের মধ্যে।’ তিনি আরও বলেন, ‘তারপরও আমাদের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা কেউ কেউ বিএনপির এই আন্তজাির্তক লবিংয়ের সঙ্গে সমান তালে গলা মিলিয়ে নিবার্চনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে। তাদের অভিযোগগুলোর উত্তর দেয়ার পাশাপাশি আমি নিজেও কিছু কথা বলতে চাই।’ বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের অভিযোগের ব্যাখ্যা দিয়ে জয় লিখেছেন, ‘তাদের প্রথম অভিযোগ, ভোটার সংখ্যা ছিল অত্যধিক। তার মানে ভুয়া ভোট দেয়া হয়েছে। এবার ভোট দেয়ার হার ছিল ৮০ শতাংশ, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে সবোর্চ্চ নয়। ২০০৮ সালের ‘তত্ত¡াবধায়ক সরকারের’ অধীনে নিবার্চনে ভোট দেয়ার হার ছিল ৮৭ শতাংশ, যা এখন পযর্ন্ত রেকডর্। সেই নিবার্চনটিতেও আওয়ামী লীগ ৪৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ব্যাপক ব্যবধানে জয় পেয়েছিল। ২০০১ সালে ভোট দেয়ার হার ছিল ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ আর ১৯৯৬ সালে ছিল ৭৫ শতাংশ। ওই দুটি নিবার্চনের তুলনায় এবার ভোট দেয়ার হার সামান্য বেশি ছিল, কারণ এক দশকে এটাই ছিল প্রথম অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নিবার্চন।’ বিএনপির উদ্দেশে জয় বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নাকি এবার ৯০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এই কথাটি পুরোপুরি মিথ্যা। আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছে ৭২ শতাংশ। মহাজোটের অন্য শরিকরা পেয়েছে ৫ শতাংশের কম ভোট। এই ৭২ শতাংশও আওয়ামী লীগের জন্য সবোর্চ্চ না। কারণ, ১৯৭৩ সালের নিবার্চনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৭৩ দশমিক ২ শতাংশ ভোট। তখন যেমন স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে আওয়ামী লীগ বিশাল বিজয় পেয়েছিল, এবারের নিবার্চনেও আওয়ামী লীগের ভোট বাড়ার পেছনে আছে দুটি সুনিদির্ষ্ট কারণ।’ জয় বলেন, ‘প্রথম কারণটি খুবই পরিষ্কার। আওয়ামী লীগ আমলে মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে যেকোনো সময়ের থেকে বেশি। আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হয়েছি, মাথাপিছু আয় প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। দারিদ্র্যের হার অধের্ক করা হয়েছে। মোটামুটি সবাই এখন শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা ও বিদ্যুতের সুবিধা পাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য যে উন্নয়ন আওয়ামী লীগ সরকার করেছে, তা এখন দৃশ্যমান।’ জয় বলেন, ‘আমাদের সুশীল সমাজ সবসময়ই বলার চেষ্টা করে বাংলাদেশের ভোটাররা নাকি পরিবতর্ন চায়। এসব ঢালাও কথাবাতার্, যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এ থেকেই বোঝা যায়Ñ আসলে তারা কতটা জনসম্পৃক্ততাহীন। আপনি যদি একজন সাধারণ মানুষ হন, এমনকি ধনী ব্যবসায়ীও হন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশের অথর্নীতি যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার সুফল আপনিও পাচ্ছেন। মানুষ কেন এমন একটি সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিতে চাইবে, যাদের আমলে তার জীবন বা ব্যবসার উন্নতি ঘটেছে?’ দ্বিতীয় কারণ ব্যাখ্যা করে জয় বলেন, ‘আমাদের নিবার্চনী প্রচার কিন্তু গত বছর শুরু হয়নি। আমরা ২০১৪ সালের নিবার্চনের পর থেকে আমাদের প্রচারণা শুরু করে দিয়েছিলাম। জনগণের কাছে আমাদের উন্নয়নের বাতার্ পেঁৗছে দেয়ার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করিনি। আমরা তাদের বুঝিয়েছি, যা উন্নয়ন ও অগ্রগতি হচ্ছে, তা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণেই হচ্ছে। অথৈর্নতিক ও সামাজিক যত উন্নয়ন দেখা যাচ্ছে, তার পেছনে আছে আমাদের দলের ভিশন, পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও পরিশ্রম। যার কৃতিত্ব আমাদের দলীয় মন্ত্রী, সাংসদ, কাউন্সিলরসহ সবার। যখন আমাদের বিরোধী পক্ষ ও সুশীল সমাজ ব্যস্ত ছিল সমস্যা ও নালিশ নিয়ে, আমরা ব্যস্ত ছিলাম জনগণকে সমস্যার সমাধান দিতে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সুশীল সমাজের একটি বড় অপপ্রচার হচ্ছে, নতুন ভোটাররা রাজনৈতিক দল নিয়ে মাথা ঘামায় না ও তাদের বেশির ভাগই নাকি পরিবতর্ন চায়। তারা বুঝতে পারেনি যে এই নতুন ভোটাররা আমাদের আমলের উন্নয়নের মধ্যে বড় হয়েছে, যা তাদের জীবনকে করেছে আরও সহজ ও উন্নত। তারা কেন আমাদের ভোট দেবে না?’ আওয়ামী লীগের জনমত জরিপের কথা তুলে ধরে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, ‘২০১৩ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের জন্য আমি জনমত জরিপ করাই। আপনারা হয়তো খেয়াল করেছেন যে এবার কিন্তু সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে কোনো জরিপ আসেনি। ২০১৪ সালের নিবার্চনের আগে কিন্তু তারা ঠিকই একের পর এক জরিপ প্রকাশ করছিল, দেখানোর জন্য আওয়ামী লীগের অবস্থা কত খারাপ। আসলে বাংলাদেশে খুব কম ব্যক্তি বা সংগঠনই সঠিকভাবে জনমত জরিপ করতে পারে। হাভাের্ডর্ থাকতে আমি জনমত জরিপের ওপর পড়াশোনা করি। জরিপ করতে আমরা যাদের ব্যবহার করি, তাদের বাছাই করার আগে আমি নিজে একাধিক গবেষণা সংগঠনের সঙ্গে বসে আলাপ করি। ভুয়া জরিপ করে নিজেদের জনপ্রিয়তা দেখানোর কাজ আমরা করি না, কারণ আমাদের জন্যই সঠিক তথ্যটি পাওয়া খুবই জরুরি। আমরা জানতে চেষ্টা করি, নিবার্চনী লড়াইয়ে আমাদের অবস্থান ও সক্ষমতা, তাই জরিপের ব্যাপারে আমরা খুবই সতকর্ থাকি।’ জরিপ বিষয়ে জয় বলেন, ‘নিবার্চনের দুই সপ্তাহ আগে আমাদের জরিপ থেকে আমরা জানতে পারি, আওয়ামী লীগ পাবে ৫৭ থেকে ৬৩ শতাংশ ভোট আর বিএনপি পাবে ১৯ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট। তাহলে আমরা ৭২ শতাংশ ভোট কীভাবে পেলাম? আমাদের জরিপের জন্য স্যাম্পল নেয়া হয় ৩০০ আসন থেকে। অথার্ৎ ১০ কোটি ৪০ লাখ নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে থেকে। কিন্তু ভোট দেয়ার হার কখনোই ১০০ শতাংশ হয় না আর ৩০ ডিসেম্বর নিবার্চন হয়েছিল ২৯৮টি আসনে। ২৯৮টি আসনে ১০ কোটি ৩৫ লাখ নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে ৮০ শতাংশ ভোট দিয়েছেন, অথার্ৎ ৮ কোটি ২৮ লাখ। আওয়ামী লীগ পেয়েছে প্রায় ৬ কোটি ভোট। ১০ কোটি ৩৫ লাখ ভোটারের মধ্যে ৬ কোটি মানে ৫৮ শতাংশ। অথার্ৎ আমাদের জরিপের সঙ্গে এই বিষয়টি মিলে যায়।’ তিনি বলেন, ‘কিন্তু বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট কেন এত কম ভোট পেল? কিছু যৌক্তিক কারণে। বিএনপির চেয়ারপারসন দুনীির্তর দায়ে দÐিত হয়ে জেলে আছেন। তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনও দÐিত আসামি, আছেন দেশের বাইরে পালিয়ে। তাদের সংগঠনের অবস্থা করুন। তার থেকেও বড় আরেকটি কারণ আছে, যা আমাদের সুশীল সমাজ সহজে বলতে চায় না। যেই কারণটি বিএনপির জনপ্রিয়তায় ধসের পেছনে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর বলে আমি মনে করি।’ বিএনপির জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ ব্যাখ্যা করে জয় বলেন, ‘জনমত জরিপগুলো থেকে খেয়াল করেছি যে বিএনপি ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পযর্ন্ত যে অগ্নিসন্ত্রাস চালায়, তারপর থেকেই তাদের জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ধস নামে। পেট্রলবোমা সন্ত্রাসের আগে জরিপগুলোয় বিএনপি আওয়ামী লীগ থেকে জনপ্রিয়তায় ১০ শতাংশ পিছিয়ে থাকত। কিন্তু রাজনীতির নামে সন্ত্রাসবাদের কারণে তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ব্যবধান ৩০ শতাংশ হয়ে যায়, আর তারপর থেকেই বাড়তেই থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ ছাড়া তাদের আত্মঘাতী নিবার্চনী প্রচারণার বিষয়টিও আমাদের আমলে নিতে হবে। নিবার্চনী প্রচারণায় কমতি ছিল পরিষ্কারভাবেই। তার ওপর তারা তারেক রহমানের মাধ্যমে নিজেদের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেয়। আর মানুষের মনে ভেসে ওঠে হাওয়া ভবন আমলের দুনীির্ত ও সহিংসতার দুঃসহ সব স্মৃতি। তারেক রহমান আবার মনোনয়ন দেন একাধিক চিহ্নিত অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীকে। এর মাধ্যমে কি তাদের জনপ্রিয়তা বাড়বে, না কমবে?’ বিএনপির ব্যথর্তার কারণ ব্যাখ্যা করে জয় বলেন, ‘নিবার্চনের আগ মুহূতর্ পযর্ন্ত তাদের সমথর্কদের তারা ইঙ্গিত দেয় যে তারা নিবার্চন থেকে সরে আসবে। আপনি যদি মনে করেন আপনার দল নিবার্চনেই আসবে না, তাহলে কি আপনি ভোট দেয়ার জন্য প্রস্তুত হবেন? এই কারণে তাদের নিজেদের সমথর্কদেরও ভোট দেয়ার হার কম ছিল, যার ফলশ্রæতিতে তারা ভোট পায়ও কম।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের বাতার্ই ছিল আওয়ামী লীগ খারাপ। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সেই বাতার্ গ্রহণ করেনি। কারণ, তারা নিজেরাই দেখেছে কীভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে।’ ড. কামাল হোসেন প্রসঙ্গে জয় বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের নেতা কামাল হোসেন নিজে নিবার্চনই করেননি। কারণ, তিনি জানতেন, তিনি কোনো আসন থেকে জিততে পারবেন না। কিন্তু তারা আমাদের কিছুটা অবাকও করেছেন। ভোটের লড়াইয়ে প্রথমবারের মতো কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম একটি নয়, দুটি আসন থেকে জয়লাভ করে। কারচুপি যদি হতোই, তাহলে যে দল আগে কোনো নিবার্চনেই কোনো আসন পায়নি, তারা কীভাবে দুটি আসনে জেতে?’ স্ট্যাটাসের শেষে জয় বলেন, ‘সত্য আসলে বেশি জটিল না। বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষ করে তরুণরা, দেখছে কীভাবে শেখ হাসিনার মতো একজন ডাইনামিক নেত্রী দেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই বিরোধী পক্ষের শত অপবাদ, অপপ্রচার ও কাদা ছোড়াছুড়ি কোনো কাজে আসেনি। কারণ, দিন শেষে মানুষ তাকেই বেছে নেয়, যে তাকে উন্নত জীবন দিতে পারবে।’