শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
বিএনপির ইশতেহার ঘোষণা

খালেদা-তারেকের ‘সম্মান রক্ষায়’ ভোট চাইলেন মিজার্ ফখরুল

ভোটের দিনটিকে বিএনপি গণতন্ত্রের নিত্যদিনের অনুশীলনে পরিণত করবে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনবে। বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার দেবে
যাযাদি রিপোটর্
  ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০
বিএনপি মহাসচিব মিজার্ ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে জাতীয় সংসদ নিবার্চনের ইশতেহার ঘোষণা করেন। পাশে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান ও নজরুল ইসলাম খান Ñফোকাস বাংলা

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘সম্মান’ ও ‘মযার্দা’ প্রতিষ্ঠা এবং বিএনপির ঘরছাড়া নেতা-কমীের্দর ঘরে ফেরার সুযোগ দিতে ভোট চাইলেন দলের মহাসচিব মিজার্ ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আপনাদের একটি ভোট আমাদের নেত্রীর জীবনকে পুনরায় আলোয় উদ্ভাসিত করবে।’ মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ইশতেহার প্রকাশকালে মিজার্ ফখরুল এসব কথা বলেন। রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি কী কী করবে, তা তুলে ধরেন তিনি। ইশতেহারের বেশির ভাগই ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারের সঙ্গে মিল রয়েছে। বিএনপির ইশতেহারে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সম্পকের্ বলা হয়, নিবার্চনের দিনটিকে বিএনপি গণতন্ত্রের নিত্যদিনের অনুশীলনে পরিণত করবে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনবে। বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার দেবে। সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন ও গণভোট পুনঃপ্রবতর্ন করবে। নিবার্চনকালীন সরকারের কাঠামো প্রবতর্ন করবে। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে নতুন ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গঠনের জন্য জাতীয় কমিশন গঠন করবে। এ ছাড়া ন্যায়পাল নিয়োগ, র‌্যাবের পুনগর্ঠন, পুলিশ ও আনসার ছাড়া শতর্ সাপেক্ষে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা উঠিয়ে দেয়া, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর যাতায়াতের সময় সাধারণ মানুষের দুভোর্গ রোধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রসঙ্গ রয়েছে। নিম্ন আদালতকে সুপ্রিম কোটের্র হাতে ন্যস্ত করারে কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া বিচারব্যবস্থার সংস্কারে জুডিশিয়াল কমিশনের কথা ইশতেহারে বলা হয়েছে। ইশতেহারে মতপ্রকাশের অবারিত স্বাধীনতা, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল, বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করা, গুম-খুন ও শারীরিক-মানসিক নিযার্তন বন্ধের প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়েছে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণসহ বাজেটের ৩০ শতাংশ স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে। বতর্মান সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ না করার প্রতিশ্রæতির পাশাপাশি এসব কাজের দুনীির্ত নিরীক্ষা করে দেখবে বিএনপি। বতর্মান সরকারের শেষ দুই বছরে তড়িঘড়ি করে নেওয়া প্রকল্পগুলো পুনবিের্বচনা করা হবে। সোমবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার প্রকাশ হয়। গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে এই ঐক্যফ্রন্টের প্রধান শরিক দল বিএনপি। মঙ্গলবার বিএনপি আলাদা করে ইশতেহার দিল। দুটি দুনীির্তর মামলায় দÐ পেয়ে এখন কারাগারে আছেন খালেদা জিয়া। আর তিনটি মামলায় দÐপ্রাপ্ত তারেক রহমান আছেন লন্ডনে। এর মধ্যে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মামলায় তারেক রহমান যাবজ্জীবন কারাদÐ পেয়েছেন। নয় পৃষ্ঠার ইশতেহার তুলে ধরে বিএনপির মহাসচিব দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাদÐ নিয়ে বলেন, ‘আজকের এই মুহূতের্ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আমাদের সঙ্গে নেই। তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে একটি পরিত্যক্ত ভবনে নিজর্ন কারাবাস করছেন।’ আর তারেক রহমান সম্পকের্ মিজার্ ফখরুল বলেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই দেশে ফিরতে পারছেন না।’ তিনি তাদের সম্মান ও মযার্দা রক্ষায় জনগণের কাছে বিএনপির পক্ষে ভোট চান। মিজার্ ফখরুল অভিযোগ করেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নিবার্চনে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা একটি জনপ্রতিনিধিত্বহীন সরকার গঠন করে। গত প্রায় ১০ বছরে দেশে কোনো রকম সুশাসন ও আইনের শাসন ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার সাম্য, মানবিক মযার্দা ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। মামলা-হামলা, গুম, খুন ও বিচারবহিভূর্ত হত্যাকাÐের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে এক ভীতি ও ত্রাসের রাজত্ব। জনগণের বাক্?স্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। দেশে আঞ্চলিক ও শ্রেণিবৈষম্য ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। দারিদ্র্য হ্রাসের হার কমে গেছে। দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, ব্যাংকগুলো লুট হয়ে যাচ্ছে। দেশে সৃষ্টি হয়েছে দুবৃর্ত্তায়ন ও লুণ্ঠনের অথর্নীতি। বিএনপির মহাসচিব আরও বলেন, এ রকম একটি নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতিতে ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ লড়াই শুধু নিবার্চনে জয়-পরাজয়ের লড়াই নয়, এ লড়াই অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। এ লড়াই ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুক্ত জীবনে এগিয়ে যাওয়ার লড়াই। বিএনপি একটি উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। দেশের উন্নয়নের জন্য বিএনপির কমর্সূচিগুলো বহুমুখী ও উন্নততর। বিএনপি জনগণের কাছে স্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করতে চায়, ক্ষমতায় গেলে কারও ওপরই কোনো প্রতিশোধ নেয়া হবে না। একটি প্রতিহিংসামুক্ত ও সহমমীর্ বাংলাদেশ গড়ে তোলাই বিএনপির লক্ষ্য। ভোটারদের উদ্দেশে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘এই মুহূতের্ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিএনপির নেতা-কমীর্ ও সমথের্করা নিজ ঘরে থাকতে পারছেন না। তারা নিজ ঘরে ফিরতে চান। পেতে চান পরিবারের সান্নিধ্য, একটি স্বস্তিময় রাত। আপনাদের সমথর্ন ঘরছাড়া এই মানুষগুলোকে ঘরে ফেরার সুযোগ করে দেবে। অবসান ঘটাবে জুলুম ও নিযার্তনের বিভীষিকাময় পরিস্থিতির। নিবার্চনে জয়লাভ করে ঐক্যের সরকার গঠন করলে ঐকমত্য, সবার অন্তভুির্ক্ত ও প্রতিহিংসাহীনতাÑএই মূলনীতির ভিত্তিতে বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।’ ইশতেহারের উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রæতি ০ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা হবে। পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকার বিধান করা হবে। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সাংসদ এবং উচ্চ পদস্থ সরকারি কমর্কতাের্দর সম্পদের হিসাব প্রতি বছর প্রকাশ করা হবে। ০ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। ০ পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাতিল হওয়া গণভোট ব্যবস্থা পুনঃপ্রবতর্ন করা হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে শতর্ সাপেক্ষে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা হবে। ০ প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য নতুন এক সামাজিক চুক্তিতে পেঁৗছাতে একটি জাতীয় কমিশন গঠন করা হবে। ০ প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়পাল নিয়োগ দেয়া হবে। ০ র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। র‌্যাবের বতর্মান কাঠামো পরিবতর্ন করে অতিরিক্ত আমডর্ পুলিশ ব্যাটালিয়ন গঠন করা হবে, যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে। পুলিশ বাহিনীর ঝুঁকিভাতা বাড়ানো হবে। পেশাদারিত্ব বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ নেয়া হবে। পুলিশের জন্য কল্যাণমূলক প্রকল্প গৃহীত হবে। ইন্সপেক্টর ও সাব ইন্সপেক্টরদের বেতন ছয় মাসের মধ্যে আপগ্রেড করা হবে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা অবসরে গেলেও তাদের রেশনিং সুবিধা দেয়া হবে। ০ সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সুপ্রিম কোটের্র হাতে ন্যস্ত করা হবে। বতর্মান বিচার ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য একটি জুডিশিয়াল কমিশন গঠন করা হবে। ০ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-সহ সব কালা কানুন বাতিল করা হবে। ০ দেশরক্ষা, পুলিশ ও আনসার ব্যতিত শতর্সাপেক্ষে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো সময়সীমা থাকবে না। ০ বিডিআর হত্যাকাÐ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজাভর্ চুরি-সংক্রান্ত সকল অনুসন্ধান রিপোটর্ জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। একই সঙ্গে এসবের অধিকতর তদন্তের উদ্যোগ নেয়া হবে। ০ জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ১১ শতাংশে উন্নীত করা হবে। সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক পরিচালনা বোডের্ যোগ্য, সৎ, দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া হবে। ০ অথর্ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশন বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহ পরিচালনা ও তদারকির ভার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ন্যস্ত করা হবে। ০ দেশে কমর্রত বিদেশিদের ওয়াকর্ পারমিটের আওতায় এনে মুদ্রা পাচার রোধ করা হবে। ০ বিচারবহিভূর্ত হত্যাকাÐ, গুম-খুন ও অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নিযার্তনের অবসান ঘটানো হবে। ০ এক বছরব্যাপী অথবা কমর্সংস্থান না হওয়া পযর্ন্ত যেটাই আগে হবে শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা প্রদান করা হবে। তাদের যৌক্তিক অথৈর্নতিক উদ্যোগে আথির্ক সহায়তা দেয়া হবে। ২৫ বছর পযর্ন্ত তরুণদের স্বাথর্ সংরক্ষণের জন্য ইয়ুথ পালাের্মন্ট গঠন করা হবে। ০ সকল মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রের সম্মানিত নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করা হবে। মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের নামে দুনীির্তর অবসান ঘটানো হবে। মূল্যস্ফীতির নিরিখে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ভাতা বাড়ানো হবে। দেশের সবর্ত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধকালীন বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিত করে সেসব স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নিমার্ণ করা হবে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা হবে এবং তাদের যথাযথ মযার্দা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে