শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা-৭

অসুস্থ হাজি সেলিম প্রচারে এগিয়ে, বেকায়দায় মন্টু

যাযাদি রিপোটর্
  ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০
হাজি মো. সেলিম মোস্তফা মোহসীন মন্টু

একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনকে সামনে রেখে ঢাকা-৭ আসনে সরগরম ও সুশৃঙ্খল প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন আওয়ামী লীগের প্রাথীর্ হাজি মো. সেলিম।

নৌকা প্রতীকে প্রভাবশালী এই প্রাথীর্র বিপরীতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ধানের শীষের প্রাথীর্ মোস্তফা মোহসীন মন্টুর নিবার্চনী কাযর্ক্রম চলছে ঢিমেতালে।

কেরানীগঞ্জ এলাকায় বেশ প্রভাবশালী হলেও গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মন্টু লালবাগ এলাকায় এসে স্থানীয় হাজি সেলিমের সঙ্গে পাল্লা দিতে কতটা পারবেন, তা নিয়ে সংশয়ী ভোটাররা।

লালবাগ, চকবাজার, কোতোয়ালির একাংশ ও বংশাল থানা নিয়ে গঠিত ঢাকা-৭ আসনে গত নিবার্চনে আওয়ামী লীগের প্রাথীের্ক হারিয়ে দেন স্বতন্ত্র প্রাথীর্ হাজি সেলিম। অসুস্থ হওয়ার পরও এবার তাকে নৌকার টিকিট দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

তার সঙ্গে প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী আওয়ামী লীগেরই সাবেক নেতা মন্টু; জোটগত নিবার্চনে গণফোরামের এই নেতা বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নিবার্চনে লড়ছেন।

স্থানীয়রা বলছেন, ?নিবার্চনী হাওয়া শুরুর পর থেকে হাজি সেলিমের ব্যানার-পোস্টারে ছেয়ে দেয়া হয় তার সংসদীয় এলাকাসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর পরও বতর্মান সাংসদের সমথর্করা সুশৃঙ্খল প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন।

অন্যদিকে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর পঁাচ দিনের মাথায় শনিবার দুপুরে প্রথমবারের মতো নিবার্চনী গণসংযোগে নামেন মন্টু। যদিও জুমার নামাজ শেষে আজিমপুর কবরস্থানের সামনের মসজিদ এলাকায় কিছু লিফলেট বিলি করেই চলে যান তিনি।

নিজের পক্ষে লালবাগ-চকবাজার এলাকার ভোট টানতে বিএনপির স্থানীয় নেতাকমীের্দর জোর সমথর্ন দরকার হলেও ওই সময় তার সঙ্গে সেখানকার তেমন কোনো বিএনপি নেতা-কমীর্র দেখা মেলেনি।

পুরান ঢাকার আলোচিত-সমালোচিত হাজি সেলিম বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েই ১৯৯৬ সালের নিবার্চনে এই আসনের প্রথমবার সংসদ সদস্য নিবাির্চত হন।

সে সময় সাবেক ঢাকা-৮ আসনের বিএনপি প্রাথীর্ আবুল হাসনাতকে হারালেও ২০০১ সালের নিবার্চনে তিনি হেরে যান বিএনপি প্রাথীর্ নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টুর কাছে।

অন্যদিকে সীমানা পুনবির্ন্যাসের পর ২০০৮-এর নিবার্চনে ওই আসনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বিএনপির নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টুকে হারিয়ে সাংসদ নিবাির্চত হন।

২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন নিবার্চনে দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রাথীর্ হয়ে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে হারিয়ে দিয়ে চমক দেখান হাজি সেলিম।

বছর দেড়েক আগে ব্রেইন স্ট্রোক হয় হাজি সেলিমের। দীঘির্দন চিকিৎসার পর শারীরিক অচলতা কাটিয়ে এখন কিছুটা সুস্থ হলেও কথা বলার শক্তি প্রায় হারিয়েছেন তিনি।

ধানের শীষের বিপরীতে ভোটের ফল ঘরে তুলতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিরোধে কাটিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হবে হাজি সেলিমকে।

স্থানীয়রা জানান, পুরান ঢাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও হাজি সেলিমের বিরোধ দীঘির্দনের। আবার গত নিবার্চনে আওয়ামী লীগ প্রাথীর্র বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রাথীর্ হওয়ায় এবং এলাকায় কোনঠাসা থাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ হাজি সেলিমের বিরোধী ছিলেন।

সংসদ সদস্য পদপ্রাথীর্ হাজি সেলিমের পক্ষে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকমীের্দর এক করতে তিনদিন আগে আজিমপুরে ওই এলাকার নেতাকমীের্দর নিয়ে সভার আয়োজন করা হয়েছিল।

ওই এলাকার বিভিন্ন থানার নেতাকমীের্দর পাশাপাশি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ উপস্থিত ছিলেন।

নিজেদের মধ্যে সব ধরনের বিভেদ ও বিরোধ মিটিয়ে ফেলা হয়েছে বলে দাবি করেছেন লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন।

তিনি বলেন, ‘প্রতিটি দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে। আমি নিজেও ক্যান্ডিডেট ছিলাম। প্রতিদ্ব›িদ্বতা-প্রতিযোগিতা প্রতিটি দলের মধ্যে থাকবে। কিন্তু চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার মালিক হলো পাটির্ হাইকমান্ড।

‘জননেত্রী শেখ হাসিনা যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন, আমরা সবাই তার জন্য কাজ করব। এখানে আমাদের মধ্যে আর কোনো বিরোধ নেই, থাকার সুযোগও নেই।’

ঢাকা-৭ আসনে নৌকার প্রাথীর্ হাজি সেলিম শুক্রবার দুপুরে লালবাগ এলাকায় নিবার্চনী প্রচর চালান।

কথা বলতে না পারায় হাজি সেলিমের হয়ে অন্যরা বক্তব্য দিয়ে থাকেন। তেমনি তার হয়ে বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগ নেতা দেলোয়ার।

তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে আমাদের মাঠ অনেকটা গুছিয়ে ফেলেছি। ১৩টি ওয়াডের্র নেতৃবৃন্দ ও আমাদের হাজি সেলিমের নিজস্ব ফোসর্, সবাই মিলে একাত্মতা ঘোষণা করে কাজ করে যাচ্ছি। ঢাকা-৭ আসন বিপুল ভোটে জয়ী হব।’

এক সময় আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে নেতা হিসেবে পরিচিত মন্টু ১৯৮৬ সালে কেরানীগঞ্জ থেকে নৌকার টিকিটে সংসদ সদস্য নিবাির্চত হয়েছিলেন।

এরপর ওই আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রাথীর্ হয়ে ১৯৯১ সালের নিবার্চনে তিনি হেরে যান বিএনপির আমানউল্লাহ আমানের কাছে।

কেরানীগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা বাদল হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৯৯২ সালের মে মাসে মন্টুকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

পরবতীর্কালে আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে যাওয়া ড. কামাল হোসেনের গড়া নতুন দল গণফোরামে যোগ দেন তিনি। ২০০৪ সাল থেকে দলটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলার এই কমান্ডার।

ওই আসনে বিএনপির সাবেক সাংসদ পিন্টুর বেশ প্রভাব ছিলেন। তিনি বিডিআর বিদ্রোহ মামলার চলাবস্থায় ২০১৫ সালে কারাগারে মারা যান।

বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন পিন্টুর স্ত্রী নাসিমা আক্তার কল্পনা। বিএনপির জাতীয় নিবার্হী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহ-সভাপতি কল্পনার সঙ্গে আরও কয়েকজন ধানের শীষের মনোনয়ন চেয়েছিলেন।

আর সংসদ নিবার্চন নিয়ে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম সংগঠক মন্টু প্রাথীর্ হতে চেয়েছিলেন নিজের ঢাকা-৩ আসন থেকে। কিন্তু সেখানে আমানের বদলে তার ছেলে ইরফান ইবনে আমান অমিকে প্রাথীর্ করে মন্টুকে ঢাকা-৭ আসনে ধানের শীষের টিকিট দেয়া হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, নিবার্চনের বৈতরণী পার হতে লালবাগ ও চকবাজার এলাকায় বিএনপির জোর সমথর্ন দরকার হবে মন্টুর। কিন্তু বিএনপি নিজেরাই কোনঠাসা অবস্থায় তিনি সেই সমথর্ন কতটুকু পাবেন, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ।

মিটফোডর্ এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ নওয়াব বলেন, পুরান ঢাকায় স্থানীয় লোক দেখে ভোট দেয়ার একটা রেওয়াজ রয়েছে। এই আসনে যদি পিন্টুর স্ত্রীর মতো স্থানীয় কাউকে দিত, তাহলে বিএনপির মাঠ পযাের্য়র কমীর্রা আরও উৎসাহ পেত।

সেটা মন্টুর ক্ষেত্রে সম্ভব হবে না বলেই মনে করেন তিনি। সে ক্ষেত্রে কল্পনার বদলে বেচারাম দেউরির রাসেল কমিশনার, সোয়ারিঘাটের হুমায়ুন কমিশনারের মতো প্রাথীর্রা মনোনয়ন পেলেও এই এলাকায় ‘হাড্ডাহাড্ডি লড়াই’ হতে পারত বলে ভাষ্য তার।

বিএনপির জোরালো সমথর্ন না পাওয়ার শঙ্কা ও এলাকা নিয়ে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ অবস্থায়ও জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী বলে মন্তব্য করেছেন মোস্তফা মোহসীন মন্টু।

তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করছি, সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্ট আমাদের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট-ধানের শীষের পক্ষে প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ। আমরা আশা করছি, যদি অবাধ-সুষ্ঠু নিবার্চন হয়, তাহলে শতকরা ৮০টা ভোট আমরা ধানের শীষের পাব, ঐক্যফ্রন্ট পাবে।’

বিএনপিকে নিবার্চনের মাঠে রাখার বিষয়ে এক প্রশ্নে মন্টু বলেন, ‘আমরা সবাইতো একসঙ্গেই কাজ করছি। আমরা একটি জাতীয় সংকটে আছি। এই সংকট থেকে উত্তরণের মানুষকে আমরা এক করার চেষ্টা করছি। এখানে বিএনপি বা গণফোরাম বলে কোনো ভেদাভেদ নেই।’

বিএনপি নেতাকমীের্দর নিয়েই প্রতিটি থানা ও ওয়াডের্ নিবার্চনের জন্য কমিটি ইতোমধ্যে করা হয়েছে বলে জানান গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক।

হাজি সেলিম ও মন্টুর সঙ্গে ঢাকা-৭ আসনে প্রাথীর্ হিসেবে ‘মই’ প্রতীকে বাসদের খালেকুজ্জামান, লাঙ্গলে জাতীয় পাটির্র তারেক আহমেদ আদেল, গোলাপ ফুলে জাকের পাটির্র বিপ্লবচন্দ্র বণিক, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের রিয়াজ উদ্দিন, হারিকেনে মুসলিম লীগের আফতাব হোসেন মোল্লা, হাতপাখায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আব্দুর রহমান, টেলিভিশনে বিএনএফের জাহাঙ্গীর হোসেন, আম প্রতীকে ন্যাশনাল পিপলস পাটির্র মো. মাসুদ পাশা এবং বটগাছে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মো. হাবিবুল্লাহ রয়েছেন।

ভোটারের হিসাবে ভোট

ঢাকা-৭ আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমথের্নর ভোটের একটি হিসাব পাওয়া যায় বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে কয়েকজন ভোটারের কথায়।

সরকারি চাকুরে জাহাঙ্গীর আলম দীঘির্দন পুরান ঢাকায় বসবাস করছেন। তিনি মিটফোডর্ এলাকার ভোটার।

তিনি বলেন, মৌলভীবাজারের বেগমবাজার, বংশাল থানা, রহমতগঞ্জ আর নয়াবাজারে বিএনপির ‘যথেষ্ট’ ভোট রয়েছে। তঁাতীবাজার ও শঁাখারিবাজার এলাকা আওয়ামী লীগের ‘ঘঁাটি’। লালবাগের নবাবগঞ্জ এলাকায় আওয়ামী লীগের ভোট বেশি হলেও নাজিম উদ্দিন রোড ও হোসনি দালান এলাকায় নৌকা-ধানের শীষের ভোট সমান-সমান।

কিন্তু প্রাথীর্ মন্টু হওয়ায় বিএনপির এই ভোটগুলো ‘না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি’ বলে মনে করেন জাহাঙ্গীর আলম।

শ্রমজীবী, দিনমজুর ও নিম্নবিত্তদের মধ্যে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হাজি সেলিমের আলাদা জনপ্রিয়তা রয়েছে বলে মনে করেন অনেক ভোটার।

ইসলামবাগের বাসিন্দা ভ্যানচালক ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘পুরান ঢাকায় শত শত ভ্যানচালক রয়েছে। আমরা দিনমজুর। বিএনপি-আওয়ামী লীগ বুঝি না, হাজির পক্ষে।’

শহীদনগর এলাকার ভোটার আকিলমা বেগম বলেন, ‘লালবাগের প্রায় সব শ্রেণির মানুষ হাজির পক্ষে। এখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নাম কোনো কাজ করে না। নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তরা হাজির অন্ধ ভক্ত। এটাই তার সম্বল।’

তবে জায়গা দখলসহ বাড়ি সংক্রান্ত ও স্থানীয় সালিশের জটিলতার কারণে হাজি সেলিমের ওপর ক্ষোভ রয়েছে বলেও জানিয়েছেন কয়েকজন ভোটার।

এই আসনে এবার মোট ১২২টি কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩ লাখ ২৮ হাজার ১৮১ জন। ১ লাখ ৭৫ হাজার ১৮৪ জন পুরুষের বিপরীতে নারীর সংখ্যা ১ লাখ ৫২ হাজার ৯৯৭ জন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<27494 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1