শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আতঙ্ক নিয়ে ভোটের মাঠে বিএনপি

বিরোধীদলীয় প্রাথীের্দর প্রচারণায় বাধা দেয়ার অভিযোগ নতুন করে ধরপাকড় অভিযান জোরদার করেছে পুলিশ দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেও ঘটছে সংঘাত-সহিংসতা নিরপেক্ষ সাধারণ ভোটারদের উৎসাহে চরম ভাটা
সাখাওয়াত হোসেন/হাসান মোল্লা
  ১২ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০
আপডেট  : ১২ ডিসেম্বর ২০১৮, ১০:২০

মনোনয়ন যুদ্ধ শেষে প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে ক্ষমতাসীনরা ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সোমবার থেকে নিবার্চনী প্রচার-প্রচারণায় নামলেও বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলোর নেতাকমীর্-সমথর্করা এখনো নানামুখী শঙ্কায় রয়েছেন। বিশেষ করে যেসব আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই পক্ষেরই শক্তিশালী প্রাথীর্ রয়েছেন, সেসব এলাকার ভোটারদের মধ্যে চাপা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। বেশকিছু আসনে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ায় তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা নানা কৌশলে ভোটের মাঠ উত্তপ্ত করে তুলতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন অনেকেই। এছাড়া গায়েবি মামলায় জজির্রত বিএনপির নেতাকমীের্দর গ্রেপ্তার বন্ধ না হওয়ায় আতঙ্ক নিয়ে ভোটের মাঠে নেমেছে বিএনপি। এদিকে নিবার্চনী প্রচার-প্রচারণা শুরুর প্রথম দিনই বিভিন্ন স্থানে বিএনপির রাজনৈতিক কাযার্লয় ও দলীয় নেতাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, প্রাথীের্দর প্রচারণার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় কমীের্দর মধ্যে নতুন করে নানামুখী ভীতি ছড়িয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি মহাসচিব মিজার্ ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নিবার্চনী প্রচারের গাড়িবহরে হামলার ঘটনা জনমনে সুষ্ঠু ভোট হওয়া নিয়ে ফের সংশয় দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্ব›েদ্বর সংঘাতে গুলিবিদ্ধ হওয়াসহ বিপুলসংখ্যক নেতাকমীর্ আহত হওয়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন অনেকেই। নিবার্চন পযের্বক্ষকরা মনে করেন, নিবার্চন কমিশন (ইসি) মুখে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কথা বললেও বাস্তবে সে পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বরাবরের মতো পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা পালন করলেও নিবার্চন কমিশন তাদের নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তাই নিবার্চনী পরিবেশ আগের মতোই ঘোলাটে রয়েছে। ফলে সাধারণ ভোটাররা আগের মতো নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে। এদিকে নিবার্চনী প্রচার-প্রচারণা শুরুর দ্বিতীয় দিনেই ক্ষমতাসীন দলের প্রাথীর্রা লাখ লাখ পোস্টার-ফেস্টুনে শহর-বন্দর-গ্রামের রাস্তাঘাট ছেয়ে ফেললেও বিরোধীদলীয় প্রাথীর্রা এ পাল্লায় এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছেন। তৃণমূলের নেতাকমীের্দর অভিযোগ, সোমবার মধ্যরাত থেকে শুরু করে ভোর পযর্ন্ত তারা বিভিন্ন জায়গায় দলীয় প্রাথীর্র পোস্টার ঝুলাতে গিয়ে নানামুখী প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছেন। অনেক জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকমীর্রা তাদের সরাসরি এ কাজে বাধা দিয়েছেন। আবার কোথাও কোথাও তারা দড়িতে পোস্টার ঝুলিয়ে সে স্থান ছেড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দুবৃর্ত্তরা তা ছিঁড়ে ফেলেছে। পোস্টার টাঙাতে গিয়ে বেশ কয়েক জায়গায় তারা মারধরের শিকার হয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন তারা। তাদের এ অভিযোগ যে একেবারে অমূলক নয়, তা ঢাকা মহানগরীর বেশকিছু এলাকা ঘুরে প্রমাণ পাওয়া গেছে। রাজধানীর ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল ও গোপীবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রাথীর্র বিপুলসংখ্যক ছেড়া পোস্টার রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। অথচ এসব এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের প্রাথীর্র হাজার হাজার পোস্টার ঠিকভাবেই ঝুলছে। যদিও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এ ধরনের হামলার অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছে। মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর ধানমÐিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কাযার্লয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, ‘বিএনপির অভিযোগ সারাদেশে হামলা চালানো হচ্ছে। অথচ সুনিদির্ষ্ট করে কোন জায়গায় হামলা হয়েছে, কার ওপরে হামলা হয়েছে এ ব্যাপারটি কিন্তু তারা আনতে পারে নাই। সুতরাং এটা তাদের মিথ্যাচার রাজনীতির একটি অংশ হিসেবে তারা এ ধরনের অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে।’ অন্যদিকে বিএনপিদলীয় বেশ কয়েকজন প্রাথীর্র অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা শুধু তাদের প্রচার-প্রচারণায় বাধা দিয়েই খান্ত হয়নি, তারা তাদের নেতাকমীের্দর ভয়ভীতি দেখিয়ে এলাকা ছাড়া করার সবোর্চ্চ পঁায়তারা চালাচ্ছে। এমনকি তাদের আক্রমণাত্মক ভূমিকার মুখে খোদ প্রাথীর্রাও নিজ বাসাবাড়িতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বিএনপির বেশ কয়েকজন প্রাথীর্ এখনো এলাকায় ঢুকতে পারেননি বলে অভিযোগ করেন দলীয় হাইকমান্ড। এর মধ্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও ভোলা-৩ আসনের প্রাথীর্ মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ মঙ্গলবার নিবার্চন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে এলাকার নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন। ঢাকা-৮ আসনে বিএনপির প্রাথীর্ মিজার্ আব্বাস এবং ঢাকা-৯ আসনের প্রাথীর্ তার সহধমির্ণী আফরোজা আব্বাসও মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে তাদের নিরাপত্তাহীনতায় থাকার বিষয়টি তুলে ধরেন। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা তাদের সক্রিয় নেতাকমীের্দর তালিকা হাতে নিয়ে ঘুরছে। তারা যখন যাকে সুবিধামতো পাচ্ছে তাকে তুলে নিয়ে শারীরিক নিযার্তন চালিয়ে আধমরা করে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে। ফেনীর স্থানীয় বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটার দিকে বিএনপি প্রাথীর্ ভিপি জয়নালের ধানের শীষের প্রচারণা শেষে বাড়ি ফেরার পথে পঁাচগাছিরোড থেকে যুবলীগ নেতা পিটুর নেতৃত্বে একদল ক্যাডার তাকে তুলে নেয়। পরে তারা তাকে নিযার্তন করে পুলিশে সোপদর্ করে। অন্যদিকে দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নিবার্চনকে সামনে রেখে সারাদেশে দুই লাখ ৪০ হাজার জনের একটি তালিকা হাতে নিয়ে মাঠে নেমেছে পুলিশ। নিবার্চনের আগে এদের একটি বড় অংশকে গ্রেপ্তার করে ‘সংঘাতমুক্ত’ নিবার্চন অনুষ্ঠানের এই অভিযানের লক্ষ্য। প্রতিটি কেন্দ্রভিত্তিক সম্ভাব্য হামলাকারীর নাম- ঠিকানা এবং তারা কে কোন দলের সমথর্ক; কার জন্য কোন ভোটকেন্দ্রে তারা হামলা করতে পারেÑ এ ব্যাপারে গোয়েন্দাদের আশঙ্কার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গড়ে দেশের প্রতিটি ভোট কেন্দ্রের বিপরীতে অন্তত ৬ জন করে নাম রয়েছে। এই তালিকায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পাটির্ ও জামায়াতের কমীের্দর নাম রয়েছে। আগামী ২৭ ডিসেম্বরের মধ্যে চিরুনি অভিযানের মাধ্যমে এসব তালিকার সবাইকে গ্রেপ্তারের টাগের্ট নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। বিএনপির ৬০ জন প্রাথীর্র ফাইল ঘেঁটে দেখা গেছে, অন্তত তিনজনের ২০০টি মামলা, পাঁচজনের ১০০টি মামলা এবং চারজনের ৫০টির বেশি মামলা আছে। এসব প্রাথীর্র বিরুদ্ধে বেশির ভাগ মামলাই হয়েছে নাশকতা, সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে। বিএনপির দাবি, এসব মামলা রাজনৈতিকভাবে হয়রানির উদ্দেশ্যে করা। পুলিশ ফৌজদারি মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে একাধিক প্রাথীর্ গ্রেপ্তারও হয়েছেন। মামলার ভয় আর বোঝা নিয়েই তারা নিবার্চনে নেমেছেন। কিন্তু এখন প্রাথীের্দর গ্রেপ্তার করা হলে ভোট করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন নেতারা। ঢাকা-১২ আসনে বিএনপির প্রাথীর্ সাইফুল আলম নীরব জানান, ১২ ঘণ্টায় তার তেজগাঁও-আগারগাঁও এলাকা থেকে ৮ জন নেতা-কমীের্ক গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৬ আসনের বিএনপির প্রাথীর্ আহসান উল্লাহ হাসান জানান, উত্তর মহানগর নেতা আব্দুর রহমান, আবুল হোসেন, ওয়াজেদ উদ্দিনসহ ৫ নেতাকে সোমবার গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মহানগর উচ্চপযাের্য়র নেতাদের আটকের কারণে সবর্স্তরে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এদিকে নিবার্চনকে ঘিরে শুধু ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলেই নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলও সংহিসতায় রূপ নিচ্ছে। নিবার্চনী বিরোধের জের ধরে সোমবার রাতে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার নানুপুর কালু মুন্সির হাটে আওয়ামী লীগের দুই গ্রæপের ব্যাপক সংঘষর্ হয়েছে। এতে অন্তত ৭ জন গুলিবিদ্ধ হন। একই রাতে ঝিনাইদহের শৈলকুপায় আওয়ামী লীগের দুই গ্রæপের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলা, অফিস ভাঙচুর ও সংঘষের্র ঘটনা ঘটেছে। এতে বিপুলসংখ্যক নেতাকমীর্ আহত হন। এদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে। এদিকে প্রচার-প্রচারণার শুরুতেই ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদের পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তাতে ভোটের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তা ভয়াবহ রূপ নেবে বলে আশঙ্কা করছেন নিবার্চন পযের্বক্ষকরা। তাদের ভাষ্য, ভোটের মাঠে এখনই যে আলামত দেখা দিয়েছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। এ পরিস্থিতিতে নিবার্চন কমিশনের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা আরও জোরদার করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন তারা। অন্যদিকে ভোটের মাঠে নিরপেক্ষ সাধারণ ভোটারদের মাঝে যে উৎসাহ-উদ্দীপনায় যে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে তা সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নিশ্চিত হওয়া গেছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে ঢাকার বিভিন্ন আসনে প্রাথীের্দর সঙ্গে দলীয় নেতাকমীের্দর পাশাপাশি বেশকিছু ভাড়াটে লোকজন দেখা গেছে। যাদের একটি বড় অংশ রিকশাচালক ও ফুটপাতের হকারসহ বিভিন্ন শ্রম-পেশার সঙ্গে জড়িত। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা দৈনিক ৫শ’ থেকে ৭শ’ টাকার বিনিময়ে মিছিলে অংশ নেয়া ও পোস্টার লাগানোর চুক্তিতে কাজ করছে। মঙ্গলবার ঢাকা-৯ আসনের আওয়ামী দলীয় প্রাথীর্ সাবের হোসেন চৌধুরীর বিশাল মিছিলে নেতাকমীের্দর সরব উপস্থিতি থাকলেও সাধারণ সমথর্কদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। এ ব্যাপারে সবুজবাগ এলাকার বাসিন্দা মুদি দোকানি মজনু মিয়ার ভাষ্য, সহিংসতার আশঙ্কায় তার মতো নৌকার অনেক সমথর্ক এখনো মিছিল-সমাবেশে যোগ দেয়নি। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে তাদেরও ভোটের মাঠে ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে কাজ করার আগ্রহ রয়েছে বলে জানান তিনি। একই ধরনের আশঙ্কার কথা জানিয়ে ঢাকা-৮ আসনের তরুণ ভোটার সাইফুল আলম বলেন, ‘প্রচার-প্রচারণার শুরুতেই যেভাবে হামলা-ভাঙচুর-সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, তাতে ভোটের আনন্দ উপভোগ করার সাহস পাচ্ছি না। বরং এসব দেখে অনেকেই ভীত হয়ে পড়েছে।’ আগামীতে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা আরও কতটা ভয়াবহ রূপ নেবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা কী হবেÑ এসব পযাের্লাচনা করেই ভোটের দিন কেন্দ্রে যাবেন বলে জানান এ তরুণ শিক্ষাথীর্।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে