শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
একাদশ সংসদ নিবার্চন

ভোটের পালে শীতল হাওয়া!

ইসির ভূমিকায় আস্থা সংকটে সাধারণ ভোটাররা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে সংশয়ে বিরোধীরা একতরফা ভোটে সংঘাত সহিংসতার শঙ্কা
সাখাওয়াত হোসেন
  ১৮ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

‘গতবারের মতো এবারো ভোট হইবো আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগে। বিএনপি নেতারা ভোটে খাড়াইলেও তারা তো ভোটারগো কাছে ভোট চাওয়ারই সুযোগ পাইবো না। কেউ বেশি ফালাফালি করলে মামলা দিয়্যা জেলে ঢুকাইয়া দিবো। তাই ভোট দিতে গ্যালেই কি, আর না গ্যালেই কি। এখন আর কেউ আগের মতো ভোট নিয়ে মাতামাতি করে না।’- এভাবেই নিবার্চন নিয়ে নিজের ভাবনার কথা জানান রাজধানীর মিরপুর এলাকার ভোটার রিকশাচালক খালেক মিয়া।

অনেকটা একই সুরে ভোট নিয়ে অনাগ্রহের কথা জানান গামের্ন্টসকমীর্ সুরুজ, বাসচালক সামাদ ও বেসরকারি চাকরিজীবী বিপ্লব বড়–য়া। তাদের ভাষ্য, শেষ সময়ে এসে বিএনপি ভোটে অংশ নেয়ার কথা জানালেও শেষ পযর্ন্ত তারা ভোটের মাঠে টিকতে পারবে কিনাÑ তা নিয়ে সন্দিহান নিজেরাই। যে কারণে নিবার্চনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়ার মাত্র দুদিনের মাথায় নিবার্চনী পরিবেশ নিশ্চিত হবে কিনা তা নিয়ে খোদ দলের মহাসচিব মিজার্ ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংশয় প্রকাশ করেছেন। এ পরিস্থিতিতে নিবার্চনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত পুনবিের্বচনা করা হতে পারে বলেও তিনি জানান দিয়েছেন।

সাধারণ ভোটারদের ভাষ্য, ঢাকা-চট্টগ্রাম-বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বিএনপির সক্রিয় নেতারা হয় জেলখানায়, না হয় ঘরছাড়া। সম্ভাব্য প্রাথীের্দর অনেকের কাধেই একাধিক মামলার বোঝা, কেউবা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সব মিলিয়ে এ নাজুক পরিস্থিতিতে বিএনপিকে অনেকটা নামকাওয়াস্তে নিবার্চনে অংশ নিতে হচ্ছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই জনগণের নিবার্চনী উচ্ছ¡াস মিইয়ে গেছে বলে মনে করেন তারা।

তাদের এ অনুমান যে অমূলক নয়, তা ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকার সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, এলাকার ছোটখাটো ক্লাব কিংবা সমিতির ভোটাভোটিতে যতটা উচ্ছ¡াস থাকে, এবারের জাতীয় নিবার্চন নিয়ে কারো মধ্যে ততটা উদ্দীপনাও নেই। ভোট দিতে যাবেন কিনা, জানতে চাইলে সিরাজুল ইসলাম অনেকটা নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘দেখি ভোটের দিন কী হয়! তয় ঝামেলা হওনের আলামত দ্যাখলে আমি নাই।’

নিবার্চনী লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি ও ভোটকেন্দ্রিক দুনীির্ত মোকাবেলায় ইসির ভূমিকা নিয়ে কোনো আস্থার সংকট আছে কিনা- জানতে চাইলে সাধারণ ভোটারদের কেউই এ নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শতের্ একজন প্রবীণ ভোটার বলেন, ‘সাধারণ মানুষের আস্থা-অনাস্থায় ইসির কিছু যায়-আসে বলে তো মনে হয় না। তাই এ নিয়ে আলোচনা করার কিছু আছে বলে মনে করি না।’

এদিকে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীতে নিবার্চনের আবহ বা প্রভাব রাজধানীর অন্য এলাকাগুলোর তুলনায় একেবারেই নেই বললেই চলে। বনানী এলাকায় চায়ের দোকানি মেরাজ উদ্দিন বলেন, নিবার্চনে মানুষের মধ্যে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকার কথা, এবার তা নেই। প্রতিবারই ‘চায়ের কাপে ঝড়’ উঠলেও এবার মোটেও সেটা নেই। তবে আরো কিছুদিন পর পরিস্থিতি কিছুটা ঘুরতে পারে বলে আশা করেন তিনি।

দীঘির্দন এই এলাকায় বসবাসকারী মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সম্ভাব্য প্রাথীর্ ও তাদের সমথের্করা নিবার্চনের দুই আড়াই মাস আগে থেকেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চান। এবার এটা দেখা যায়নি।’

গুলশান-১ নম্বর গোল চত্বর এলাকার ব্যবসায়ী আবু সায়হাম জানান, এ আসনে নিবার্চনী তৎপরতা এখন পযর্ন্ত শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন দলের সম্ভাব্য প্রাথীের্দর ব্যানার-পোস্টারেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে তাদের কেউই এখনো ভোট চাইতে কারো কাছে যাননি।

উত্তরার দলিপাড়া এলাকার বাসিন্দা ফরিদা ইসলাম বলেন, ‘আগে যেভাবে নিবার্চনে আনন্দ-ফুতির্ থাকত, এবার সেটা পাচ্ছি না। তাই ভোট দেব কিনা, এখনো জানি না।’ উত্তরা এলাকার বেশ কয়েকজন ভোটার জানালেন, সেখানে নিবার্চনী প্রচার-প্রচারণা এখনো জমেনি। আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য কয়েকজন প্রাথীর্ ছোটখাটো কিছু উঠান বৈঠক করেছেন। তবে সম্ভাব্য প্রাথীর্রা কেউ আগের মতো ভোট চাইতে মাঠে নামেনি।

জুরাইন এলাকার ভোটার মারুফ খন্দকার জানান, তাদের এলাকায় নিবার্চন নিয়ে ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ না থাকলেও সম্ভাব্য প্রাথীের্দর মধ্যে উত্তেজনার কমতি নেই। বেশ কয়েকজন প্রাথীর্র সমথর্কদের মধ্যে নিবার্চনী তফসিল ঘোষণার আগ থেকেই টান টান উত্তেজনা রয়েছে।

গেন্ডারিয়া এলাকার ইকবাল হোসেন বলেন, প্রাথীর্র সমথর্কদের উত্তেজনা সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকলেও তো নিবার্চন জমজমাট হতো। এই ব্যবসায়ী বললেন, ‘বুঝেন, কেমন নিবার্চন হচ্ছে! শক্তি কার বেশি, সেটাই দেখানোর চেষ্টা করছে নিজেরা নিজেরাই।’ নিবার্চনের দিন বাসায় থাকবেন বলেও জানান তিনি।

রাজধানীর গোড়ান এলাকার বাসিন্দা আহসান হাবিব জানান, তার এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রাথীর্ সাবের হোসেন চৌধুরী অন্তত দশবার নিবার্চনী উঠান বৈঠক করেছেন। অথচ এ আসনের বিএনপি কিংবা অন্য কোনো দলের প্রাথীর্র এখনো কোনো দেখা মেলেনি। এমনকি কে প্রাথীর্ হচ্ছেন তা-ও ভোটাররা অনেকে জানেন না। এ পরিস্থিতিতে ভোটকেন্দ্রিক উদ্দীপনা না থাকারই কথা- যোগ করেন তিনি।

এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, শুধু একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চন ঘিরেই ভোটারদের উদ্দীপনায় ভাটা পড়েনি; এ ধারা বেশ আগে থেকেই চলমান রয়েছে। নিবার্চন ব্যবস্থার ওপর অনাস্থা এবং অসুস্থ রাজনীতির কারণে বিগত সময়ে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নিবার্চনেও সাধারণ ভোটারের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়নি বলে মন্তব্য করেন তারা।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোশের্দ হাসান খান যায়যায়দিনকে বলেন, ‘এ দেশের মানুষের কাছে নিবার্চন মানে এক ধরনের উৎসব। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে মানুষ নিবার্চনী প্রচারণায় অংশ নেয়। এবারও তফসিল ঘোষণার পর দেশের মানুষের একটি অংশের মধ্যে অতি উৎসবের জোয়ার বইতে শুরু করেছে। কিন্তু অন্য পক্ষকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। ফলে ভোটের সময় এ দেশের মানুষ যেভাবে ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে মাঠে নামে এবার সে পরিবেশ সৃষ্টির সম্ভাবনা খুবই কম। একপক্ষকে মামলা- হামলার মুখে রেখে অন্যপক্ষ এক হাতে তালি বাজানোর চেষ্টা করলে তা শেষ পযর্ন্ত সহিংসতার পথে যেতে পারে। যা কারো কাছেই কাম্য নয়। তবে এর চেয়ে বড় সমস্যা হলো ক্ষমতাসীন দলের মধ্যকার অন্তদ্বর্›দ্ব। এরই মধ্যে তাদের শক্তি প্রদশের্নর ঘটনায় জীবনহানীর ঘটনা ঘটেছে। এটা সবচেয়ে উদ্বেগের। এভাবে চলতে থাকলে ভোটের উৎসবে আনন্দ নাও থাকতে পারে। তবে সরকার যদি সকলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে আন্তরিক হয় তবে হয়তোবা সে আনন্দ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। কিন্তু তাদের আন্তরিকতা নিয়ে সবার মধ্যেই প্রশ্ন রয়েছে।’

অনেকটা একই সুরে সাবেক প্রধান নিবার্চন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা বলেন, নিবার্চন ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরেয়ে আনতে পারলে ভোটাররা আবার হয়তো ভোট কেন্দ্রে যাবেন। তিনি বলেন, ভোটার যখন নিজের ভোট দেয়ার পর ভোটটি সঠিকভাবে ভোট বাক্সে পড়েছে কিনা বা ভোটটি গণনা করা হবে কিনা তার মধ্যে এ ধরনের সংশয় কাজ করে তখন সেই ভোটার কেন ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে আসবে। আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে দিনে দিনে ভোটাররা ভোট দানে আগ্রহ আরও হারিয়ে ফেলবে বলে মনে করেন তিনি।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘রাজনীতির প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে এক রকমের উদাসীনতা জাতিগতভাবে আমাদের পেয়ে বসেছে। যার প্রভাব পড়ছে নিবার্চনে। ভোট মানুষের অধিকার। অথচ এখন একজন ভোটার মনে করেন আমার ভোট দিয়ে কি লাভ। নিজের কাজ ফেলে ভোট দিতে গিয়ে দেখা যায় বরং ক্ষতি। আমি যাকে ভোট দিচ্ছি তার প্রভাব তো ফলাফলে পড়ছে না। নিবার্চনে যে প্রাথীর্রা আছে তাদের কাউকেই হয়তো ভোটাররা পছন্দ করছেন না। এ রকম একাধিক কারণে ভোটাররা নিবার্চনবিমুখ হয়ে পড়ছেন। তিনি মনে করেন, আস্থা জিনিসটি এমন এটি জোর করে জনগণের মধ্যে আনা যাবে না। এজন্য গণতান্ত্রিক রাজনীতির চচার্ করতে হবে। সুস্থ রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই।

এদিকে ভোটের মাঠে উৎসবমুখর পরিবেশ না থাকার কারণ হিসেবে সুধীজনরা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কোণঠাসা দশার পাশাপাশি বিগত স্থানীয় সরকারের নিবার্চনগুলোর সহিংসতাপূণর্ পরিবেশকে দায়ী করেছেন। তাদের ভাষ্য, ভোট এখন অবিশ্বাসের জায়গায় চলে গেছে। সবাই হয়তো ভাবে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখবে তার ভোট দেয়া হয়ে গেছে। যেহেতু বিগত নিবার্চনগুলো খারাপ হয়েছে, সেহেতু একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চন সুষ্ঠ হবে কিনা তা নিয়ে মানুষ সংশয়ে রয়েছে।

তাদের শঙ্কা, মনোনয়নপত্র কেনা নিয়ে বিএনপিতে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হলেও তা সহসাই মিইয়ে যাবে। বিশেষ করে নিবার্চনী প্রচার-প্রচারণা চালাতে গেলেই তারা নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হবে। এ পরিস্থিতিতে তাদের ভিন্নপথে হঁাটারও আশঙ্কা রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<23005 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1