বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাত খুন নিয়ে প্রশ্নের পাহাড়

নিহতরা দুধর্ষর্ অপরাধী না হওয়ায় ভিন্ন সন্দেহ নিহতদের ফঁাড়িতে থাকার প্রমাণ খেঁাজা হচ্ছে কন্ট্রাক্ট কিলিং কিনা তা নিয়ে শঙ্কা অনেকের পুলিশের আস্থাহীনতার প্রভাব পড়বে ভোটে
সাখাওয়াত হোসেন
  ২৪ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০
রূপগঞ্জে নিহত মাইক্রোবাস চালক লুৎফর মোল্লার মরদেহের পাশে স্ত্রী রেশমা বেগমের আহাজারি Ñফাইল ছবি

গত ১৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে উপজেলার পূবার্চল উপশহরে তিন যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের মাত্র পঁাচ সপ্তাহের ব্যবধানে একই জেলার আড়াইহাজারে আরও চার ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনায় সারাদেশের সবর্স্তরের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক ছড়িয়েছে। খুনের আগে তাদের গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে আটকে রাখার অভিযোগ থাকায় জনমনে নানামুখী প্রশ্নের পাহাড় জমেছে। নিহতদের কেউই বড় মাপের চিহ্নিত অপরাধী কিংবা সন্ত্রাসী না হওয়ায় এ নিয়ে ভিন্ন সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনো আগের তিন খুনের ঘটনাসহ সাত খুনের ঘটনার কোনো ক্লু উদ্ঘাটন করতে না পারায় খোদ সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। বিভিন্ন মহলে পুলিশ বাহিনীর কতর্ব্যনিষ্ঠা ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে ঘুরেফিরে নারায়ণগঞ্জই কেন এ ধরনের হত্যাকাÐের ‘সেফ জোন’ হিসেবে গড়ে উঠেছে, স্থানীয়দের কাছে তা বড় জিজ্ঞাসা হয়ে দঁাড়িয়েছে। এর নেপথ্য রহস্য খুঁজতে শীষর্ প্রশাসনের দ্রæত নজর দেয়া জরুরি বলে স্থানীয়রা দাবি করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শতের্ নারায়ণগঞ্জের একাধিক জনপ্রতিনিধি যায়যায়দিনকে বলেন, মাত্র ৩৬ দিনের ব্যবধানে একই জেলার দুটি স্পটে ৭ গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের ঘটনায় স্থানীয়দের মাঝে চরম ভীতি ছড়িয়েছে। বিশেষ করে এদের কেউই দুধর্ষর্ কোনো অপরাধী না হওয়ায় তারা ব্যক্তিগত বিরোধের জের ধরে ‘কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ের’ শিকার হয়েছেন কিনা সে প্রশ্ন বড় হয়ে দঁাড়িয়েছে।

জনপ্রতিনিধিদের ভাষ্য, গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে অপহরণ এবং পরবতীের্ত এদের কাউকে কাউকে পুলিশ হেফাজতে থাকার অভিযোগের মুখে ‘কন্ট্রাক্ট কিলিং’ এর প্রশ্ন ওঠায় গোটা বিষয়টি নিয়ে জটিলতা রূপ নিয়েছে।

এদিকে নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সম্প্রতি গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে থাকার ঘটনায় প্রসাশনেও উদ্বেগ বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊধ্বর্তন

কমর্কতাের্দর শঙ্কা, বিশেষ কোনো দুবৃর্ত্ত চক্র নিজেদের স্বাথর্ হাসিলে পুলিশের সুনাম ক্ষুণœ করে এ ধরনের

অপতৎপরতা চালাচ্ছে। যা দ্রæত চিহ্নিত করে সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ জনসম্মুখে উপস্থাপন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে এ ধরনের অপতৎপরতার দায় বারবার ঘুরেফিরে পুলিশ বাহিনীর ঘাড়েই চাপবে বলে মনে করেন তারা।

তবে ভিকটিম পরিবারের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে অপহরণ ও গুপ্ত হত্যার অভিযোগ উঠলে কখনো তা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করা হচ্ছে না। ফলে এ ধরনের ঘটনা বরাবরই ধেঁায়াশা থেকে যায়। সংঘবদ্ধ দুবৃর্ত্তরাও এ ধরনের কিছু ঘটনা ঘটালেও পুলিশও সন্দেহের তালিকার পুরোপুরি বাইরে নয় বলে মনে করেন তারা।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি পদমযার্দার একজন কমর্কতার্ জানান, গত ২২ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার পঁাচরুখী এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশ থেকে বাসচালক ফারুক হোসেনের লাশ উদ্ধারের পর তার স্ত্রী তাসলিমা তাকে আগের রাতে ভুলতা ফঁাড়িতে দেখার যে অভিযোগ তুলেছেন তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হবে। এছাড়া ফারুকসহ অন্যদের সেখানে দেখার কথা যে বাস মালিক দাবি করেছেন, তাকেও খুঁজবে গোয়েন্দারা। তাদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে সুনিদির্ষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রয়োজনে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। অন্যদিকে নিহত ব্যক্তিরা কোনো অপরাধী সিন্ডিকেটের সদস্য কিনা, তাদের বিরুদ্ধে কোথাও মামলা আছে কিনা এবং কোনো কিছু নিয়ে তাদের কারও সঙ্গে বিরোধ ছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

পুলিশ সদর দপ্তরের ওই দায়িত্বশীল কমর্কতার্র ভাষ্য, ফারুকসহ চারজন শনিবার ভুলতা ফঁাড়িতে আটকে রাখা হলে তা অনেকেই জানবে। যা তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে। এ ধরনের একটি ঘটনা গোপন রাখা কঠিন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

তবে আদৌও এসব অপতৎপরতার সুষ্ঠু তদন্ত হবে কি-না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। তাদের ভাষ্য, এ ধরনের গুপ্তহত্যা, ক্রসফায়ারের পরিবতির্ত রূপ। যা তদন্ত করে বের করা কঠিন। অতীতেও এ ধরনের ঘটনার তথ্য-প্রমাণ খুঁজে দোষী ব্যক্তিদের সাজা দেয়ার কোনো নজির নেই।

অন্যদিকে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব গুপ্তহত্যার ঘটনা যেভাবেই ঘটুক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায় এড়াতে পারে না। এছাড়া এ নিয়ে মানুষের মনে যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে, পুলিশকেই তা দূর করতে হবে। তা না হলে এর দায় সরকারের ঘাড়েই পড়বে। কেননা দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারেরই।

সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নিবার্হী পরিচালক সুলতানা কামাল গুপ্তহত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, গুপ্তহত্যার শিকার ব্যক্তিদের স্বজনরা এ জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়ী করছেন। সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে দেশের জনগণের জন্য এটা খুবই উদ্বেগের। আর যদি রাষ্ট্র এর সঙ্গে জড়িত না থাকে, তাহলে যারা করছে, তাদের কেন শনাক্ত করা হচ্ছে না?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নেহাল করিম যায়যায়দিনকে বলেন, ‘একটি দেশের পুলিশি ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করবে তা নিভর্র করে সে দেশের প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন কতৃর্পক্ষের ওপর। এখন দেখতে হবে এদেশের রাজনৈতিক কতৃর্পক্ষ কীভাবে পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করছে। একথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, পুলিশই দেশের মানুষের নিরাপত্তার প্রধান দায়িত্ব পালন করে থাকে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, পুলিশকে রাজনৈতিক কতৃর্পক্ষ জনগণের বন্ধু হিসেবে গড়ে না তুলে দলীয় লোকের মতো করে ব্যবহার করতেই বেশি আগ্রহী। পুলিশের নাম করে কয়েকদিন পরপর তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যার যেসব ঘটনা ঘটছে তা দুঃখজনক। এটি সাধারণ মানুষকে পুলিশের বিরুদ্ধে দঁাড় করাবে। এটা কাম্য নয়। এছাড়া নিবার্চন এগিয়ে আসায় এর একটি স্পষ্ট প্রভাব সেখানে পড়তে পারে। কারণ এই যেসব পুলিশের বিরুদ্ধে এসব অসৎ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠছে এই পুলিশই নিবার্চনে দায়িত্ব পালন করবে। ফলে তাদের ওপর একটি বিশ্বস্ততা নিয়ে সাধারণ জনগণ কতটা স্বাচ্ছন্দ্যে নিবার্চন কেন্দ্রে যেতে পারবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। সরকারের উচিত পুলিশকে জনগণের বন্ধু হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করা। তা না হলে এ বাহিনীর কতিপয় সদস্যের অনিয়মের জন্য পুরো পুলিশবাহিনীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক প্রফেসর ড. ওবায়দুল ইসলাম সাম্প্রতিক গুম খুনের বিষয়ে যায়যায়দিনকে বলেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে আমাদের পুলিশ বাহিনীর মতো একটি কল্যাণকর বাহিনীর বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ উঠছে। কিছু তথ্য-প্রমাণ বলে এর কিছু সত্যতাও রয়েছে। সত্য বিষয় বলতে গেলে, রাষ্ট্র যখন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে সরে আসে তখন যাদের ব্যবহার করে অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয় তাদের মধ্যে এমন একটি ভাব জন্মে যে আমরা যা খুশি তাই করতে পারি। ফলে তারা অনিয়ম অনাচারে জড়িয়ে পড়তে সাহস পায়। এতে করে কিছু মানুষ তাদের নিজেদের স্বাথর্ উদ্ধারের জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নাম ব্যবহার করে খারাপ কাজে জড়ানোর সাহস দেখায়। যার প্রভাব শুধু জাতীয় নিবার্চনে নয় সব স্তরেই পড়তে পারে। এ জন্য সরকারসহ রাষ্ট্রের সব অঙ্গেরই উচিত পুলিশের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উঠলে তা সঠিকভাবে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। তা না হলে এর প্রভাব খুবই খারাপ হতে পারে।’

প্রসঙ্গত, গত ১৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের পূবার্চল উপশহরের তিনশ ফিট সড়কের ১১ নম্বর ব্রিজের নিচ থেকে পুলিশ তিন যুবকের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ উদ্ধার করে। প্রথমে তাদের অজ্ঞাত দেখানো হলেও পরে স্বজনরা তাদের লাশ শনাক্ত করে। তারা জানান, নিহত সোহাগ ভুইয়া, শিমুল আজাদ ও নূর হোসেন ওরফে বাবু তিনজনই ঝুট (গামেের্ন্টসের টুকরা কাপড়) ব্যবসা করতো। ১২ সেপ্টেম্বর তারা আজাদের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদাহ যাওয়ার পথে মাওয়া ফেরিঘাট পার হওয়ার পর ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাদের যাত্রীবাহি বাস থেকে নামিয়ে অপহরণ করা হয়। এরপর থেকে তারা নিখেঁাজ ছিল।

এদিকে ২২ অক্টোবর আড়াইহাজারে মহাসড়কের পাশ থেকে যে চার যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়, তাদের মধ্যে বাসচালক ফারুকসহ তিনজনকে ১৯ অক্টোবর ডিবি পুলিশ পরিচয়ে একই বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে স্বজনরা অভিযোগ করেন। বাকি আরেক জনের বাসা রামপুরায় হলেও তাকে কোথা থেকে কে বা কারা তুলে নিয়ে হত্যা করেছে তা তার স্বজনরা জানাতে পারেননি। তবে ওই ব্যক্তির স্ত্রী জানিয়েছেন, তার স্বামী লুৎফর মাইক্রোবাস চালাতেন। তিনি শুক্রবার ঢাকা মেডিকেলের কয়েকজন চিকিৎসককে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। এরপর থেকে তিনি নিখেঁাজ ছিলেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<19114 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1