শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তপ্ত কমর্সূচিতে বিএনপির ‘না’

২৯ অক্টোবর শান্তিপূণর্ প্রতিবাদের পরিকল্পনা হাইকমান্ডের কঠোর কমর্সূচি দিলে গণহারে ধরপাকড় চালানোর আশঙ্কা দায়সারা আন্দোলনে ফের হতাশ তৃণমূলের নেতাকমীর্রা শান্তিপূণর্ কমর্সূচিতে জনসমথর্ন বেড়েছে, দাবি নেতাদের
সাখাওয়াত হোসেন
  ১৯ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০
আপডেট  : ১৯ অক্টোবর ২০১৮, ১১:০৮

তৃণমূলের নেতাকমীের্দর জোরাল তাগিদ থাকলেও সহসা কোনো উত্তপ্ত কমর্সূচি দিচ্ছে না বিএনপি। এমনকি জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলায় দলের শীষর্ নেতাদের সাজা হওয়ার বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত হলেও ২৯ অক্টোবর রায় ঘোষণার দিনও শান্তিপূণর্ কমর্সূচির মধ্য দিয়ে এর প্রতিবাদ জানাতে চায় সরকারবিরোধী এই দলটি। দলের নীতিনিধার্রকরা এ বিষয়টি সরাসরি স্বীকার না করলেও তৃণমূলের নেতাকমীের্দর সঙ্গে কথা বলে এ ধারণা পাওয়া গেছে। জানা গেছে, আন্দোলনের মাঠে র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীর কঠোর অবস্থান এবং ক্ষমতাসীন দলের মারমুখী ভ‚মিকার কারণে বিএনপির আপাতত উত্তপ্ত কমর্সূচি থেকে সরে থাকাটাই সমুচিন বলে মনে করছেন দলের নীতিনিধার্রকদের অনেকেই। তাদের ভাষ্য, এখনই আন্দোলনের মাঠে শক্তি অপচয় করলে নিবার্চনকেন্দ্রিক আন্দোলনে সক্রিয় কমীর্ পাওয়া বাস্তবিক অথের্ই কঠিন হবে। নিবার্চনী প্রচার-প্রচারণাতেও নানামুখী সংকট দেখা দেবে। এমনকি ভোটের দিন পোলিং এজেন্ট জোগাড় করা কঠিন হয়ে দঁাড়াবে। এ ব্যাপারে বিএনপির শীষর্ নেতাদের যুক্তি, তারা যে কোনো ইস্যুতে এখন কঠোর কোনো কমর্সূচিতে নামলেই সরকার গণহারে সক্রিয় নেতাকমীের্দর ধরপাকড়ে তৎপর হয়ে উঠবে। তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক গায়েবি মামলা দেয়া হবে। যা দলের নেতাকমীের্দর ঘরছাড়া করে তুলবে বলে আশঙ্কা করছেন দলীয় নীতিনিধার্রকরা। যদিও এখনই কঠোর কমর্সূচি না দেয়ার ব্যাপারে মাঠপযাের্য়র নেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃণমূলের একাধিক নেতা জানান, দলের নেতাকমীর্রা দীঘির্দন কোণঠাসা থাকায় তাদের অনেকেই রাজনীতিতে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। আর যারা কোনোভাবে এতদিন মাঠে টিকে আছেন, তারাও এখন নানা প্রতিবন্ধকতায় আগের মতো হুট করে ততোটা চাঙা হতে পারছেন না। তাই আগের অবস্থানে ফিরতে তারাও কিছুটা সময় নিচ্ছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় কেন্দ্র থেকে জোরাল কমর্সূচি দেয়া হলেও আশানুরূপভাবে নেতাকমীর্রা মাঠে না নামায় অনেকের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে আক্ষেপ প্রকাশ করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের থানাপযাের্য়র একজন নেতা যায়যায়দিনকে বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় প্রত্যাখ্যান করে দলীয় হাইকমান্ড বিক্ষোভ সমাবেশ ও কালো পতাকা মিছিলসহ সাতদিনের কমর্সূচি দিয়েছে। এরইমধ্যে ১৩ অক্টোবর ছাত্রদল, ১৪ অক্টোবর যুবদল এবং ১৫ অক্টোবর স্বেচ্ছাসেবক দল দেশব্যাপী বিক্ষোভ কমর্সূচি পালন করেছে। অথচ রাজধানীসহ দেশের কোথাও এই আন্দোলন কোনো সাড়া ফেলতে পারেনি। হাতেগোনা কয়েকটি জেলায় এই কমর্সূচি কোনোভাবে পালন করা হয়েছে। যা তৃণমূল কমীের্দর চাঙা করার পরিবতের্ উল্টো হতাশ করেছে। তাই আটঘাট না বেঁধে এ ধরনের কমর্সূচি দেয়ার কোনো মানে হয় না বলে মন্তব্য করেন মাঠপযাের্য়র ওই নেতা। তার এই বক্তব্য যে একেবারে অমূলক নয়, দলের প্রথমসারির নেতারাও তা পরোক্ষভাবে স্বীকার করেছেন। এ প্রসঙ্গে আক্ষেপ করে জেলাপযাের্য়র একজন নেতা যায়যায়দিনকে বলেন, যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের তিনদিনের বিক্ষোভ কমর্সূচির খবর অধিকাংশ জাতীয় পত্রিকার প্রথম পাতায় স্থান পায়নি। বেশ কয়েকটি পত্রিকার ভেতরের পাতাতেও এই কমর্সূচির কোনো খবরের ঠঁাই মেলেনি। যা দলের নেতাকমীের্দর মনোবল আরও দুবর্ল করেছে। তাই এ ধরনের দায়সারা কমর্সূচি দিয়ে তৃণমূলকমীের্দর হতাশ না করাই শ্রেয় বলে মন্তব্য করেন দলের দায়িত্বশীল ওই নেতা। এ ব্যাপারে একমত পোষণ করে দলের অপর একজন সিনিয়র নেতা বলেন, ‘বিক্ষোভ কমর্সূচি দিয়ে রাজপথে জড়ো হতে না পারলে এ ধরনের আন্দোলনের ডাক দিয়ে কি লাভ? এর চেয়ে মানববন্ধনের মতো শান্তিপূণর্ কমর্সূচি দেয়াও অনেক ভালো। অন্ততঃ এতে দলের বতর্মান অবস্থান যে এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী, সেটা প্রমাণ করা যায়। এতে দলের নেতাকমীের্দর মনোবল বাড়ে।’ তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য এ ব্যাপারে পুরোপুরি ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, তাদের এ ধরনের আন্দোলন কমর্সূচিতে দৃশ্যত কোনো সফলতা না এলেও এর মধ্য দিয়ে তারা ব্যাপক জনসমথর্ন অজর্ন করেছেন। যা পুঁজি করে তারা ধাপে ধাপে কঠোর আন্দোলনের দিকে যাবেন। নিবার্চনের ঠিক আগ মুহ‚তের্ শুরু হবে ‘চ‚ড়ান্ত আন্দোলন’। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেন, এখন পযর্ন্ত বিএনপির চলমান আন্দোলনের বড় সফলতা হচ্ছে জনসমথর্ন আদায়। বিএনপির মূল দাবি, নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে নিবার্চন; এই দাবিতে তারা জনমত গড়তে পেরেছেন বলে তিনি দাবি করেন। তার ভাষ্য, সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এখন নিবার্চনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করছে। প্রথম দিকে বিএনপির কমর্সূচিতে সাধারণ মানুষের সাড়া কম থাকলেও এখন বিপুলসংখ্যক নেতাকমীর্র সঙ্গে সাধারণ মানুষও কমর্সূচিতে অংশ নিচ্ছে। বিএনপির অন্যতম এই নীতিনিধার্রক বলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো আন্দোলনই বিফল হয়নি। তবে বিএনপির একটি দুবর্লতা আছে; সেটি হলো, বিএনপি কমর্সূচি দেয়ার ক্ষেত্রে জনদুভোের্গর কথা চিন্তা করে। আমাদের অনেক নেতাকমীর্ও বলেন, কেন আমরা কঠোর কমর্সূচি দিচ্ছি না। আমরা কঠোর কমর্সূচিতে যাওয়ার আগে সরকারকে শেষ সুযোগ দিতে চাই।’ দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন মনে করেন, তাদের আন্দোলন শতভাগ সফল। তিনি বলেন, এখন নিভৃত গ্রামের চায়ের দোকানেও সরকারের দুনীির্ত, দুঃশাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে কথা হচ্ছে। বিরোধী দলের আন্দোলনের কারণেই মানুষ এসব বিষয়ে সচেতন হয়েছে। মানুষ যে জেনেছে, এটাই বিএনপির সফলতা। তিনি বলেন, বিএনপি সচেতনভাবেই হরতালের মতো ধ্বংসাত্মক কমর্সূচি এড়িয়ে নতুন নতুন ধারার কমর্সূচি দিয়েছে। আর এর মধ্য দিয়েই তারা সরকারকে চাপে ফেলতে সক্ষম হবেন বলেও মনে করেন তিনি। এদিকে বিএনপির শীষর্ নেতারা মনে করেন, তারা কঠোর কোনো কমর্সূচি দিলেই আওয়ামী লীগ নানা ধরনের নাশকতার ঘটনা ঘটিয়ে তার দায় বিএনপির ঘাড়ে চাপাবে। যার ইঙ্গিত ক্ষমতাসীন দলের শীষর্স্থানীয় নেতাদের বক্তব্যেই স্পষ্ট। এ প্রসঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মিজার্ ফখরুল ইসলাম আলম বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারছি না, সরকার কেন নাশকতার আশঙ্কা করছে। মনে হচ্ছে, তারাই নাশকতা সৃষ্টি করে এর দায়দায়িত্ব বিএনপির ওপর চাপাবে। সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্যেই সেটা বোঝা যাচ্ছে।’ তিনি এই অপপ্রচারে কান না দিতে দেশবাসীর প্রতি আহŸান জানান। প্রসঙ্গত, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণার আগের দিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আন্দোলনের নামে বিএনপি বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু ২০১৪ সালের মতো আর কিছু করা সম্ভব হবে না। জনগণ তাদের সেই অপচেষ্টা রুখে দেবে। এর আগে গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে কেন্দ্রীয় ১৪ দল আয়োজিত ‘বিএনপির অব্যাহত মিথ্যাচার ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে’ শীষর্ক এক কমীর্-সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, নিবার্চনকে সামনে রেখে আন্দোলনের নামে আবার নাশকতা হতে পারে। এ ব্যাপারে দলীয় নেতাকমীের্দর সতকর্ করে দিয়ে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের নামে রেললাইন তুলে ফেলার চেষ্টা করবে, পাহারা দিতে হবে যেন তারা তা করতে না পারে। সন্ত্রাসী কাযর্কলাপ যারা করবে, তাদের ধরিয়ে দিতে হবে, প্রতিহত করতে হবে।’ রাজনৈতিক পযের্বক্ষকরা মনে করেন, ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব ও মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে বিএনপি যে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছে, তা মূলতঃ আগামী নিবার্চনের সময় নিরপেক্ষ সরকার গঠন, নিবার্চনটি সবার জন্য অন্তভুির্ক্তমূলক ও সুষ্ঠু করার দাবি নিয়ে জনসমাবেশ ও মানববন্ধনের মতো শীতল আন্দোলন কমর্সূচি চালিয়ে যাওয়ার জন্য। এর নেপথ্যে উত্তপ্ত আন্দোলনের যে কোনো লক্ষ্য নেই, তা অনেকটাই স্পষ্ট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে