মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
কিংবদন্তির প্রস্থান

থেমে গেল আইয়ুব বাচ্চুর রুপালি গিটারের মূছর্না

চার দশক এ দেশের তরুণদের গিটারের মূছর্নায় মাতিয়ে রাখা রকস্টারের বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। গিটার বাদনে তার খ্যাতি ছিল পুরো ভারতীয় উপমহাদেশেই
যাযাদি রিপোটর্
  ১৯ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০
আইয়ুব বাচ্চু (১৬ আগস্ট ১৯৬২-১৮ অক্টোবর ২০১৮)

‘এই রুপালি গিটার ফেলে/একদিন চলে যাব দূরে, বহুদূরে/ সেদিন অশ্রæ তুমি রেখো/গোপন করে।’ নিজের লেখা গানের কথার মতো নিজেই রুপালি গিটার ফেলে চলে গেলেন বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতকে এগিয়ে নেয়ার অন্যতম অগ্রপথিক আইয়ুব বাচ্চু। বৃহস্পতিবার সকালে তাকে অচেতন অবস্থায় ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হলে কতর্ব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ব্যান্ডদল এলআরবির লিড গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং প্লে-ব্যাক শিল্পী। চার দশক বাংলাদেশের তরুণদের গিটারের মূছর্নায় মাতিয়ে রাখা রকস্টারের বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। গিটার বাদনে তার খ্যাতি ছিল পুরো ভারতীয় উপমহাদেশেই। আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে ‘ফেরারী এই মনটা আমার’, ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘একদিন ঘুমভাঙা শহরে’, ‘চল বদলে যাই’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘হাসতে দেখ গাইতে দেখ’র মতো বহু গান শ্রোতাদের হৃদয়ে বাজবে বহুদিন। সকালে তার মৃত্যুর খবরে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। ভক্ত শ্রোতাদের পাশাপাশি সংগীত জগতের অনেকেই ছুটে আসেন হাসপাতালে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং সৌদি আরবে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই শিল্পীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। আরও শোক প্রকাশ করেছেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম রওশন এরশাদ, বিএনপি মহাসচিব মিজার্ ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকে। ফেসবুকে এক পোস্টে কলকাতার শিল্পী অঞ্জন দত্ত লিখেছেনÑ ‘টেরিবল লস... আইয়ুব বাচ্চু...’। এলআরবির সদস্য শামিম বলেন, বাচ্চু বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। হৃদরোগের কারণে সপ্তাহ দুই আগেও একবার তাকে হাসপাতালে ভতির্ হতে হয়েছিল। মগবাজারের বাসায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সকালে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। স্কয়ার হাসপাতালের মেডিকেল সাভিের্সর পরিচালক মিজার্ নাজিমউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘সকালে উনার হাটর্ অ্যাটাক হয়। সকাল সোয়া ৯টার দিকে তার ড্রাইভার তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এর আগেই তার মৃত্যু হয়।’ গত ১৬ আগস্ট নিজের জন্মদিনে আইয়ুব বাচ্চু এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, চার দশকের সংগীত জীবনে তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি শ্রোতাদের উ”চ্ছ¡াস, মানুষের ভালোবাসা। বলেছিলেন একটি আত্মজীবনী লেখার পরিকল্পনার কথা। ‘ঈদের পর কাজটা শুরু করব। ঢাকা ছেড়ে কোথাও চলে যাব যেখানে কোনো ফোন থাকবে না, ইন্টারনেট থাকবে না। নদীর মাছ খাব, ভাত খাব, পানি খাবÑ এমন জায়গায় চলে যাব। লেখার কাজ শেষ করে ঢাকায় ফিরব।’ নানা উত্থান-পতন পেরিয়ে জীবনের এই পযাের্য় এসে জীবন নিয়ে এই শিল্পীর উপলব্ধি জানতে চাইলে বাচ্চু সেদিন বলেছিলেন, বহুদূর যেতে হবে। এখনো পথের অনেকটা বাকি। ‘লাভ রানস বøাইন্ড’ আইয়ুব বাচ্চুর ডাক নাম রবিন। জন্ম ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট, চট্টগ্রামে। সেখানেই কেটেছে কৈশোর আর তারুণ্যের দিনগুলো। এক সাক্ষাৎকারে বাচ্চু বলেছিলেন, ছেলে বেলায় গান শুনতে শুনতে নিজে চেষ্টা করতে গিয়েই তার গায়ক হয়ে ওঠা। পশ্চিমা সংগীতের প্রেমে পড়ে হাত দেন গিটারে। জিমি হেন্ডরিক্স, জো স্যাটরিনি, স্টিভ মুরের মতো শিল্পীদের কাছ থেকে পেয়েছেন অনুপ্রেরণা। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে বাচ্চু গড়ে তোলেন একটি ব্যান্ডদল। শুরুতে ‘গোল্ডেন বয়েজ’ নাম দিলেও পরে বদলে রাখা হয় ‘আগলি বয়েজ’। পাড়া-মহল্লার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে চলত তাদের পরিবেশনা। পেশাদার ব্যান্ডশিল্পী হিসেবে বাচ্চুর ক্যারিয়ার শুরু ১৯৭৮ সালে। ব্যান্ড দলে ‘ফিলিংস’ এর সঙ্গে সে সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে পারফমর্ করতেন তিনি। দুই বছরের মাথায় যোগ দেন জনপ্রিয় ব্যান্ড দল সোলসে। টানা ১০ বছর সোলসের লিড গিটার বাজানোর পর ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল আইয়ুব বাচ্চু গড়ে তোলেন নতুন ব্যান্ড এলআরবি। সে সময় তার সঙ্গী ছিলেন জয়, স্বপন আর এসআই টুটুল। শুরুতে এলআরবির পুরো নামটি ছিল ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’, পরে তা বদলে নাম হয় ‘লাভ রানস বøাইন্ড’। এলআরবির প্রথম কনসাটর্ হয়েছিল ঢাকার একটি ক্লাবে। সেখানে ইংরেজি গানই পরিবেশন করেছিলেন তারা। কিছুদিন পর ঢাকার শিশু একাডেমিতে এক কনসাটের্ প্রথমবারের মতো ক্লাব বা হোটেলের বাইরে দশর্কদের সামনে আসে এলআরবি। ১৯৯২ সালে দলের নামেই বাজারে আসে এলআরবির জোড়া অ্যালবাম এলআরবি-১ ও ২। এরপর গত ২৭ বছরে সুখ, তবুও, ঘুমন্ত শহরে, স্বপ্ন, ফেরারী মন, বিস্ময়, যুদ্ধ, স্পশর্সহ ১৪টি অ্যালবাম শ্রোতাদের সামনে এনেছে এলআরবি। আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্ত গোলাপ’ বাজারে আসে ১৯৮৬ সালে। তখনও তিনি সোলসে। প্রথম অ্যালবাম খুব একটা সাড়া না পেলেও ১৯৮৮ সালে ‘ময়না’ অ্যালবামে গায়ক হিসেবে বাচ্চু শ্রোতাপ্রিয় হতে শুরু করেন। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত বাচ্চুর তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’ দারুণ ব্যবসা সফল হয়। পরের বছরগুলোতে ‘সময়’, ‘একা’, ‘প্রেম তুমি কি’, ‘কাফেলা’, ‘পথের গান’, ‘জীবন’, ‘রিমঝিম বৃষ্টি’, ‘বলিনি কখনো’র মতো একক অ্যালবাম নিয়ে শ্রোতাদের কাছে পেঁৗছেন আইয়ুব বাচ্চু। ২০১৫ সালে বাজারে আসে তার একক অ্যালবাম ‘জীবনের গল্প’। এছাড়া লাল বাদশা, গুন্ডা নাম্বার ওয়ান, ব্যাচেলর ও চোরাবালি সিনেমায় প্লে-ব্যাক করেছেন বাচ্চু। চলচ্চিত্রে তার গাওয়া প্রথম গানÑ ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ দারুণ জনপ্রিয় হয়। আজ ঢাকার জাতীয় ঈদগাহে জানাজা কাল চট্টগ্রামে দাফন ব্যান্ডতারকা আইয়ুব বাচ্চুর জানাজা আজ বাদ জুমা ঢাকার জাতীয় ঈদগাহে অনুষ্ঠিত হবে। আইয়ুব বাচ্চুর প্রতি সবর্সাধারণের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আজ সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পযর্ন্ত তার মরদেহ রাখা হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ নেয়া হবে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে। সেখানে জানাজা শেষে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ নেয়া হবে চট্টগ্রামের পৈতৃক নিবাসে। সেখানে শনিবার মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন আইয়ুব বাচ্চু। জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সকালে শরীর খারাপ লাগলে আইয়ুব বাচ্চুর ব্যক্তিগত গাড়িচালক তাকে নিয়ে স্কয়ার হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেন। গাড়িতে তোলার সময়ই তার মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছিল। সকাল সোয়া ৯টার দিকে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসকরা জানান, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যু হয়েছে। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সকাল সোয়া ৯টার দিকে তিনি মারা যান। স্কয়ার হাসপাতালের মেডিকেল ডিরেক্টর ডা. মিজার্ নাজিম উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, জরুরি বিভাগে কাডির্য়াক কনসালট্যান্ট মুনসুর মাহবুবের উপস্থিতিতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট ধরে আইয়ুব বাচ্চুর হৃৎস্পন্দন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু শেষ পযর্ন্ত সেই চেষ্টা ব্যথর্ হয়। সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে আইয়ুব বাচ্চুকে মৃত ঘোষণা করা হয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মিজার্ নাজিমুদ্দিন বলেন, ‘আমরা আইয়ুব বাচ্চুকে মৃত অবস্থাতেই পাই। তার পরও আমাদের স্পেশাল টিম তাকে ফিরিয়ে আনার সব রকমের চেষ্টা করে। তিনি বহুদিন ধরে হৃদ?রোগে ভুগছিলেন। তার হাটের্ কাডিের্য়ামাইপ্যাথি ছিল। ২০০৯ সালে তার হাটের্ একটি স্টেন্ট পরানো হয়।’ মিজার্ নাজিমুদ্দিন জানান, তিন সপ্তাহ আগে আইয়ুব বাচ্চু স্কয়ার হাসপাতালে ভতির্ হয়েছিলেন। তার হৃদ্যন্ত্রের কাযর্কারিতা ছিল ৩০ শতাংশ, যেখানে একজন সুস্থ মানুষের থাকে ৭০ শতাংশ। এ জন্যই বারবার তাকে হাসপাতালে ভতির্ হতে হতো। হাটের্র কাযর্কারিতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে তার মুখ থেকে পানির মতো ফেনা বের হচ্ছিল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে