বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নীরব ভোটে জয়ের আশা বিএনপির

সাখাওয়াত হোসেন
  ১৭ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০
আপডেট  : ১৭ অক্টোবর ২০১৮, ০০:১১

মামলা-হামলা, গ্রেপ্তার-হয়রানিসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় নেতাকমীর্রা এখনো নিবার্চনী প্রচার-প্রচারণার মাঠে নামতে সাহস না পেলেও নীরব ভোটে নিরুঙ্কুশ জয়ের আশা করছে বিএনপি। তাই বড় ধরনের কোনো আন্দোলনে না গিয়ে সরকারকে নানা ধরনের চাপে রেখে সুষ্ঠু নিবার্চনী পরিবেশ নিশ্চিত করতে চাইছে সরকারবিরোধী বৃহত্তম এ দলটি। পাশাপাশি জাল ভোট, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, কেন্দ্র দখল ও নিবার্চনী ফল কারচুপিসহ নিবার্চন কেন্দ্রিক আনুষঙ্গিক অনিয়ম ঠেকাতেই মূল শক্তি প্রয়োগের কৌশলী ছক কষছে দলীয় হাইকমান্ড। দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান, গত কয়েক মাস ধরে বিএনপির সক্রিয় নেতাকমীের্দর বিরুদ্ধে একের পর এক ‘গায়েবী মামলা’ দিয়ে তাদের দৌড়ের উপর রাখা হয়েছে। এর উপর তারা কঠোর কোনো আন্দোলনে নামলে এ অপকৌশলে নতুন গতি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি তারা নিবার্চনী প্রচার-প্রচারণায় নামলে সংশ্লিষ্ট নেতাকমীের্দর উপর নানা ধরনের হয়রানি-নিযার্তনের খড়গ নেমে আসতে পারে। তাই আগেভাগেই জোরালো আন্দোলন কিংবা তোড়জোড় প্রচার-প্রচারণায় নেমে সাংগঠনিক শক্তি কোনোভাবে ক্ষয় না করে তা সরাসরি ভোটের দিন কাজে লাগানোর চিন্তা-ভাবনা করছেন দলের শীষর্ নেতারা। দলের নীতি-নিধার্রকদের দাবি, নিবার্চনের মাঠে নেতাকমীর্রা সোচ্চার না হলেও তারা গোপনে নিবার্চনী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। নিরপেক্ষ-নীরব ভোটারদের সিংহভাগই তাদের পাশে রয়েছে। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তারা প্রকাশ্য লড়াইয়ে না নামলেও গোপন ব্যালটে দঁাতভাঙা জবাব দেবে। ভোট ডাকাতি বা ফল কারচুপি না হলে অধিকাংশ আসনের বিজয় ঘুরেফিরে বিএনপির-ই ঘরে আসবে বলে আশাবাদী দলীয় হাইকমান্ড। তৃণমূলের নেতাকমীের্দর ভাষ্য, পুলিশি হয়রানি ও ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের ভয়ে জাতীয় একাদশ সংসদ নিবার্চনের সম্ভাব্য প্রাথীর্রাই জোরেশোরে প্রচার-প্রচারণার মাঠে নামতে ভয় পাচ্ছেন। মামলা-হামলার অজানা আতঙ্কে তাদের ঘনিষ্টজন, পরিবারের সদস্যরাও এ কমর্যজ্ঞ থেকে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন। এমনকি ভাড়াটে কমীর্রাও তাদের পক্ষে কাজ করতে চাচ্ছেন না। এ অবস্থায় ভোটের বাতার্ নিয়ে মাঠে নামার চেয়ে নিবার্চনী সুষ্ঠু পরিবেশের ক্ষেত্র তৈরির দিকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য কেন্দ্র থেকে তৃণমূলকে পরামশর্ দেয়া হয়েছে। দলের শীষর্ নেতারা মনে করেন, খুলনা, গাজীপুর, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নিবার্চনে তাদের পরাজয়ের প্রধান কারণ ছিল ভোটের দিন দলীয় নেতাকমীের্দর মাঠে টিকে থাকতে না পারা। বিশেষ করে এ চার সিটি করপোরেশনের সিংহভাগ কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট নিয়োগের ব্যথর্তা আওয়ামী দলীয় প্রাথীর্র পক্ষে ভোট ডাকাতির বড় সুযোগ এনে দিয়েছে বলে মনে করেন তারা। কেন্দ্রীয় নেতাদের আশঙ্কা, এখন থেকে তারা নিবার্চনী প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি বড় ধরনের কোনো আন্দোলনে নামলে সরকার আগের মতোই সক্রিয় নেতাকমীের্দর ঢালাওভাবে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরবে। এতে ভোটের দিন বিএনপি দলীয় প্রাথীর্র পক্ষে পোলিং এজেন্ট যোগাড় করা কঠিন হয়ে দঁাড়াবে। এ সুযোগে আওয়ামী দলীয় প্রাথীর্ সিটি করপোরেশন নিবার্চনের মতো অবাধে ভোট ডাকাতির সুযোগ পাবে বলে মনে করেন দায়িত্বশীল ওই নেতারা। এদিকে তাদের এ আশঙ্কা অমূলক নয় বলে মনে করেন রাজনৈতিক পযের্বক্ষকরা। তাদের ভাষ্য, দলটির মূল শক্তি হচ্ছে নীরব ভোটাররা। এরা আওয়ামী লীগের নেতাকমীের্দর মতো রাজপথ কঁাপাতে পারে না। তবে কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ পেলে তারা নিবিের্ঘœ ‘ভোটবিপ্লব’ ঘটিয়ে দিতে পারে। যা অতীতের বিভিন্ন নিবার্চনের ফলাফল পযাের্লাচনা করলেই বিএনপির এই শক্তি সম্পকের্ আন্দাজ করা যাবে। তবে এই শক্তি কাজে লাগাতে চাইলে বিএনপিকে আরো জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক পযের্বক্ষকরা। তাদের পরামশর্- অনলাইন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপির উল্লেখযোগ্য কোনো তৎপরতা নেই। অথচ দেশের চার কোটি তরুণ ভোটারের সিংহভাগ এখন ইন্টারনেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দলটির শক্ত অবস্থান গড়তে হবে। যেসব ইস্যুতে জনগণের আগ্রহ আছে, সেসব ইস্যু নিয়ে কাজ করতে হবে। বিএনপি যে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় আছে, তা সহিংস আন্দোলন ছাড়াই জনগণকে বোঝাতে হবে। নিবার্চন পযের্বক্ষকরা মনে করেন, মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। জাতীয় নিবার্চনে প্রচার-প্রচারণার বিষয় জরুরি হলেও তা মুখ্য নয়। কারণ ভোটাররা সবাই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পকের্ ওয়াকিবহাল। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নিবার্চনী প্রচারণার সুযোগ কতটা আছে তা-ও কারো অজানা নেই। তাই ভোটাররা ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেবে। অন্যদিকে সচেতন ভোটাররা মনে করেন, এবার জাতীয় নিবার্চনে প্রাথীর্র ব্যক্তি ইমেজ বড় কোনো ফ্যাক্টর হবে না। বরং রাজনৈতিক দলগুলোর অতীত কমর্কাÐ বিশ্লেষণ করেই ব্যালটে সিল মারবে। তবে এককভাবে কোনো দল নিরঙ্কুশ বিজয় অজর্ন করবে, নাকি ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে তা ভাগাভাগি হবে সে সম্পকের্ কোনো ধারণা দিতে পারেননি তারা। তাদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- দু’দলেরই নেতাকমীর্ প্রায় সমানে সমান। তাই নিরপেক্ষ নীরব সমথর্কদের ভোট যেদিকে ঝুঁকবে, সে দলই বিজয়ী হবে। যদিও শেষ পযর্ন্ত নীরব ভোটাররা এবার জাতীয় নিবার্চনে প্রভাব ফেলতে পারবে কিনা তা নিয়েও সন্দিহান তারা। তাদের ধারণা, আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার ছক কষে দীঘির্দন ধরে নানা তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। তাই হুট করে বিএনপির পক্ষে নিবার্চনের মাঠ দখল কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সাংগঠনিক অবস্থা নড়বড়ে হলেও সারাদেশে তাদের একটি বিরাট ভোট ব্যাংক রয়েছে। সুষ্টু পরিবেশে ভোট হলে তা জাতীয় নিবার্চনে অনেক বড় প্রভাব ফেলবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেই সুষ্টু নিবার্চন হবে কিনা? আমরা এখন এমন এক দেশে বাস করছি, যেখানে দেশের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম স্থানীয় সরকার নিবার্চন ইউনিয়ন পরিষদ নিবার্চনে কয়েকশ’ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে- এ সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বড়। তবে আশ্চযের্র বিষয় হলো- যারা শত শত মানুষকে হত্যা করেছে তারা বহাল তবিয়তে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের নামে ভুক্তভোগী কেউ মামলা করবে এতটুকু সাহসও কারো নেই। জাতীয় নিবার্চনে যেহেতু কেন্দ্রের সরকার বদল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেহেতু খুনের সাটিির্ফকেট পাওয়া এসব গডফাদাররা নিশ্চয়ই ঘরে বসে থাকবে না!’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যদি একটু পত্রপত্রিকায় নজর রাখি তাহলে দেখা যাবে বিরোধী দলের ২৫ থেকে ৩০ লাখ নেতাকে বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়েছে। বিদেশে রয়েছে, মৃত্যুবরণ করেছে এমন বিরোধী নেতারাও গায়েবি মামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এর উদ্দেশ্য একটাই। সুষ্টু নিবার্চনের পথ বঁাধাগ্রস্থ করা। তবে জাতীয় নিবার্চনে যেনতেনভাবেও যদি জনগণ ভোট দেয়ার সুযোগ পায় তবে তা ক্ষমতাসীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলবে। এর কারণ একটাই। আর তা হলো জনগণ বিরক্ত। তারা পরিবতর্ন চায়। এ কারণে সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ পেলে বিরোধীরা যে দাবি করছে জনগণ তাদের পক্ষে নীরব ভোট বিপ্লব ঘটাবে তা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’ এদিকে নীরব ভোটে জয়ের আস্থা থাকলেও নিবার্চনী প্রচার-প্রচারণা এবং কঠোর আন্দোলন থেকে সরে থাকার কথা অস্বীকার করেছে বিএনপি হাইকমান্ড। তাদের ভাষ্য, নিবার্চনী আইন ভেঙে তারা দলীয় প্রাথীর্র ব্যানার-পোস্টারের রাস্তাঘাটের আশপাশের বাণিজ্যিক ভবন, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা বাসাবাড়ির দেয়াল ঢেকে দিচ্ছে না। তবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিবার্চনী মাঠে সবোর্চ্চ তৎপর রয়েছে। নিবার্চনকালীন সরকার এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিসহ ভোটের মাঠের আনুষঙ্গিক পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার দাবিতে কঠোর আন্দোলনের জোরদার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা দাবি করেন তারা। এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যায়যায়দিনকে বলেন, সুষ্ঠু নিবার্চন হলে বতর্মান সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিএনপির ঐতিহাসিক ভোট-বিপ্লব ঘটবে। কোনো ষড়যন্ত্র করে ধানের শীষকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। ভোটে কারচুপি হলে দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি তা কঠোর হাতে দমন করবে বলেও হুশিয়ার করেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে