বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিবার্চনী বছরে দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়বে

কালো টাকার অপব্যবহার ও পাচারের শঙ্কা সরকারি ও বেসরকারি উভয়খাতেই ব্যয় বাড়বে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আন্তজাির্তক বাজারে পণ্যের দাম ঊধ্বর্মুখী
আহমেদ তোফায়েল
  ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

আন্তজাির্তক বাজারে পণ্যের দাম ঊধ্বর্মুখী থাকায় মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে অথর্নীতিবিদরা শুধু আন্তজাির্তক পণ্যমূল্যকে দায়ী করছেন না। তারা বলছেন, নিবার্চনকালীন কালো টাকার অপব্যবহার ও পাচারের কারণে দেশের মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, ২০১৮-১৯ অথর্বছরে সরকারের নিধাির্রত মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ ধরা হলেও পণ্যের দামের ঊধ্বর্গতির কারণে তা বেড়ে ৬ থেকে ৭ এর কোটায় উঠতে পারে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছর পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের কারণে আন্তজাির্তক পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক পূবার্ভাস দিয়ে বলেছে, এই বছর বিদ্যুতের দাম ১৯ শতাংশ বাড়তে পারে। এর মধ্যে সংযুক্ত রয়েছে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের দামও। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ভ‚রাজনৈতিক সতকর্তার কারণে ওপেক ও নন-ওপেক তেল সরবরাহকারী দেশগুলোতে তেলের চাহিদা বেড়ে যাওয়া ও উৎপাদন কমে যাওয়ায় তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার আশংকা। ফলে বাড়বে দেশের মূল্যস্থিতি।

তবে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে। গত আগস্ট মাসে মাসওয়ারি ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ, যা আগের মাসের চেয়ে কিছুটা কম। গত জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংকের বাজারমূল্য অনুযায়ী, আন্তজাির্তকভাবে পণ্যমূল্য বাড়ছে। তাদের প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগস্টে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ দশমিক ১৩ ডলার। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে আগস্ট পযর্ন্ত ৯ ডলার বেড়েছে। চালের প্রতি টনের দাম ২ ডলার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯১ ডলার। গমের দাম প্রতি টনে ৪৫ ডলার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৭ ডলার। তবে গত আগস্ট পযর্ন্ত সয়াবিন তেলের দাম টনপ্রতি ১১৩ ডলার কমে ৬৫৩ ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে।

এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের অথর্নীতিবিদ ড. জাহিদ হাসান মনে করেন, ‘নিবার্চনী বছরে সরকারি ও বেসরকারি উভয়খাতেই ব্যয় বেড়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের গড় ব্যয়ও বাড়বে। তার কাছে মনে হচ্ছে, ঠিক এ কারণেই মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, দেশে একই সময়ে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স আয় কমে যাবে। ফলে টাকা ও ডলারের বিনিময় হারের পাথর্ক্য বেড়ে যেতে পারে। ড. জাহিদ আরও বলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক হয়তো স্থানীয় মূদ্রার মূল্যহ্রাসের কথা ভাবছে। এর ফলে ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, আন্তজাির্তক বাজারে তেলের দামও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর অথৈর্নতিক কড়াকড়ি আরোপের ফলে এই প্রভাবটা সারাবিশ্বে পড়বে। ফলে আঘাত আসবে মূল্যস্ফিতির ওপর।

এদিকে চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি থাকায় চাপে আছে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার। চাহিদা মেটাতে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র বলছে, টাকা এবং ডলারের বিনিয়ম হারের বড় ব্যবধানও মূল্যস্থিতি বাড়ার কারণ হতে পারে। গত আগস্টের শেষ পযর্ন্ত টাকা ও ডলারের বিনিয়ময় ছিলো ৪ শতাংশের কাছাকাছি। তারা আরও বলছেন, এই এক্সচেঞ্জ রেটের ব্যবধান আরও হতে পারে যদি রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় প্রত্যাশার চেয়ে আরও কম হয়।

এদিকে ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রনে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অথর্বছরের শুরু থেকে গতকাল পযর্ন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১১ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। গত অথর্বছর বিক্রি করা হয় আরও ২৩১ কোটি ডলার। এরপরও গত এক বছরে ডলারের দর ৪ শতাংশ বেড়ে ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সায় উঠেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজাভর্ কমে এখন ৩২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।

এদিকে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমেই বাড়ছে। অথর্বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১৭ কোটি ৩০ লাখ ডলারের। এ মাসে আমদানি বাবদ ৪৭০ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। অন্যদিকে রপ্তানি হয়েছে ৩৫২ কোটি ৭০ লাখ ডলারের। গত ২০১৭-১৮ অথর্বছরের প্রথম মাসে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১০৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা গেছে, রপ্তানি আয়েও কাক্সিক্ষত গতি আসছে না। আবার বাণিজ্য ঘাটতির পাশাপাশি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সেও কাক্সিক্ষত গতি আসছে না। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। আবার আমদানিজনিত চাপে দেশের ভেতরে বেড়েছে ডলারের চাহিদা। ফলে চাহিদার তুলনায় ডলারের জোগান কমে গেছে। এ কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন ঘটছে। এক বছরের ব্যবধানে প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় চার টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গ্রাহক পযাের্য় বতর্মানে প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সায়। রেমিট্যান্স আরও কমলে ডলারের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন আরও বাড়বে। এতে রপ্তানি আয়ের ওপর চাপ পড়বে আরও বেশি। নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মূল্যস্থিতির ওপর।

এছাড়া চলতি ২০১৮ সালকে বলা হচ্ছে নিবার্চনী বছর। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে এই বছরের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় নিবার্চন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। আর নিবার্চনের বছর মানেই অথর্ পাচারের বছর। কারণ অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে নিবার্চন ঘনিয়ে এলেই দেশ থেকে মুদ্রা পাচারের পরিমাণ বেড়ে যায়। বেড়ে যায় ডলারের মূল্যমানও। কারণ এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ী মনে করে, নিবার্চনে কোন দল সরকার গঠন করবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। নিবাির্চত সরকার যদি তাদের সমথির্ত সরকার না হয়, তাহলেই বিপদ। তাই নিজেদের অজির্ত অবৈধ অথর্ তারা দেশ থেকে পাচার করে দেয়া শুরু করে। বিশেষ যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তাদের সমথর্ক গোষ্ঠী এই অথর্ পাচারে বেশি জড়িত বলে মনে করা হয়।

এ প্রসঙ্গে স্বয়ং অথর্মন্ত্রী আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন, এ বছর মুদ্রা পাচারের ঘটনা ঘটতে পারে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, কটন আমদানির নামে মুদ্রা পাচারের ঘটনা ঘটছে। জানুয়ারি মাসে অথর্নীতি নিয়ে তাদের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘চলতি অথর্বছর জুলাই-ডিসেম্বর প্রান্তিকে কটন আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭৫ ভাগ। এটি একটি চিন্তার বিষয়। কারণ যে হারে কটন আমদানি হয়েছে সে হারে তা তৈরি পোশাক খাতে অবদান রাখেনি। এ ক্ষেত্রে দেখতে হবে কটন আমদানির নামে মুদ্রা পাচার হচ্ছে কি না।

বাংলাদেশের আরেক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিচাসর্ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নিবার্হী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর গণমাধ্যমকে বলেছেন, দেশ থেকে প্রচুর অথর্ পাচার হচ্ছে। তার নজির ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এই অথর্ পাচারের ঘটনাটি ঘটছে আমদানি-রফতানি মাধ্যমে, যেটি করা হয় ওভার ইনভয়েস ও আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে। নিবার্চন সামনে রেখে এই পাচার আরো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যার প্রভাব পড়বে মূল্যস্থিতির ওপর।

বিবিএসের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, গত আগস্ট মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। আবার খাদ্যবহিভূর্ত খাতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে। আগস্ট মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। জুলাই মাসে এই হার ছিল ৬ দশমিক ১৮ শতাংশ। আগস্ট মাসে খাদ্যবহিভূর্ত খাতে এ হার ছিল ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর জুলাই মাসে এই খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ। বিবিএস বলছে, আগস্ট মাসে গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি ছিল। আগস্ট মাসে শহরে সাবির্ক মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ, আর গ্রামে এ হার ছিল ৫ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<13610 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1