শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনায় সংকট বাড়ছে গ্রামেও

প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ রাজধানী ছেড়ে গ্রামে ফিরে গেছে বলে জরিপে এসেছে। কিন্তু গ্রামে মানুষ কীভাবে থাকবে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার কতটুকু ব্যবস্থা আছে। এসব নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও কারও কাছে এর সদুত্তর নেই
হাসান মোলস্না
  ০৯ জুলাই ২০২০, ০০:০০

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের থাবায় আয় কম ও কাজ হারিয়ে রাজধানীর অসংখ্য নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ রাজধানী ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছেন। কেউ সপরিবারে আবার কেউ স্ত্রী-সন্তানকে পাঠিয়ে শুধু নিজে রয়ে গেছেন ঢাকায়। ফলে প্রামীণ জনপদে কর্মসংস্থান হারিয়ে ঘরেফেরা মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। কিন্তু জীবিকার কোনো উৎস না থাকায় গ্রাম ছেড়ে একদিন রাজধানীতে আসা মানুষের চাপ গ্রামগুলো কতটুকু নিতে পারবে তা কেউই ভাবেনি। পাশাপাশি করোনা সংক্রামণও গ্রামগুলোতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবমিলে গ্রামে আয়ের কোনো ব্যবস্থা না থাকার সঙ্গে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, শিক্ষাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণ নিয়ে সংকট শুধু বাড়ছেই।

করোনার করাল গ্রাসে অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত। কোনোটি এখনো বন্ধ, কোনোটি চালু হলেও হয়েছে অনেক ছোট পরিসরে। ফলে অনেক কর্মীকেই চাকরি হারাতে হয়েছে বা হচ্ছে। ছোটখাটো ব্যবসা করতেন এমন অনেকে গত তিন মাসের লোকসান সামলে উঠতে পারছেন না। তাদের বড় একটা অংশ শহর ছেড়ে যাচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ২ হাজার ৩৭১ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে সম্প্রতি ব্র্যাক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে দেখা যায়, ৩৬ শতাংশ লোক চাকরি বা কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। ৩ শতাংশ লোক চাকরি থাকলেও বেতন পাননি। আর দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে যারা কাজ করেন, তাদের ৬২ ভাগই কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। করোনার কারণে ১০টি জেলার মানুষের আয় কমে গেছে। ঢাকা জেলার মানুষের আয় কমেছে ৬০ ভাগ। এই পরিসংখ্যানের বাইরে বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের বিভিন্ন জরিপে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ রাজধানী ছেড়ে গ্রামে ফিরে গেছেন বলে সামনে এসেছে। কিন্তু গ্রামে মানুষ কিভাবে থাকবেন। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার কতটুকু ব্যবস্থা আছে। এসব নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও কারো কাছে এর সদুত্তর নেই।

স্থায়ীভাবে বিভিন্ন গ্রামে থাকা মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামে এরই মধ্যে সংকট শুরু হয়ে গেছে। ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবে শহর ছেড়ে অস্থায়ীভাবে মানুষের গ্রামে যাওয়ার বিষয়টি ছিল অন্যরকম। কিন্তু স্থায়ীভাবে অসংখ্য মানুষ গ্রামে আসায় নানামুখী নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আয়ের উৎস। শহরে থাকা মানুষ আগে গ্রামে অর্থ পাঠালে তা দিয়ে গ্রামের পরিবার চলত। এখন বলতে গেলে কারো কোনো আয় নেই। গ্রামে ব্যয় কম হলেও একেবারে আয় ছাড়া চলা সম্ভব নয়। আর তেমন কোনো কাজও নেই যাতে সংসার চলতে পারে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জনপদের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি। এরপরই রয়েছে প্রবাসী আয়। যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় অর্ধেক মানুষ। প্রবাসী আয় বাড়লে এবং ফসলের ভালো উৎপাদন হলে অর্থপ্রবাহ বাড়ে। চাঙা হয় গ্রামীণ অর্থনীতি। কিন্তু করোনায় চরম বিপাকে পড়েছেন গ্রামাঞ্চলের কৃষক থেকে শুরু করে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘদিন উপার্জন বন্ধ থাকায় তাদের সঞ্চিত অর্থ কমে আসছে। এছাড়া গ্রামীণ জনপদে মানুষের অর্থের প্রধান উৎস ধান ও চাল বিক্রি। এই টাকায় বেশিরভাগ চাহিদা পূরণ হয় তাদের। সেই ধান ও চাল কেনায় সরকারি কার্যক্রমে ধীরগতি বিরাজ করছে। ফলে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে গ্রামাঞ্চলে। আর যারা কৃষির পাশাপাশি মৌসুমি ব্যবসা করতেন তাদের হাতেও পুঁজি নেই। যার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালু হলেও সাপস্নাই চেইনের সঙ্গে জড়িত মানুষের অংশগ্রহণ কমে গেছে। অর্থ সরবরাহ কম থাকায় গ্রামের বাজারগুলোতে বেচাকেনাও অনেক কমে গেছে। এছাড়া করোনা মহামারির কারণে প্রবাসী শ্রমিকরা কর্মসংস্থান হারিয়ে দেশে ফিরছেন অনেকে। আর এর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে গ্রামে।

জানা যায়, করোনাভাইরাসের চলমান প্রভাবে মানুষ গ্রামমুখী হওয়ায় নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন সাধারণ কৃষক। সরকার ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখলেও এর সুফল পান না তারা। দ্বারে দ্বারে ঘুরে ঘুরে এক সময় হতাশ হয়ে পড়েন অধিকাংশ কৃষক। এই কারণেই করোনাকালে কৃষকের জন্য দেওয়া ভর্তুকি এবং ঋণ সহায়তা যাতে তারা সময়মতো পান তা নিশ্চিত করার কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জরিপ বলছে, করোনার কারণে দেশের ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। বিশেষ করে অস্থায়ী কিংবা খন্ডকালীন কর্মসংস্থানের সঙ্গে নিয়োজিত নাগরিকরা এই ঝুঁকিতে পড়েছেন। তবে ২০১৬-১৭ শ্রমশক্তি জরিপের উপাত্ত পর্যালোচনা করে এ প্রাক্কলন করা হয়েছে। বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিলে কর্ম হারানোর ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকের সংখ্যা আরও বাড়বে। এসব চাকরি হারানো মানুষ গ্রামমুখী হচ্ছেন। তাতে গ্রামে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে। এর আগে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের জরিপে করোনার কারণে দেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। তাই শহরের মতো গ্রামেও কর্মহীন লোকের সংখ্যা বাড়ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিপিডি গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সিপিডির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকারের ধান ও চাল কেনা কার্যক্রম উন্মুক্ত স্থানে করতে হবে। যাতে কৃষকদের শহরে এসে ধান বিক্রির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। ধান কেনার এই প্রক্রিয়া থেকেও সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে। ধান কেনার জন্য কৃষকের কাছে যেতে হবে। সেই সঙ্গে ধান না কিনলে চাল কেনা যাবে না এই ঘোষণা দিতে হবে। তাতে ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হবে, কৃষকও লাভবান হবেন।

এই গবেষক আরও বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালু হওয়ার পর সাপস্নাই চেইনে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। আগে যে পরিমাণে মানুষ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের সংখ্যা কমছে। কারণ তাদের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। প্রস্তাবিত বাজেটে গ্রামীণ জনপদের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ২ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ তহবিল গঠনের কথা বলা হয়েছে। এই ঋণ সুবিধা কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হবে। গ্রামে সাধারণত সিজনাল ফসল উৎপাদন হয়। তাই সঠিক সময়ে এই ঋণ সুবিধা কৃষকের কাছে না পৌঁছালে কোনো লাভ হবে না।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি খাতে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া গ্রামের মৌসুমি ব্যবসায়ীদের জন্য ২ হাজার কোটি টাকার ঋণ তহবিল তৈরিরও ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এসব ভর্তুকি ও ঋণের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলে এই করোনা সংকটে কৃষকের দুর্দশা অনেকাংশে লাঘব হবে। এছাড়া কর্মহীন হয়ে দেশে ফেরা প্রবাসীদের জন্য সরকার ঘোষিত ঋণ সহায়তা ঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কিছুটা গতি ফিরে আসতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, কোভিড ১৯-এর প্রভাবে বেকারত্বের হার আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় গ্রামীণ নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে বিশেষ নজর দিতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<105285 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1