বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ ব্যাপারে একমত

করোনাভাইরাস বাতাসেও ছড়ায়, দাবি বিশেষজ্ঞদের

যাযাদি ডেস্ক
  ০৯ জুলাই ২০২০, ০০:০০

বিশ্বে প্রতিদিন বেড়ে চলেছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা; পানশালা, রেস্তোরাঁ, অফিস, বিপণিকেন্দ্র ও ক্যাসিনোগুলোতে এ ভাইরাস খুঁজে নিচ্ছে শিকার, বাড়িয়ে তুলছে গুচ্ছ সংক্রমণের শঙ্কা। আর তাতে সেটাই প্রমাণিত হচ্ছে, যা গত কয়েক মাস ধরে বিজ্ঞানীরা বলে আসছিলেন, বদ্ধ ঘরের বাতাসে টিকে থাকে এ ভাইরাস, আশপাশে যাকে পায়, সংক্রমিত করে।

এ ভাইরাস যদি সত্যিই বাতাসে বাহিত হয়ে উলেস্নখযোগ্য মাত্রায় ছড়াতে পারে, বিশেষ করে সেসব জায়গায়, যেখানে অবাধে বাতাস চলাচল নেই, কিন্তু মানুষের সমাগম বেশি, তাহলে ভাইরাস ঠেকানোর পরিকল্পনাতেও ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে।

সেক্ষেত্রে মাস্ক পরতে হবে ঘরের মধ্যেও। সামাজিক দূরত্বের নিয়ম মানার পরও আবদ্ধ জায়গায় মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা দিতে যাওয়ার আগে স্বাস্থ্যকর্মীদের এন৯৫ মাস্ক পরে নিতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নার্সিং হোম, বাসাবাড়ি আর অফিসে এয়ার কন্ডিশনার বা এয়ার কুলারের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে, বসাতে হবে বাতাস বিশুদ্ধ করার শক্তিশালী ফিল্টার। এমনকি ঘরের ভেতরে বাতাসে ভেসে বেড়ানো ভাইরাসবাহী অতিক্ষুদ্র কণাগুলো ধ্বংস করতে অতিবেগুনি রশ্মিও ব্যবহার করতে হতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বরাবরই বলে আসছে, আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি কাশির সময় শ্বাসতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসা ভাইরাল জলকণা থেকেই মূলত এই ভাইরাস ছড়াচ্ছে। তবে অপেক্ষাকৃত বড় কণাগুলো ভারী হওয়ায় দ্রম্নত নিচে পড়ে যায়।

কিন্তু ৩২টি দেশের ২৩৯ জন বিজ্ঞানী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে লেখা এক খোলা চিঠিতে প্রমাণসহ দেখিয়েছেন, বাতাসে ভেসে থাকা একেবারে ক্ষুদ্র ভাইরাসবাহী কণা থেকেও মানুষ আক্রান্ত হতে পারে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে তাদের তথ্য-পরামর্শে হালনাগাদ করার সুপারিশ করেছেন এই বিজ্ঞানীরা। সোমবার তাদের ওই চিঠি ক্লিনিক্যাল ইনফেকশাস ডিজিজেস জার্নালেও প্রকাশ করা হয়েছে।

গত ২৯ জুন প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্যেও বলা হয়েছে, কেবল তখনই এ ভাইরাস বাতাস বাহিত হয়ে সংক্রমণ ঘটাতে পারে যদি ভাইরাল জলকণা বা ড্রপলেটের আকার ৫ মাইক্রনের চেয়ে ছোট হয় (১ মাইক্রন = ১ মিটারের ১ মিলিয়নতম ভাগ)।

আর কেবল তখনই আবদ্ধ পরিবেশে বায়ু চলাচলের সুবিধা বা এন৯৫ মাস্ক পরার কথা ভাবা উচিত বলে মনে করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

মহামারির শুরু থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তাদের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ নির্দেশনায় প্রাথমিক সুরক্ষাবিধি হিসেবে ঘন ঘন হাত ধোয়ার কথা জোরেশোরে বলে আসছে।

অথচ কোনো বস্তুর উপরিতল থেকে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটার প্রমাণ খুব বেশি নেই। (যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কনট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন এখন বলছে, কোনো কিছুর উপরিতল এই ভাইরাস ছড়াতে সামান্য ভূমিকাই রাখে।)

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের বেনেদেত্তা আলেগ্রানজির দাবি, এই ভাইরাস যে বাতাস বাহিত হয়ে ছড়াচ্ছে, তার গ্রহণযোগ্য প্রমাণ নেই।

'গত কয়েক মাস ধরে বারবার বলা হচ্ছে, বাতাসে বাহিত হয়েও এ ভাইরাস থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনার বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় আছে। তবে এর কোনো পোক্ত বা সুস্পষ্ট প্রমাণ এখনো নেই। এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।'

নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, অন্তত ২০ জন বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার তারা নিয়েছে, যাদের মধ্যে এক ডজন গবেষক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক, কেউ কেউ আবার এই সংস্থার গাইড লাইন তৈরির সঙ্গেও যুক্ত, তারা কেউ এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অবস্থানের সঙ্গে একমত নন।

এই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাঁচি বা কাশির সময় বাতাসে ছড়ানো বড় আকারের ভাইরাল কণাই হোক, অথবা ঘরের শেষ মাথা পর্যন্ত ভেসে যেতে পারে- এমন ছোট আকারের কণা, দুইভাবেই বাতাসে ভাসমান করোনাভাইরাস শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে পৌঁছে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।

সিডনিতে ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের এপেডেমিওলজিস্ট ম্যারি-লুইস ম্যাকলস বলেন, 'বাতাসের প্রবাহ আর ভাইরাল কণার আকার নিয়ে এই বিতর্কে আমি হতাশ। যদি আমরা প্রবাহমান বাতাসের প্রভাবের বিষয়টি পর্যালোচনা করতে যাই, তাহলেই হয়ত আমাদের এতদিনের অনেক সিদ্ধান্ত বদলে ফেলতে হবে।'

তিনি বলেন, 'পর্যালোচনা করে দেখার বিষয়টি খুব ভালো একটি আইডিয়া। কিন্তু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের এটা বড় ধরনের ঝাঁকি দেবে।'

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যে বাতাস বাহিত হতে পারে, সে বিষয়টি আমলে নিতে এপ্রিলের গোড়ার দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল ৩৬ জন বিশেষজ্ঞের একটি দল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সে সময় বেশ দ্রম্নতই সাড়া দিয়েছিল, বিজ্ঞানীদের এই দলটির নেতা লিডিয়া মোরস্কাকে আলোচনায় বসার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

লিডিয়া মোরস্কা নিজেও দীর্ঘদিন ধরে পরামর্শক হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু তাদের সঙ্গে সেই আলোচনায় অন্য কয়েকজন বিশেষজ্ঞের বক্তব্য বেশি গুরুত্ব পায়, যারা হাত ধোয়ার ওপরেই জোর দিতে চান। ফলে সুরক্ষা বিধিমালায় কোনো পরিবর্তন সে সময় আনা যায়নি।

মোরস্কা এবং আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ এমন কিছু ঘটনা তুলে ধরেছেন, যেখানে ঘরের বদ্ধ পরিবেশে বেশি লোকসমাগমের স্থানে বাতাসের মাধ্যমেই ভাইরাস ছড়িয়েছিল।

তাদের ভাষ্য, ভাইরাসবাহী জলকণার আকার ছোট না বড়- তা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খামোখাই পার্থক্য তৈরি করছে। কারণ একজন আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশিতে দুই ধরনের ড্রপলেটই বাতাসে ছড়ায়।

ভার্জিনিয়া টেকের বাতাসবাহিত ভাইরাস সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ লিনসে মার বলেন, 'সেই ১৯৪৬ সাল থেকে আমরা জানি, মানুষ কাশলে, এমনকি কথা বললেও বাতাসে অতিক্ষুদ্র জলকণা ছড়াতে পারে'।

বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে সেই জলকণা কালচার করে এখনো করোনাভাইরাসের সংখ্যা বাড়াতে পারেননি। কিন্তু তাতে এটা প্রমাণ হয় না যে, ওই ভাইরাল কণা সংক্রামক নয়।

মার বলেন, এসব গবেষণার বেশির ভাগ নমুনাই এমন সব হাসপাতাল থেকে আসে যেখানে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা বেশ উন্নত, এটা বাতাসে ভাইরাসের পরিমাণকে কমিয়ে দিতে পারে।

'কিন্তু বেশির ভাগ ভবনে বাতাস চলাচলের পরিমাণ অনেক কম থাকে, তাতে ভাইরাস বাতাসে বেশি পরিমাণে ছড়িয়ে থেকে বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।'

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও স্বীকারোক্তি

এদিকে করোনাভাইরাস বাতাসে ছড়াতে পারে, এ কথা অবশেষে স্বীকার করতে যাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এত দিন ধরে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে গুরুত্ব দেয়নি। বাতাসে সম্প্রতি ভাইরাস ছড়ানোর বিষয়টি নিয়ে সংস্থার আনুষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন ২০০ জনের বেশি গবেষক। তারা স্বাস্থ্য সংস্থাকে একটি খোলা চিঠি লেখেন, যাতে জাতিসংঘের এই সংস্থাকে এ ঝুঁকি সম্পর্কে যথাযথ সতর্ক করতে ব্যর্থ বলে অভিযোগ দেওয়া হয়।

চিঠিতে ৩২টি দেশের ২৩৯ জন গবেষক স্বাক্ষর করেন। এরপরই নড়েচড়ে বসেছে সংস্থাটি। তারা স্বীকার করেছে, বাতাসে ক্ষুদ্র কণাগুলো থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ উঠে আসছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, ভিড়ের মধ্যে, আবদ্ধ পরিবেশে বা যেখানে আলোবাতাস কম ঢোকে, সেখানকার বাতাস থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর বিষয়টি এড়ানো যায় না। এর প্রমাণের বিষয়ে যদি নিশ্চিত হওয়া যায়, তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে আবদ্ধ জায়গায় (ইনডোর) চলাচলে নীতিমালা জারি করা হতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে এত দিন বলা হচ্ছিল, সংক্রমিত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকে যে মিহি জলকণা বা ড্রপলেটস ছড়ায়, সেখানে থেকে শুধু ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে। তবে গবেষকরা বলে আসছেন, একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, শ্বাসপ্রশ্বাসের ড্রপলেটের ক্ষুদ্র সংস্করণ বা অ্যারোসল কণা দীর্ঘ সময় বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। এটি কয়েক মিটার পর্যন্ত ভেসে যেতে পারে। এটি যেসব ঘরে আলো-বাতাস কম বা বাসসহ অন্যান্য বন্ধ জায়গায় বেশি মারাত্মক হতে পারে। এমনকি এসব জায়গায় ১ দশমিক ৮ মিটার দূরত্ব রেখেও কোনো লাভ হয় না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<105279 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1