মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভয়ংকর প্রতারক রিজেন্টের সাহেদ

২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে ৩২টি প্রতারণা মামলা হয়েছে এমএলএম কোম্পানির নামে প্রতারণার মামলায় জেলও খেটেছেন
তানভীর হাসান
  ০৯ জুলাই ২০২০, ০০:০০
সাহেদ করিম

কখনো সেনা কর্মকর্তা, কখনো আবার আমলা, কখনোবা আবার সিনিয়র সাংবাদিক। কর্মরত রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। দামি ফ্লাগস্ট্যান্ড গাড়ি, চারপাশ ঘেরা বিশালদেহী বডিগার্ড। সাইরেন বাজিয়ে দাপিয়ে বেড়াতেন রাজপথ। তার এমন পরিচয় ও চলাফেরার হাফভাবে যে কেউই থমকে যাবেন। আসলে তিনি মস্ত বড় প্রতারক। এমন পরিচয় ব্যবহার করে গড়ে তুলেছেন প্রতারণার শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। তার আসল নাম সাহেদ করিম। এসএসসি পাশের এই ব্যক্তিই রাজধানীতে প্রতারণার টাকায় গড়ে তুলেছেন রিজেন্ট হাসপাতাল। সেখানে করোনা রোগী পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। প্রতারণার হাতেখড়িটা এমএলএম কোম্পানি দিয়েই। সে মামলায় জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ২০১২ সাল থেকে নতুন করে এ প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিলেন; কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।র্ যাবের অভিযানে তার প্রতারণার নেটওয়ার্ক ছিন্নভিন্ন হয়েছে। এ ঘটনায় তার হাসপাতালের ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৭ জনের নামে দায়েরকৃত মামলায় তাকে প্রধান আসামি করা হলেও এখনো গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।র্ যাবের দাবি, দ্রম্নতই তাকে গ্র্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।

জানতে চাইলের্ যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় ঢাকার রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদের প্রধান ব্যবসা ছিল। 'বাংলাদেশের হর্তাকর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে সে ছবি তুলেছে। এটা আসলে তার একটা মানসিক অসুস্থতা। এ ছবি তোলাকে কেন্দ্র করেই সে প্রতারণা করত। ভয়ংকর এ প্রতারকের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। যখন, যার নাম পারে তখন সেটা বেচে নিজের জীবনকে অগ্রগামী করার চেষ্টা করেছে।' বর্তমান তিনি 'মোবাইল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সবকিছু থেকে সে এখন নিষ্ক্রিয়। তাকে ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে। বাকি আসামিদের ধরতেও অভিযান চলছে।'

সূত্র জানায়, ২০১০ সালের দিকে সাহেদ ধানমন্ডি এলাকায় বিডিএস কিক ওয়ান এবং কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি (কেকেএস) নামে দুটি এমএলএম কোম্পানি খুলে গ্রাহকদের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে গা-ঢাকা দিলে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ পর্যন্ত তার নামে ৩২ টি মামলা রয়েছে দেশের বিভিন্ন থানায়। তার মধ্যে ধানমন্ডি, মিরপুর, উত্তরা, লালবাগ ও আদাবরে মামলার সংখ্যা বেশি। মামলাগুলো হচ্ছে- বাড্ডা থানায়- ৩৭(৭)০৯, আদাবর-১৪(৭)০৯, লালবাগ-৪৭(৫)০৯, উত্তরা ২০(৭)০৯, উত্তরা১৬(৭)০৯, উত্তরা ৫৬(৫)০৯, উত্তরা ১৫(৭)০৯, ৩০(৭)০৯, ২৫(৯)০৯, ৪৯(০৯)০৯, ১০(৮)০৯ সবগুলোই প্রতারণার বলে জানা গেছে। প্রতারণা এসব টাকা রিজেন্ট কেসিএস লি. ইউসিবি ব্যাংক উত্তরা শাখায় অ্যাকাউন্ট নং-০৮৩২১০১০০০০১০০০৩, রিজেন্ট হাসপাতাল লি. ইউসিবি ব্যাংক উত্তরা শাখায় অ্যাকাউন্ট নং-০৮৩১১০১০০০০০০৬১৬, সহ-ব্র্যাক ব্যাংক উত্তরাসহ বিভিন্ন ব্যাংকে শত শত কোটি রয়েছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে। প্রতারণার অর্থ দিয়ে তিনি রিজেন্ট গ্রম্নপ নামে ব্যবসা শুরু করেন। চালু করেন রিজেন্ট হাসপাতাল। যদিও এর কয়েক বছর আগেই হাসপাতালের অনুমোদন নিয়েছিলেন তিনি। হাসপাতাল অনুমোদন পাওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন শাহেদ। নিজেকে আরও কৌশলী করে তোলেন। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তিনি নিজেকে কখনো অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত এমন নানা পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন। কৌশলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্পন্সর সহযোগিতা করে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতেন। এসব কিছু কাজে লাগাতেন নিজের স্বার্থে। অফিস, হাসপাতাল বা বাসা সবখানেই সরকারের ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তোলা ছবি বাঁধাই করে টাঙিয়ে রাখতেন। যাতে সবাই বুঝতে পারে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চলাফেরা রয়েছে। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ছবিকে পুঁজি করেই রিজেন্ট মালিক সাহেদ বিভিন্ন অপকর্ম করছেন।

সূত্র জানায়, গত চার-পাঁচ বছর ধরে নিজেকে কথিত বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি। সেন্টার ফর পলিটিক্যাল রিসার্চ বা রাজনীতি গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠানও চালাতেন তিনি। বিভিন্ন টিভি টকশোতে অংশ নিতেন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সুবিধা আদায়ের জন্য 'নতুন কাগজ' নামে একটি নামসর্বস্ব পত্রিকাও খুলেছেন তিনি। নিজেকে সে পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি। সেটা ব্যবহার করে নিয়মিত সচিবালয়েও যেতেন।

অভিযোগ রয়েছে, বিএনপি সরকারের আমলে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী ও হাওয়া ভবন ঘনিষ্ঠ গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিল এই সাহেদের। সে সময়ও তিনি তদবিরসহ নানা প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেন; কিন্তু ১/১১-এর সময় অনেকের সঙ্গে তিনিও স্রোতের সঙ্গে গা ভাসিয়ে দেন। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তিনি এমএলএমের ব্যবসা খোলেন।

র্

যাব জানায়, ১০ হাজার রোগীর করোনা টেস্টের নমুনা সংগ্রহ করে রিজেন্ট হাসপাতাল। মাত্র ৪ হাজার ২৬৪টি নমুনা সরকারিভাবে টেস্ট করে রিপোর্ট দেয়। বাকি ৫ হাজার ৭৩৬টি পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট প্রদান করা হয়। রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চুক্তি অনুযায়ী, বিনামূল্যে করোনা টেস্ট ও চিকিৎসা দেওয়ার কথা ছিল; কিন্তু ১০ হাজার টেস্টের বিপরীতে রিজেন্ট প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া ভর্তি রোগীপ্রতি এক লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা বাবদ বিল করেছে। আবার শুধু জুনেই সরকারের কাছে চিকিৎসা বিল বাবদ পাঠানো হয় এক কোটি ৯৬ লাখ টাকার হিসাব। সব পক্ষের কাছ থেকেই বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল।

এদিকের্ যাবের অভিযানের খবর পেয়ে ধূর্ত সাহেদ তাৎক্ষণিকভাবে তিনজন কর্মীকে প্যাডের পাতায় পূর্ববর্তী তারিখ বসিয়ে বরখাস্ত করেন। তাদের হাজিরা খাতায় উপস্থিতি ফ্লুয়েড দিয়ে মুছে দেন; কিন্তুর্ যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত বরখাস্ত হওয়া কর্মীদের গিয়ে হাসপাতালে দেখতে পায়। এছাড়া সিসি ক্যামেরার ফুটেজে তাদের প্রতিদিন অফিস করার দৃশ্য ধরা পড়ে। প্রতারণা যে তার রক্তে মিশে গেছে বিষয়টির্ যাবের অভিযানে ধরা পড়ার পর থেকে গা-ঢাকা দেন তিনি। তবে একটি সূত্রমতের্ যাবের গোয়েন্দা জালেই আছেন এ মহাধূর্ত। যেকোনো সময় তাকে গ্র্রেপ্তার করা হবে।

চাইলের্ যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি আমরা। এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে কেউ পার পাবে না। দ্রম্নত তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।

উলেস্নখ্য, গত সোমবার রাজধানীর উত্তরার কোভিড ডেডিকেটেড রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায়র্ যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযান পরিচালনাকালে উঠে আসে রিজেন্ট হাসপাতালের অনিয়মের ভয়াবহ সব তথ্য। এ সময় হাসপাতাল থেকে ৮ জনকে গ্র্রেপ্তার করের্ যাব। এরপর মঙ্গলবার গভীর রাতে রিজেন্ট হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার নামে প্রতারণাসহ নানা অভিযোগে সাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেছের্ যাব। এর মধ্যে গ্র্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে- আহসান হাবীব, আহসান হাবীব হাসান, হাতিম আলী, কামরুল ইসলাম, রাকিবুল ইসলাম, অমিত বণিক, আবদুস সালাম, আবদুর রশিদ খান জুয়েল। মামলার পলাতক আসামিরা হচ্ছে- প্রধান আসামি মো. সাহেদ, মাসুদ পারভেজ, তরিকুল ইসলাম, আবদুর রশিদ খান জুয়েল, মো. শিমুল পারভেজ, দিপায়ন বসু, মাহাবুব, শৈকত, পলাশ। তাদের ধরতে এরই মধ্যের্ যাবের একাধিক টিম মাঠে নেমেছে। সাহেদ যাতে কোনো অবস্থায় দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে সে জন্য নেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা।

সাতজন ৫ দিনের রিমান্ডে

করোনা পরীক্ষা না করেই সার্টিফিকেট দেওয়াসহ নানা অভিযোগে গ্রেপ্তার রিজেন্ট হাসপাতালের সাতজনকে পাঁচ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছে আদালত। রাজধানীর উত্তরা থানা পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত বুধবার এ আদেশ দেয়।

এর আগে এ মামলায় গ্রেপ্তার আটজনকে আদালতে হাজির করা হয়। এদের মধ্যে একজন কিশোর হওয়ায় তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন করা হয়নি। বাকি সাতজনকে সাত দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন করা হয়। আদালত উভয়পক্ষের শুনানি নিয়ে প্রত্যেক আসামিকে পাঁচদিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেয়।

রিমান্ডপ্রাপ্ত সাত আসামি হলেন- প্রশাসনিক কর্মকর্তা আহসান হাবীব, হেলথ টেকনিশিয়ান আহসান হাবীব হাসান, হেলথ টেকনোলজিস্ট হাতিম আলী, রিজেন্ট গ্রম্নপের প্রকল্প প্রশাসক রাকিবুল ইসলাম, রিজেন্ট গ্রম্নপের মানবসম্পদ কর্মকর্তা অমিত বণিক, রিজেন্ট গ্রম্নপের গাড়িচালক আবদুস সালাম ও নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুর রশীদ খান।

মিরপুর শাখায়ওর্ যাবের তালা

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে চিকিৎসার নামে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া বেসরকারি রিজেন্ট হাসপাতালের মিরপুর শাখাও বন্ধ করে দিয়েছের্ যাব।

বুধবার বিকালের্ যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, বিকাল ৪টায় রিজেন্ট হাসপাতালের মিরপুর শাখায় গিয়েছেন তারা। হাসপাতালটি 'সিলগালা' করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মঙ্গলবার ওই হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখা বন্ধের নির্দেশ দেয়। এরপর সন্ধ্যায় উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কে রিজেন্ট হাসপাতালের শাখাটি 'সিলগালা' করে দেয়র্ যাব। পরে উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের ১৪ নম্বর সড়কে রিজেন্টের প্রধান কার্যালয়ও বন্ধ করা হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<105278 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1