বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বহুমুখী চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরু নতুন অর্থবছর

যাযাদি রিপোর্ট
  ০২ জুলাই ২০২০, ০০:০০

চলমান মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) মধ্যেই নানামুখী চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে বুধবার থেকে শুরু হয়েছে নতুন অর্থবছর (২০২০-২১)। করোনার কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে ৬৬ দিন সাধারণ ছুটির পাশাপাশি সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থাও বন্ধ ছিল। গত ৩১ মে থেকে স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে সবকিছু খুলে দেওয়া হলেও করোনার ঝুঁকিতে কোনো কিছুই স্বাভাবিক হয়নি।

পাশাপাশি চরম মন্দা চলছে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে। ব্যবসা-বাণিজ্যে বহুদিন ধরেই স্থবিরতা বিরাজ করছে, যা এখনো বিদ্যমান। এছাড়া উন্নয়ন কর্মকান্ড থমকে গেছে। নতুন করে কোনো ধরনের বিনিয়োগ হচ্ছে না। তাই সরকারের রাজস্ব আয় কমলেও বেড়েছে খরচ।

এমন পরিস্থিতিতে বড় অঙ্কের রাজস্ব আহরণসহ বহুমুখী সংকট মোকাবিলা করাই হবে সরকারের চ্যালেঞ্জ। অন্য চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে- বিনিয়োগ বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো, নতুন করে দারিদ্র্যের হার ঠেকানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ঘোষিত বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা। এসব চ্যালেঞ্জকে সঙ্গী করেই বুধবার থেকে শুরু হয়েছে নতুন অর্থবছরের হিসাব-নিকাশ।

মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পাস হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা

কামাল ৩০ জুন সমাপ্ত অর্থবছরের কার্যাদি নির্বাহের জন্য সংযুক্ত তহবিল থেকে অর্থপ্রদান ও নির্দিষ্টকরণের কর্তৃত্ব প্রদানের জন্য আনীত বিলটি (নির্দিষ্টকরণ বিল, ২০২০) পাসের প্রস্তাব করলে কণ্ঠভোটে তা পাস হয়। এরপর সংসদে উপস্থিত সবাই টেবিল চাপড়ে অর্থমন্ত্রীকে স্বাগত জানান।

এই বাজেট বর্তমান অর্থমন্ত্রীর দ্বিতীয় বাজেট। আর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১২তম বাজেট। নতুন বাজেটের আকার পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। মোট আয় তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। জিডিপির আকার ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

আগের অর্থবছরগুলো স্বাভাবিকভাবে যাত্রা শুরু করলেও এবার ভিন্নভাবে সেটি শুরু হয়েছে। অর্থবছরের শুরুতে করোনাভাইরাসের মহামারি নিয়ে যাত্রা শুরু হলো। সংকট রয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। এর বাইরে করোনাকালীন মহামারি মোকাবিলা করতে গিয়ে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশের অর্থনীতির চাকা থেমে গেছে। দীর্ঘ সময় লকডাউনের প্রভাবে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী কর্মহীন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে রপ্তানি, বিনিয়োগ ও রাজস্ব আয়ে ধস নেমেছে।

এ রকম পরিস্থিতিতেও নতুন অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এবার শুধু ভ্যাট খাত থেকে আদায় করা হবে ১ লাখ ২৫ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ভ্যাট আসে সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্য ও ভোক্তা থেকে। বর্তমান ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতার কারণে এটি আদায় পুরোপুরি হবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, রাজস্ব আহরণের গতি-প্রকৃতি গত অর্থবছরের শুরু থেকেই ভালো ছিল না। করোনা আসার পর তা বেশি খারাপ হয়েছে। এছাড়া প্রতি বছর কোনো ধরনের সংস্কার ছাড়াই এনবিআরের জন্য বড় লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে। এক লাফে অর্থাৎ এক বছরে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের বেশি লক্ষ্যমাত্রা ধরা বাস্তবসম্মত নয়। এবারও যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা অর্জন সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলেন, জিডিপির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা অর্জন সম্ভব নয়। এসব লক্ষ্যমাত্রা কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

এদিকে চরম মন্দা চলছে আমদানি-রপ্তানিতে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরো (ইপিবি) ও আংকটাডের প্রতিবেদনে ধসের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। তবে আংকটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত ২০টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ।

চীনের মধ্যবর্তী পণ্য রপ্তানি ২ শতাংশ কমালে যে ২০টি দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ক্ষতির শিকার হচ্ছে এর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। ফলে এমন পরিস্থিতিতে নতুন অর্থবছরে বড় অঙ্কের যে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা- এটি অবাস্তব বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

এদিকে, নতুন বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ, যা বর্তমান বাস্তবতায় প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে জিডিপির ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ বেসরকারি বিনিয়োগ দরকার। বর্তমানে এ বিনিয়োগের হার হচ্ছে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। কিন্তু আগামী অর্থবছরে বিনিয়োগ আরও হ্রাস পাবে।

এতে নতুন করে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে না কেউ। এছাড়া বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহ অস্বাভাবিক হারে কমে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আংকটাড। সংস্থাটি বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে যেতে পারে।

এতে ক্ষতির মুখে পড়বে বাংলাদেশও। বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নতুন অর্থবছরে কমবে এমন আভাস আগে থেকে দিয়ে আসছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা।

সর্বশেষ চলতি সপ্তাহে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশ হতে পারে। এছাড়া দেশে করোনা মহামারির কারণে লকডাউন জারি হওয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিপাকে পড়েছেন। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে থাকা প্রবাসীদের ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে।

করোনার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায় ওই অঞ্চলের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেওয়ায় তারা অভিবাসী শ্রমিকদের ছাঁটাই করছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ওপর। এতে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ে বড় পতনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডবিস্নউইএফ)।

এদিকে, কৃষি খাতেও এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। পরিবহণ স্বল্পতা, ক্রেতার অভাবসহ নানা সমস্যায় কৃষিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। তবে কৃষি খাত চাঙ্গা করতে সরকার সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনাসহ নানা ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এসব প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষি খাত চাঙ্গা করা হবে আরেক চ্যালেঞ্জ।

এদিকে, সংকটকালের বাজেট প্রস্তাবে জিডিপি, প্রবৃদ্ধি আর রাজস্ব আয়ের বড় লক্ষ্যকে অর্থনীতিবিদরা 'অবাস্তব' বললেও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিয়েছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। গত ১২ জুন বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এসে বারবার এ বিষয়ে প্রশ্নের মুখোমুখী হতে হয়েছে অর্থমন্ত্রীকে। করোনাভাইরাস সংকটে এবারের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন হয় অনলাইনে।

ওইদিন এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'টাকা কোথা থেকে আসবে সে চিন্তা আমরা করিনি। মানুষকে বাঁচাতে হবে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামের অর্থনীতিসহ সামষ্টিক অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করতে হবে। অর্থ যা-ই লাগবে সেটা জোগাড় করা হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'মানুষকে রক্ষা করতেই এবারের বাজেট দেওয়া হয়েছে। এবার আমরা আগে খরচ করব পরে টাকা আয়ের কথা ভাবব।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<104532 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1