শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নমুনা পরীক্ষা বাড়লেও ফল পাওয়ার ভোগান্তি কমেনি

সাখাওয়াত হোসেন
  ০৩ জুন ২০২০, ০০:০০

মাত্র এক মাসের ব্যবধানে দেশে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা দ্বিগুণের বেশি বাড়লেও ফলাফল পাওয়ায় ভোগান্তি মোটেই কমেনি। বরং দক্ষ টেকনোলজিস্টের অভাবে টেস্টের সংখ্যার সঙ্গে পালস্না দিয়ে নমুনা সংগ্রহের ত্রম্নটি আরও বেড়েছে। একই সঙ্গে পরীক্ষার মান নিয়েও নতুন করে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি ও রোগীর দুর্ভোগ দুইই সমান তালে বাড়ছে।

এছাড়া নির্ধারিত সময়ে টেস্ট রিপোর্ট দিয়ে পরবর্তী সময়ে অন্য দিনের সঙ্গে তা যোগ করে দেওয়ায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যায় বড় ধরনের তারতম্য দেখা দিচ্ছে। ফলে সংক্রমণের গতি এক সময় ঊর্ধ্বমুখী এবং আরেক সময় নিম্নমুখী মনে হচ্ছে, যা করোনা পরিস্থিতির সঠিক গতি বোঝার ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতি দ্রম্নত এর সংকট না কাটাতে করোনা মোকাবিলা দিন দিন আরও বেশি কঠিন হয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা জানান, সর্বোচ্চ প্রস্তুতি না নিয়ে নতুন নতুন ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা বাড়ানোর পর নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। সন্দেহভাজন রোগীর নাক থেকে শ্লেষা ও গলা থেকে লালা সংগ্রহের পর সঠিকভাবে এর মান নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক নমুনা বাদ দিতে হচ্ছে। পরবর্তীতে ওইসব রোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্বিতীয় দফায় তাদের নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করতে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ তথ্য না থাকায় তাদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এদের একটি অংশ নমুনা পরীক্ষার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।

ভুক্তভোগীরা জানান, পরীক্ষার ফলাফলে করোনা নেগেটিভ হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা জানানো হয় না- সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে এমন কথা জেনে ফল পেতে বেশি দেরি হলে অনেকেই আর কোনো খোঁজ নিচ্ছেন না। নমুনা পরীক্ষায় ফল নেগেটিভ এসেছে এমনটা ধরে নিয়ে উপসর্গবিহীন অনেক রোগী আগের মতোই স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন জনসমাগমে চলাফেরা শুরু করেন। ফলে তাদের মাধ্যমে অনেকেই দ্রম্নত সংক্রমিত হচ্ছেন। এছাড়া তারা প্রাথমিকপর্যায়ে কোনো চিকিৎসা না নেওয়ায় পরবর্তীতে আকস্মিক গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

অন্যদিকে সময়মতো করোনা পরীক্ষা ফলাফল না পাওয়ায় তাদের মধ্যে অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীরা তাদের ওইসব রোগের চিকিৎসা করাতে পারছেন না। আবার কেউ কেউ করোনা টেস্ট করার জন্য নমুনা দেওয়ার কথা গোপন রেখে বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিকে অন্য রোগের চিকিৎসা নিতে গিয়ে চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য রোগীকে সংক্রমিত করছেন।

করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, সাধারণত ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পাওয়ার কথা থাকলেও অনেক ৫-৭ দিন সময় লাগছে, যা গোটা পরিস্থিতিতে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। নমুনা পরীক্ষা বাড়ানোর চেয়ে সঠিকভাবে নমুনা সংগ্রহ, নমুনা সংরক্ষণের মান নিয়ন্ত্রণ এবং পরীক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করা জরুরি। তা না করে শুধু সংখ্যাগত দিক থেকে নমুনা পরীক্ষা বাড়ানো হলে এর মূল লক্ষ্য ভেস্তে যাবে বলে মনে করেন তারা।

এ প্রসঙ্গে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রিদউয়ানউর রহমান বলেন, টেস্টের ফলাফল পেতে যদি ৩-৪ দিন সময় লেগে যায় তাহলে সেটি চিকিৎসা ও আইসোলেশনেরও কাজে লাগছে না। এতে শুধু কতজনের টেস্ট করা হয়েছে সে রেকর্ড বাড়ছে। ২৪ থেকে সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফলাফল না দিতে পারলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

তবে এ জন্য শুধু স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদেরই নয়, সাধারণ মানুষকেও সচেতন ও সতর্ক হতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোশতাক হোসেন বলেন, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী করোনাভাইরাসের উপসর্গ যাদের মধ্যে থাকবে, তাদের সবাইকেই করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের মতোই সতর্কতার সাথে সেবা দিতে হবে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী, নমুনা পরীক্ষা করতে দেওয়ার সময় থেকে ফলাফল আসার আগ পর্যন্ত সন্দেহভাজন রোগীকে বাসায় বা সেবা কেন্দ্রে আইসোলেশনে রাখা উচিত। কিন্তু দেশের বিভিন্ন এলাকায় এরকম অনেক ঘটনা ঘটছে, যেখানে দেখা গেছে যে নমুনা পরীক্ষা করতে দেওয়ার পর সন্দেহভাজন রোগী যথেচ্ছভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং বিভিন্ন জমায়েতেও উপস্থিত হচ্ছেন। এই ধরনের ব্যক্তিরা নিজেদের অজান্তেই মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন মোশতাক হোসেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের একজন চিকিৎসক বলেন, করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফলাফল সময়মতো না আসায় অনেকের চিকিৎসা ব্যাহত হওয়া, এমনকি বিনা চিকিৎসায় মৃতু্যর খবরও পাওয়া গেছে। সঠিক রোগতাত্ত্বিক চিত্র পাওয়ার জন্য সঠিক সময়ে পরীক্ষার ফল জানা খুবই জরুরি।

এদিকে করোনার নমুনা পরীক্ষার বিলম্বের কারণে অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীর সব ধরনের চিকিৎসা বন্ধ রাখার যে প্রবণতা বিভিন্ন হাসপাতালে দেখা যাচ্ছে তা দ্রম্নত নিরসন করারও তাগিদ দেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্য, নিয়ম অনুযাযী হাসপাতালে রোগী বাছাই করার আলাদা সেন্টার থাকবে। সেখান থেকে রোগীর নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হলে ওই অন্তর্র্বর্তীকালীন সময় রোগী আইসোলেশনে থাকবেন। আর আইসোলেশনে থাকার সময় রোগীর অন্যান্য রোগের চিকিৎসাও নিশ্চিত করতে হবে। পুরানো শ্বাসকষ্টের কোনো রোগী যদি হাসপাতালে যান এবং চিকিৎসক যদি তার নমুনা পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে তাকে কোনো ধরনের চিকিৎসা ছাড়াই বাসায় পাঠিয়ে দেন, সেক্ষেত্রে পরিণতি ভয়াবহ হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, করোনা মহামারি সামাল দেওয়ার জন্য বেশি বেশি করে টেস্ট করার কোনো বিকল্প নেই। তাই সে লক্ষ্যে তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে দক্ষ টেকনোলজিস্টের সংকটের কারণে তারা এ কার্যক্রম আশানুরূপভাবে এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে যে পদ্ধতি (আরটিপিসিআর) ব্যবহার করে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের পরীক্ষা করা হচ্ছে, সেটি বেশ জটিল। অধিকাংশ কেন্দ্রে এই পরীক্ষা করার মতো দক্ষ টেকনোলজিস্টের সংকট রয়েছে। সরকার ১০ বছর ধরে এসব পদে নিয়োগ বন্ধ রেখেছে। ফলে টেস্ট বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন ল্যাব যুক্ত করার সঙ্গে সমস্যাও বাড়ছে। বিশেষ করে জেলা শহরগুলোতে এ সংকট বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

যশোর, খুলনা ও কুষ্টিয়াসহ একাধিক জেলার সিভিল সার্জন জানান, ল্যাবে নমুনা প্রসেসিং, মিক্সিং এবং পরীক্ষা করার জন্য প্রতিটি বিভাগে ৪ জন করে মোট ১২ জন টেকনোলজিস্ট প্রয়োজন। অথচ কোথাও ৬-৭ জন, কোথাও আবার তার চেয়েও কম জনবল রয়েছে। তবে সেদিকে নজর না দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ায় নানা বিষয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে এমন হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।

জেলা পর্যায়ে ল্যাবের দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক মাইক্রোবায়োলজিস্ট জানান, মাঠপর্যায়ে দক্ষ সংগ্রহকারী না থাকায় অনেক নমুনা বাদ দিতে হচ্ছে। তাদের কারও কারও অভিযোগ, নমুনা সংগ্রহের জন্য ফাইবার ও ভিটিএম টিউব নেই। ফলে সাধারণ কটন স্টিক দিয়ে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এতে মাঠপর্যায় থেকে সংগ্রহ করা নমুনা বাদ দেওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। কোথাও কোথাও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ, কোথাও আবার এরও চেয়ে বেশি নমুনা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে জানান তারা।

ঢাকার একটি বেসরকারি ল্যাবের একজন নির্বাহী কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, দুটি জেলা থেকে আসা নমুনা তারা ব্যবহার করতে পারছেন না। তারা ওই জেলার নমুনার ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানিয়েছেন। অন্য একটি সরকারি ল্যাবরেটরির প্রধান ব্যক্তি বলেছেন, 'নমুনার মান নিয়ে আর কিছুই করার নেই। কারণ, মানসম্পন্ন নমুনা সংগ্রহের লোক মাঠে নেই।'

বিএসএমএমইউর ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান সাইফুলস্নাহ মুন্সী বলেন, পরীক্ষা আরও বাড়াতে হলে দক্ষ জনবল ও নতুন যন্ত্র লাগবে। এর বাইরে বিকল্প চিন্তা করা হলে নমুনা পরীক্ষার মান ধরে রাখা কঠিন হবে। সময়মতো নমুনা পরীক্ষার ফলাফল দেওয়াও দুষ্কর হবে বলেও মনে করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেন, কিছু নমুনা বাদ পড়া একেবারে অসম্ভব কিছু নয়। নমুনার পরিচিতিতে অস্পষ্টতা বা ভুল থাকলে নমুনা বাদ দিতে হয়। তবে এসব ত্রম্নটি দূর করার চেষ্টা চলছে। নমুনা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে কারও কারও টেস্ট রিপোর্ট দিতে দেরি হচ্ছে বলে স্বীকার করেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<101124 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1