মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
জাতীয় কমিটির পরামর্শ

অনুমোদন ছাড়া ওষুধ নয় পস্নাজমা থেরাপিতে সতর্ক

যাযাদি ডেস্ক
  ০২ জুন ২০২০, ০০:০০
করোনাভাইরাস নির্মূলে অনুমোদন ছাড়া ওষুধ ব্যবহার না করার পরামর্শ

কোভিড ১৯-এর টিকা নেই, কোনো ওষুধও আসেনি এখন পর্যন্ত। নানা ওষুধ প্রয়োগে রোগ উপশমের উপায় চিকিৎসকরা খুঁজলেও পরীক্ষামূলক ব্যবহারের বাইরে কোনো ওষুধ কিংবা পস্নাজমা থেরাপি প্রয়োগ না করার পরামর্শ দিয়েছে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।

কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় পরীক্ষামূলকভাবে রেমডেসিভির, আইভারমেকটিন, ডক্সিসাইক্লিনসহ গুটিকয়েক ওষুধের পাশাপাশি কনভালেসেন্ট পস্নাজমা ব্যবহার হচ্ছে। বিভিন্ন হাসপাতালে এরই মধ্যে পস্নাজমা থেরাপি ও বিভিন্ন ওষুধ রোগীদের দিচ্ছেন চিকিৎসকরা, যা পরীক্ষামূলক ব্যবহারের ফল না দেখে দেওয়া ঠিক নয় বলে মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

অন্যদিকে, এসব ওষুধ প্রয়োগের পক্ষের চিকিৎসকরা বলছেন, কোনো কার্যকর ওষুধ না আসায় রোগীদের সুস্থ করার লক্ষ্যে তা ব্যবহার করছেন তারা। তবে তারাও চান এসব ওষুধের ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হোক।

দেশে যে কোনো ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য প্রটোকল অনুমোদন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। আর বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) থেকে রিসার্চ ইথিক্যাল ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়।

এ দুটি প্রতিষ্ঠান বলছে, কোভিড ১৯-এর চিকিৎসায় কোনো ওষুধ পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য কোনো অনুমতি কেউ তাদের কাছ থেকে নেয়নি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কয়েকটি ওষুধে সায় দিলেও তা শুধু ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা হাসপাতালে পরীক্ষামূলক ব্যবহারের জন্য। এ সময় দেশে কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসার জন্য আলোচনায় আছে পস্নাজমা থেরাপি।

কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় সুস্থ হওয়া ব্যক্তিদের দেহ থেকে রক্তরস বা পস্নাজমা নিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ সম্প্রতি বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে।

পস্নাজমা থেরাপির পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য একটি কমিটি করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে পস্নাজমা থেরাপি দেওয়া হচ্ছে।

রোগীকে পস্নাজমা দান করতে ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা মানুষের কাছে আবেদন জানাচ্ছেন স্বজনরা। ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বিষয়ে অনেক আবেদন দেখা গেছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ১৬ মে আনুষ্ঠানিকভাবে পস্নাজমা সংগ্রহ শুরু করে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২১ জন পস্নাজমা দিয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে চারজনসহ ৮টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ১৮ জনের শরীরে পরীক্ষামূলকভাবে পস্নাজমা প্রয়োগ করা হয়েছে।

পস্নাজমা থেরাপির জন্য গঠিত কমিটির সভাপতি এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এ খান বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের রিসার্চ ইথিকস কমিটির কাছ থেকে অনুমোদন নিয়েছেন তারা। প্রটোকল অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে ৪৫ জনের ওপর তারা এটি প্রয়োগ করবেন।

তিনি বলেন, 'কোভিড ১৯-এর যেহেতু কোনো ওষুধ নাই তাহলে এটা চেষ্টা করতে তো সমস্যা নাই। এখন যে যার মতো করে দিচ্ছে। তবে নিয়ন্ত্রিতভাবে এটির প্রয়োগ হলে কাকে পস্নাজমা দেওয়া হচ্ছে, ফলাফল কী আসছে, তা বিস্তারিত জানা সম্ভব হবে।'

নিয়ম অনুযায়ী সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে যেন পস্নাজমা থেরাপি দেওয়া যায়, সেজন্য কর্মসূচি নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে অনুরোধ করেছেন তিনি।

তবে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) পরিচালক ডা. মাহমুদ উজ জাহান বলেন, পস্নাজমা থেরাপি প্রয়োগের জন্য ইথিক্যাল ক্লিয়ারেন্স ঢাকা মেডিকেল দিতে পারে না।

কোনো ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা পরীক্ষামূলক প্রয়োগের আগে বিএমআরসির রিসার্চ ইথিক্যাল ক্লিয়ারেন্স নিতে হলেও এখনো কোনো ওষুধের জন্য তা নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।

মাহমুদ বলেন, 'আপনি একটা বিষয়ে গবেষণা করবেন, কিন্তু তার নিয়ম মানবেন না, তা হতে পারে না। এজন্য ন্যাশনাল রিসার্চ ইথিকস কমিটির অনুমোদন লাগে। পস্নাজমা থেরাপির জন্য এই ধরনের অনুমতি নেওয়া হয়নি। লোকাল ইথিকস কমিটি এই অনুমতি দিতে পারে না। এজন্য আমরা তাদের চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানতে চেয়েছি।'

এ সময় আলোচনায় থাকা আইভারমেকটিন ও ডক্সিসাইক্লিন প্রয়োগ করেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা। এই ওষুধ অন্যান্য হাসপাতালেও ব্যবহার হচ্ছে।

বাংলাদেশ মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. তারেক আলম বলেন, এখন আর ওই ওষুধ তারা ব্যবহার করছেন না। তবে বিভিন্ন দেশে এই ওষুধটি ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়ার দাবি ওঠায় এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা যায়।

তিনি বলেন 'আমি একটা স্টাডি দেখেছিলাম অস্ট্রেলিয়ার, সেখানে তারা এই ওষুধটি দিয়েছিল। আমিও ট্রাই করেছিলাম, রোগী ভালো হয়েছে। আমার কথা হচ্ছে ১০টা করে রোগীকে ওষুধটা দিয়ে দেখেন।'

ওষুধটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য 'প্রটোকল' করছেন জানিয়ে ডা. তারেক বলেন, 'আশা করছি, আগামী সোম-মঙ্গলবারের দিকে জমা দিতে পারব। ১০ তারিখে উনাদের একটা মিটিং আছে, আশা করছি ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়ে দেবে।'

কোভিড-১৯ চিকিৎসায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যে 'গাইডলাইন', তাতে আইভারমেকটিন, ডক্সিসাইক্লিন ব্যবহারের কথা বলা নেই। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালসহ ঢাকা ও ঢাকার বাইরের কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে এই ওষুধ প্রয়োগ হচ্ছে।

২৬ এপ্রিলের পর থেকে কোভিড-১৯ লক্ষণ-উপসর্গ নিয়ে আসা পুলিশ সদস্যদের ওপর আইভারমেকটিন প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে জানান কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের পরিচালক ডা. হাসান উল হায়দার।

তিনি বলেন, তাদের পর্যবেক্ষণে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে। তবে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন আছে।

'আমরা এই ওষুধ প্রয়োগ করে দেখেছি রোগীরা সুস্থ হচ্ছেন। ওষুধটা ভালো কাজ করছে, এটা পর্যবেক্ষণ হিসেবে আমি বলতে পারি।'

ঢাকার বাইরের একটি সরকারি হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় আইভারমেকটিন এবং ডক্সিসাইক্লিন ব্যবহার করা হচ্ছে।

গাইডলাইনে না থাকার পরও এই ওষুধের ব্যবহার করছেন কেন- জানতে চাইলে ওই হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, 'কোনো ওষুধই তো নাই। আইভারমেকটিন এবং ডক্সিসাইক্লিন তো নতুন ওষুধ না। এটার সাইড ইফেক্ট নাই, সহজলভ্য এবং দাম কম। আমার হাসপাতালে বেশ খারাপ সিম্পটম নিয়ে এসেছে, এমন কয়েকজনের উপর প্রয়োগ করেছি, তারা এখন ভালো আছে। তাদের আমি অন্য কোনো ওষুধ দিইনি।'

ইবোলা ভাইরাসের ওষুধ রেমডেসিভির তৈরি করে তা সরকারের কাছে দিয়েছে দেশের একটি ওষুধ কোম্পানি। বিভিন্ন হাসপাতালের আইসিইউতে থাকা কোভিড-১৯ রোগীদের উপর তার প্রয়োগ হচ্ছে।

কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের ১৪ জন রোগীর ওপর এই ওষুধটি প্রয়োগ করা হয়েছে বলে জানান হাসপাতালের সমন্বয়ক ডা. শিহাব উদ্দিন।

তিনি বলেন, 'আমাদের আইসিইউতে যে রোগী আছে, তাদের উপর এটা প্রয়োগ করছি। এটা অনেক প্রাথমিক পর্যায়, এজন্য কাজ করছে কি না, বোঝা কঠিন। এটা বিস্তারিত গবেষণা করেই কেবল বলা সম্ভব।'

ওষুধ প্রয়োগে কোভিড-১৯ সারানোর চেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছেন আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন। বতর্মানে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত কারিগরি কমিটির সদস্য তিনি।

তবে মুশতাকও বলেছেন, সম্পূর্ণ ব্যবহারের আগে 'ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের' ফল দেখতে হবে।

'তারাও নানা উপায়ে চেষ্টা করছেন। তবে এগুলো সবই পরীক্ষাধীন। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে যদি তারা প্রমাণ দেখাতে পারেন তাহলে আমরা একটা সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারব।'

রেমডেসিভির ঔষধ প্রশাসনের অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করতে হলে বিএমআরসির অনুমোদন লাগবে, যা কেউ নেয়নি বলে জানান ডা. মাহমুদ উজ জাহান।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে রেমডেসিভির। তার ভিত্তিতে বাংলাদেশেও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে শুধু পরীক্ষামূলক ব্যবহারের জন্য।

এর বাইরে গণহারে ব্যবহার করা যাবে না বলে জানিয়েছেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. রুহুল আমিন।

তিনি বলেন, 'কোনো চিকিৎসক যদি মনে করেন এটা ব্যবহার করে ভালো রেজাল্ট পেয়েছেন, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু আমরা কখনোই বলিনি আইভারমেকট্রিন-ডক্সিসাইক্লিন করোনার ওষুধ। এখন এই ওষুধের অন্য কোনো ব্যবহার করতে হলে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল লাগবে। আর সেজন্য আমাদের অনুমতি লাগবে। একইভাবে পস্নাজমা থেরাপির জন্য যদি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করে তাহলে আমাদের কাছ থেকে প্রটোকল অনুমোদন নিতে হবে।'

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান বলেন, এসব ওষুধ 'কিছুটা কাজ করছে' বলে তারা শুনেছেন।

তিনি আরও বলেন, 'তা প্রয়োগ করবার আগে কিছু নিয়ম মেনে আসতে হবে। কোনো ব্যত্যয় হলে পরে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের ওই চিকিৎসককে আমরা মন্ত্রণালয়ে দাওয়াত করেছিলাম। উনাকে বিএমআরসির ইথিক্যাল ক্লিয়ারেন্স নিয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যাওয়ার অনুরোধ করেছি।' বিডিনিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<101021 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1