শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শিশুমন ও তার স্বাস্থ্য

শিশুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা অপরিহার্য। শিশুর পরিপূর্ণ সুস্থতা তথা শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক বিকাশে শুধু উপস্থিত থাকাটাই সবকিছু নয়, প্রয়োজন প্রকৃত মনোযোগ এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের। যার মাধ্যমে আপনার সন্তানের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন আপনি এবং সক্ষম হতে পারেন নানারকম সমস্যা থেকে দূরে রাখতে।
ড. ফারাহ দীবা
  ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

প্রায় এক দশকের বেশি সময় মানুষের মনবিষয়ক জ্ঞানাহরণ করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছি, কোনো এক অজানা কারণে আমাদের মাঝে একটি প্রবণতা কাজ করে তা হলো- বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ভুলে যেতে থাকি শিশুদের 'মন' বলে একটা কিছু থাকতে পারে। কিন্তু চোখ বন্ধ করে এক মিনিট নিজের শিশুকালের কোনো একটি ঘটনা মনে করুন তো। ৫-৬ বছরের আপনি। একা অন্ধকারে থাকার কষ্ট, বন্ধুদের কাছে পাত্তা না পাওয়া, শিক্ষকের কাছ থেকে বিনা অপরাধে শাস্তি পাওয়া ইত্যাদি। আজো মনে হলে নিজের জন্য কি কষ্ট হয় না আপনার? এমন ছোট ছোট অনেক স্মৃতি, দুঃখ-কষ্ট-বেদনাই দিনে দিনে তৈরি করেছে আজকের আপনার ভেতরকার আপনাকে। মানবজীবনে শিশুকাল তাই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু শিশুকালের অভিজ্ঞতাসমূহ থেকেই ধীরে ধীরে একজন মানুষের সব ধরনের সামাজিক, মানবিক, বিবেক, বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতাটি নির্দিষ্ট ধরনের হয়ে প্রতিষ্ঠা পায়, তাই খুব সহজেই অনুমেয় যে, এ সময় শিশুর চারপাশে, ভালো অনুভূতি তৈরির আবহ থাকার প্রয়োজনীয়তা কতখানি। আর আমাদের মতো অতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশে এর প্রয়োজনীয়তা আরও অনেক বেশি। এর কারণ ব্যাখ্যা করা আসলে খুব বেশি প্রয়োজন নেই, সেগুলো সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত আছি। তবুও কিছু বিষয় এই লেখায় অবতারণা করছি। ধরুন- রিকশা, অটোরিকশা বা গাড়িতে আপনি কোথাও বের হয়েছেন। আপনি গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত 'সড়ক দুর্ঘটনা'র আশঙ্কা ছাড়াও কতগুলো ছোটখাট বিষয় নিয়ে পুরোটা পথ আতঙ্কিত থাকেন। (আবার গন্তব্যে পৌঁছে বিষয়টা আপনি, আপনা আপনিই ভুলে যান!!!) যেমন, কোনো সিগন্যালে দাঁড়ানো মাত্র কিছু শিশু আপনাকে ঘিরে ধরতে পারে চকলেট বিক্রির নামে, গাড়ি পরিষ্কারের নামে আপনাকে প্রথমে তার অসহায় শৈশবকে ব্যবহার করে আপনাকে দুর্বল করতে চাইবে এবং আপনি যদি তাকে তার আশানুরূপ প্রতিদান না দেন তবে সে এমন একটা কিছু করে বসবে যা আপনার দিনের বাকি সময়টার মানসিক প্রশান্তি কেড়ে নিতে পারে। হয়তো আপনি অবাক হয়ে ভাবছেন 'একই বয়সী নিজ পরিবারের শিশুদের প্রতি চারপাশের সবাই তার শিশুতোষ সারল্যেই আকৃষ্ট হই। তাহলে কেন ওইসব শিশুরা তাদের সারল্য হারাচ্ছে।' এর উত্তর আমরা সবাই জানি। ওরা আসলে পরিস্থিতির শিকার। ওরা ভালো বিষয় যত না দেখে, শোনে নির্মম কথা-আচার-আচরণের অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হয় তার চেয়ে বেশি। সেটাই তাদের মানসিকতায় ছাপ ফেলছে এবং দিনের পর দিন তাদের মনের এই অবস্থাগুলো যখন এভাবেই চলতে থাকে তখন স্বাভাবিকভাবেই এরা বড় হয় অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি-মায়া-দয়াহীন এক একজন মানুষ হয়ে ওঠে। আজ ১২ বছরের শিশুটি আপনার কাছে কিছু চেয়ে না পেয়ে (আপনি যদিও দিতে বাধ্য নন) আপনাতে হয়তো ভেঙচি কেটে একটা বাজে কথা বলে চলে যাচ্ছে কিন্তু সামনে এই শিশুটি যখন ১৫-১৭ বছরে হয়ে আমার বা আপনার টাকার ব্যাগটি কেড়ে নিতে গলায় ছুড়ি ধরবে না বা ধরাটা তার জন্য অস্বাভাবিক হবে তার নিশ্চয়তা কী?

আমরা ভাবি, তাহলে হয়তো ঘরের শিশুরা ভালো আছে? কিন্তু আসলে কি আছে? হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। আমাদের অনেকেই শিশুদের ঘরে রেখে যেতে হয়- কাজের লোকের কাছে। স্কুল-কলেজ-কোচিং ইত্যাদি নিয়ে যেতে বা আসতে ছেড়ে দিতে হয় ড্রাইভারের ভরসায়। কখনও রেখে আসতে হয় প্রতিবেশীর বাড়িতে। কিশোরী মেয়েটিকে প্রয়োজনেই কিনে দিতে হয় মোবাইল ফোন, রাত জেগে যে কারো সঙ্গে ফ্রি অফারে কথা বলার ভয় থাকার পরেও। কলেজপড়ুয়া ছেলেটিকে কিনে দিতে হয় ল্যাপটপ, ইন্টারনেটের সহজ লভ্যতায় এক নিমেষে পর্ণগ্রাফির জগতে প্রবেশের দরজাটি খোলা জেনেও। এগুলো খুব সাদামাটা ঘটনা প্রাত্যহিক জীবনে কিন্তু আমাদের অগোচরে প্রতিদিন এসব বিষয়ের ভেতর দিয়েই কোনো না কোনো মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটে যাচ্ছে অনেক সাবধানে রাখা শিশুদের জীবনে।

শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতন ঘটে যায়, হয়তো আমরা জানতেও পারি না। আমাদের সঙ্গে পরিবারের শিশুটির বয়স উপযোগী সত্যিকার সম্পর্ক আসলে আছে কি বয়োঃজ্যেষ্ঠ হিসেবে? ভালো জামাকাপড়, ভালো স্কুল, ভালো অবস্থা শিশুর জীবনে সুনিশ্চিত করাই তার পরিপূর্ণ বিকাশকে সুরক্ষিত বা সুসংগঠিত করা নয়।

উদাহরণস্বরূপ ২০১১ সালে দেশের ৬টি জেলার ৫৮১ জন স্কুলগামী শিশুদের নিয়ে আমার করা একটি ছোটখাট গবেষণার কথা বলতে চাই। শতকরা ১৫.৩% মেয়ে এবং ৬.৬% ছেলে শিশুরা (৯-১৭ বছরের) নানা ধরনের (স্পর্শহীন থেকে স্পর্শযুক্ত) যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে (স্কুলপড়ুয়া শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, প্রথম আলো, তারিখ: ১৭-০৮-২০১১)। এবার হয়তো মনে হতে পারে যে, সে জন্যই আসলে মায়েদের উচিত শিশুদের সঙ্গে সারাক্ষণ সময় দেওয়া। কারণ আমাদের সমাজে এটি আরেকটি অদ্ভুত ধারণা প্রচলিত, লেখাপড়া শেখা, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করা উচিত মেয়েদের; কিন্তু, যখনই একটি সন্তত্মান তার জীবনে এলো, সবকিছু ছেড়ে তাকে ঘরের ভেতর সমগ্রপৃথিবী বানানো উচিত। কিন্তু তাই যদি ঠিক হতো তবে কেন গ্রামাঞ্চলে ১০.৫% মেয়ে ও ৫.৭% ছেলে শিশুরা এসব নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, যেখানে শহরের একই বয়সী ৪.৮% মেয়ে এবং .৯% ছেলেরা এসব নির্যাতনের শিকার হচ্ছে (্‌্‌ওই গবেষণায় প্রাপ্ত)! তবে কি আজকাল গ্রামীণ মায়েরা সব বাইরে কাজে চলে যাচ্ছেন? বাবা-মা দুজনের সঙ্গে শিশুর বন্ধনের প্রকৃতিই মূলত তাকে একজন মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। আমাদের সবকিছুর উপরে শিশুদের গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মানে শুধু আমাদের শিশুটি নয়। ১৪ কোটি বাংলাদেশির ৬ কোটি শিশুই আমাদের নিজেদের পরিবারের এবং আমাদের বিশাল নিম্ন আয় পরিবারের ভবিষ্যৎ। তাই আমরা যারা শিক্ষার কারণে জীবনের ভালো কথাগুলো জানতে পারি তাদেরই দায়িত্ব এসব এক-দুইজন করে ওদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। কারণ তারা এসব মানসিক বিষয় নিয়ে ভাবে না, ভাবার মতো অবস্থা তাদের নেই।

পরিশেষে আবারও বলতে চাই,

শিশুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা অপরিহার্য। শিশুর পরিপূর্ণ সুস্থতা তথা শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক বিকাশে শুধু উপস্থিত থাকাটাই সবকিছু নয়, প্রয়োজন প্রকৃত মনোযোগ এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের। যার মাধ্যমে আপনার সন্তানের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন আপনি এবং সক্ষম হতে পারেন নানারকম সমস্যা থেকে দূরে রাখতে।

ড. ফারাহ দীবা: সহযোগী অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<88827 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1